জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার শতবর্ষের প্রেক্ষিতে হিন্দুত্ববাদীদের দেশপ্রেম

আরএসএস–বিজেপি–হিন্দুমহাসভার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এমন পাষণ্ডও দুনিয়ায় আছে নাকি? এই ঘোর কলিযুগে ব্রহ্মতেজের অভাবে বিজেপি নেতাদের হয়ত গোরক্ষকদের শরণ নিয়েই অবিশ্বাসীদের শায়েস্তা করতে হবে৷ কিন্তু ইতিহাস যে অন্য কথা বলছে!

 একশো বছর আগে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে বর্বর গণহত্যা চালিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সেনাবাহিনী৷ সরকারি মতে মৃত ৩৭৯ হলেও বাস্তবে নিহতের সংখ্যা ছিল ১ হাজারের বেশি৷ আহত ২ হাজারেরও বেশি৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা৷ যাতে ক্রমবর্ধমান স্বাধীনতা আন্দোলন মাথা তুলতে না পারে৷ ব্রিটিশের উদ্দেশ্য সফল হয়নি, আতঙ্কে আন্দোলন থেমে যায়নি৷ প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও৷ তিনি ব্রিটিশের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন৷ আন্দোলনের জোয়ার আরও জোরদার হয়েছিল৷ বিপ্লবীদের কাছেও জালিয়ানওয়ালাবাগ হয়ে উঠেছিল সংগ্রামের প্রেরণার উৎস৷

বিপ্লবী ভগৎ সিং ছিলেন তখন নিতান্ত কিশোর৷ তিনি খবর শুনে ছুটে গিয়েছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগে৷ শহিদের রক্তমাখা পবিত্র মাটি নিয়ে এসেছিলেন, তা মেখেছিলেন কপালে৷ শপথ নিয়েছিলেন, এর প্রতিশোধ একদিন নিতে হবে৷ কিন্তু ভারতীয়দের মধ্য থেকেও বন্ধু পেয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার৷ দেশের মানুষের সঙ্গে কার্যত বেইমানি করে জালিয়ানওয়ালাবাগে বর্বর হত্যাকাণ্ডের কুখ্যাত নায়ক কর্নেল রেজিন্যাল্ড ডায়াসের পাশে দাঁড়িয়েছিল ‘পাঞ্জাব হিন্দু সভা’৷

এই সংগঠনের পথেই পরবর্তীকালে কানপুর থেকে গড়ে ওঠে সর্বভারতীয় হিন্দু মহাসভা৷ এই হিন্দুত্ববাদীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন আরএসএস সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলনের পট জুড়ে সবসময়েই থেকেছে ব্রিটিশ–রাজের পাশে৷ আরএসএস–এর রাজনৈতিক মুখোশ হয়ে ওঠে হিন্দু মহাসভার পথ ধরে আসা জনসংঘ৷ অবশেষে জনসংঘের নাম পাল্টে ১৯৮০ সালে তাদের কিছু নেতা বিজেপি গড়ে তোলেন, যাঁরা আজ আগুনখোর স্বদেশপ্রেমী হিসাবে আবির্ভূত

ফিরে দেখা যাক সেদিনের ইতিহাস৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছে, হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য যারা ব্রিটিশের হয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যে লড়তে গিয়েছিল তাদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছে৷ ঘরে ফিরেছে যারা তাদের মধ্যে অসংখ্য আহত, চিরতরে পঙ্গু৷ তাদের অন্নসংস্থানের সামর্থ্যটুকুও নেই৷ দেশের মধ্যে নিদারুণ অভাব, খাদ্যের আকাল, গ্রামে শহরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় জমিদার ও কলকারখানা মালিকদের অত্যাচার আরও বেড়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে বাংলা এবং পাঞ্জাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন তখন বারবার ফেটে পড়ছে৷ পাঞ্জাবের গদর পার্টির নেতৃত্বে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় প্রবাসী ভারতীয় বিশেষত পাঞ্জাবীদের মধ্যে দানা বাঁধছে৷ ১৯১৫ সালে রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে ভারতের নানা স্থানে সেনা বিদ্রোহের চেষ্টার অভিযোগে কর্তার সিং সারাভা, বিষ্ণু গণেশ পিংলে সহ সাত বিদ্রোহীর ফাঁসি হয়৷ ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করছিল পাঞ্জাবের গদর পার্টি এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সোভিয়েত বিপ্লবীদের যোগাযোগ ঘটছে৷ ইতিমধ্যে ১৯১৭–র সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যতটুকু সংবাদ ভারতে পৌঁছেছিল তার প্রভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তীব্রতা আসে৷ শ্রমিক আন্দোলনও শুরু হয়৷ বোম্বের শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা এই ক্ষেত্রে আরও মাত্রা যোগ করে৷ এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, সোভিয়েত বিপ্লবের প্রভাবে ভারতের বিরাট অংশ সহ আফগানিস্তানে তীব্র জনজাগরণ ঘটে যেতে পারে৷ পাঞ্জাবের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি দেখে সেখানে বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটার ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল তারা৷ তাই ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে বিচারপতি সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে নিয়োগ করে দমনমূলক পথ খঁুজে বার করতে৷ রাওলাট কমিটি ১৯১৫–র ভারত রক্ষা আইনকে আরও কঠোর এবং আক্রমণাত্মক করার সুপারিশ করে৷এর মাধ্যমে সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ, বাকস্বাধীনতা হরণ, রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া, বিনা বিচারে যে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে যত দিন খুশি আটক রাখার অধিকার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া সহ নানা ধরনের দমনমূলক ব্যবস্থা নেয় ব্রিটিশ সরকার৷

এই রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সারা ভারতেই প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়৷ পাঞ্জাবে এর তীব্রতা ছিল অনেক বেশি৷ ১৯১৯ সালে এপ্রিলের শুরুতেই লাহোরে প্রায় ২০ হাজার মানুষের মিছিল ব্রিটিশকে আতঙ্কিত করে৷ ১০ এপ্রিল অমৃতসরে ডেপুটি কমিশনারের বাড়িতে বিশাল জনতা বিক্ষোভ দেখায়৷ টেলিগ্রাফ পোস্ট, রেললাইন উপড়ে দিয়ে, রাস্তা কেটে মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে থাকে৷ অমৃতসরে ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশে  জড়ো হয়েছিলেন প্রায় ৫ হাজার নরনারী৷ শিখ নববর্ষ এবং বৈশাখী মেলার আনন্দের সাথে মিলে গিয়েছিল রাওলাট কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ৷ তাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এতটাই আতঙ্কিত হয় যে, অমৃতসরের মিলিটারি কম্যান্ডার রেজিন্যাল্ড ডায়ার মেশিনগান, রাইফেল সহ সামরিক বাহিনী নিয়ে জমায়েতস্থলে পৌঁছে কোনও হুঁশিয়ারি না দিয়েই চারিদিক ঘেরা পার্কের সংকীর্ণ পথগুলি আটকে বাহিনীকে গুলি চালাতে আদেশ দেন৷ হাজার হাজার মানুষ লুটিয়ে পড়েছিলেন গুলির আঘাতে৷ পার্কের মধ্যেকার একটি কুয়োতে লাফিয়ে পড়ে অনেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন৷ সেখান থেকে পরে শতাধিক মৃতদেহ উদ্ধার হয়৷ পরে কর্নেল ডায়ার তদন্ত কমিশনের সামনে বলেছিলেন, দেশ জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য, যাতে আন্দোলন আর না এগোয়৷ বলশেভিক বিপ্লবের ভয়েই যে এমন উন্মত্ত আক্রমণ, বিচারের সময় তাও তিনি বলেছিলেন৷ ডায়ার নির্বিকার চিত্তে জানিয়েছিলেন, মেশিনগানগুলি গাড়ি থেকে নামিয়ে ভিতরে নিয়ে যেতে পারিনি বলে কম লোকের মৃত্যু হয়েছে৷ আমি আরও হত্যা চেয়েছিলাম৷

সারা দেশ যখন এই গণহত্যার নিন্দায় মুখর তখন ঠিক এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিল ‘পাঞ্জাব হিন্দু সভা’র কাছ থেকে৷ তারা রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল শুধু তাই নয়– জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর ‘এই অরাজকতার নিন্দা’ করে তারা ব্রিটিশের প্রতি ‘গভীর আনুগত্যের’ শপথ নিয়েছিল (কে এল তুতেজা– ‘দ্য পাঞ্জাব হিন্দু মহাসভা অ্যান্ড কমিউনাল পলিটিক্স, ১৯০৬–১৯২৩’, ফ্রন্টলাইন ১৪ মার্চ ২০০৩– নিউ ব্র্যান্ড অফ হিস্ট্রি, বিশ্বমোহন ঝা)৷ ব্রিটিশ রাজের ভারত আগমনকে প্রণতি জানিয়ে তারা বলেছিল, ‘ঈশ্বরের অসীম কৃপায় আর্যজাতির গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা যা সুদূর অতীতে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, আবার এক হতে পেরেছে৷ এক জাতি অপরটিকে রাজনৈতিক পথনির্দেশ এবং সুরক্ষা প্রদান করছে৷ যে সাম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্ত যায় না, তার প্রজা হিসাবে আমরা গর্বিত এবং এই প্রাপ্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রমাণ করতে আমরা সর্বদাই সচেষ্ট’ (ওই)৷

যদিও এই বিশ্বাসঘাতকরাই এ দেশের সব নয়, এর ঠিক বিপরীতে ছিলেন এ দেশের বিপ্লবীরা৷ কর্নেল ডায়ারের হত্যালীলার মদতদাতা পাঞ্জাবের প্রাক্তন লেফটেনান্ট গভর্নর মাইকেল ও ডায়ারকে লন্ডনে গুলি করে হত্যা করেছিলেন যিনি, সেই উধম সিং তাঁর বিচারের সময় নিজের নাম বলেছিলেন, ‘মহম্মদ সিং আজাদ’৷ কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ভারতের সকল মানুষের প্রতিনিধি আমি৷ সব ধর্ম–বর্ণ মিলে আমরা লড়ছি৷ এ কথা হিন্দু মহাসভার বক্তব্যের ঠিক বিপরীত৷ ভারতের অগণিত যুবক যখন বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে স্বাধীনতার বেদিমূলে, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদের চ্যাম্পিয়ান আরএসএস বারবার ব্রিটিশের আনুগত্য ভিক্ষা করেছে৷ তাদের মাথা গোলওয়ালকার ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে বলেছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীল৷ তাদের অন্যতম আইকন (উপাস্য) সাভারকর ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে ব্রিটিশের আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন৷ আরএসএস প্রধান হেডগেওয়ার থেকে শুরু করে হিন্দু মহাসভা ও জনসংঘের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত ১৯৪২–এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন৷ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন এই সংগঠনগুলি চেয়েছে ব্রিটিশের সাথে ‘নিবিড় সহযোগিতা’৷

জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার শতবর্ষে এই দুই ভূমিকার পার্থক্য আমাদের অবশ্যই চর্চা করতে হবে৷

(৭০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা ১৮ মে, ২০১৮)