ডায়েরিয়া : মেয়র ব্যস্ত দায় এড়াতে!

70 year 27 Issue, 23 Feb 2018

 

ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ছ’মাস আগে৷ তখন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন, আর স্বাস্থ্য ও পৌর প্রশাসন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তথ্য গোপন করতে৷ তেমনি সম্প্রতি দক্ষিণ–পূর্ব কলকাতার চোদ্দোটি ওয়ার্ডে আন্ত্রিক যখন মহামারী আকার নিল, তখন কলকাতা পুরসভার মেয়রের প্রথম কাজই হল এর জন্য পুরসভা দায়ী নয়, সেটা প্রমাণ করা৷ তিনি আক্রান্ত এলাকার মানুষদের জোর গলায় বললেন, পুরসভার পানীয় জল একশো শতাংশ নিরাপদ এবং পুরসভার ল্যাবরেটরিতে তা প্রমাণিত৷ শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়েই তিনি দাবি করলেন, ঋতু পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণই এর জন্য দায়ী৷ বিগত বছরগুলির পরিসংখ্যান নাকি তাই বলছে৷ দুর্গত এলাকার মানুষের অভিজ্ঞতা কিন্তু আলাদা৷ তাই তাঁরা মেয়রের কথার উপরে আস্থা রাখার বদলে বেশি দামে জল কিনে কিংবা জল ফুটিয়ে ব্যবহার করাকেই শ্রেয় মনে করেছেন৷

চারদিনে বাঘাযতীন, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর– এক কথায় গড়িয়া থেকে নোনাডাঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত পুরসভার আটটি ওয়ার্ডে দু’হাজারেরও বেশি মানুষ ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হলেন, যাঁর মধ্যে ৮০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল এবং একজন মারাও গেলেন৷ বিশেষজ্ঞরা তো বটেই, এমনকী সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছেন এটা ঘটেছে পানীয় জলের সংক্রমণ থেকে৷ সেখানে মেয়রের ঘোষণা আক্রান্ত মানুষকে কেবল ভুল পথে চালিত করেছে তাই নয়, রোগের উৎস নির্ণয় এবং তা প্রতিকারের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক তৎপরতাকে অনেকটাই শ্লথ করেছে৷ বিশেষত জলবাহিত রোগের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান নাইসেড এবংস্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনকে দিয়ে প্রথমেই আক্রান্ত অঞ্চলের জল পরীক্ষা করালে আরও আগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হত৷ পরে অবশ্য এদের পরীক্ষাতেই ধরা পড়ে পানীয় জলে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি, যা প্রমাণ করে পানীয় জলের সাথে নিকাশির জল মিশে যাচ্ছে এবং তার ফলে নানা ক্ষতিকর জীবাণুর সংক্রমণ ঘটছে৷

এমনিতেই পুরসভার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য পরিকাঠামো ব্যবস্থার নিয়মিত নজরদারির অভাব রয়েছে৷ নিতান্ত কোথাও পাইপ না ফাটলে কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়ে না৷ তার উপর, নিকাশির পাইপ, বিদ্যুতের কেবল বসানো প্রভৃতি কাজে যখন রাস্তা খোঁড়া হয়, তখন পানীয় জল সরবরাহের পাইপ লাইনটি অক্ষত রইল কি না, সেখানে সংক্রমণের কোনও ঘটনা ঘটছে কি না (যেমনটি সন্তোষপুর সিক্সথ রোডে ঘটেছে বলে পরে উদঘাটিত হয়েছে), সে সবের সমন্বয়মূলক নজরদারির কোনও ব্যবস্থা পুরসভার নেই৷ ফলে যে কোনও সময় যে কোনও বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে৷ যেমন সম্প্রতি নাইসেড বাইপাস এলাকার ২৮, ২৯, ৫৮, ৫৯ এবং ৬৬ এই পাঁচটি ওয়ার্ডে জল পরীক্ষা করে কলেরার জীবাণুর সন্ধান পেয়েছে৷ নাইসেড এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (হু) ওয়ার্ডগুলির পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের জন্য ‘কলেরা ভ্যাকসিনেশন’–এর একটি কার্যক্রম চালু করার প্রস্তাব কলকাতা পুরসভাকে দিয়েছে৷ কিন্তু সংবাদে প্রকাশ, পুরসভা আর্থিক অসংগতির কথা বলে তা কার্যকর করতে চাইছে না৷ ঠিক একইভাবে ডেঙ্গু মোকাবিলার ক্ষেত্রেও পুরসভা নাইসেডের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিল৷ আলো ঝলমলে পার্ক তৈরি করতে, শহরকে রঙিন আলোয় মুড়ে দিতে পুরসভা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, প্রচুর অর্থ দুর্নীতিতে নয়–ছয় হয়৷ অথচ জনপরিষেবার ওই গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অর্থের সংস্থান হয় না৷

আর এই অন্যায়টিকে ঢাকতেই যে কোনও বিপর্যয়ে সরকার ও পুরসভাগুলি দায় এড়াতে তৎপর হয়ে ওঠে৷ পাছে তাদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিতে কালি লাগে, তাই তারা সত্য গোপন করতে, সঠিক তথ্য চাপা দিতে অতি তৎপর হয়ে ওঠে৷ মানুষের জীবন রক্ষার প্রশ্ন আসে তারপরে৷ পরিষেবার পরিকাঠামোকে ত্রুটিমুক্ত করার এই দায়িত্ব ছাড়াও যে কোনও বিপর্যয়ে চিকিৎসা পরিষেবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় তা আরও মারাত্মক রূপ নেয়৷ বিপর্যয় মোকাবিলার উপযুক্ত সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সরকারি প্যাথোলজির সুযোগ–সুবিধা মজুত না থাকায় আশঙ্কাজনক রোগীকে একটু সুস্থ হলেই ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে রোগী মারাও যায়৷ সরকার ও পুরসভার অপদার্থতায় এই ধরনের ঘটনাই বারবার ঘটছে৷