জাতীয় শিক্ষানীতি প্রতিরোধে ১৪ সেপ্টেম্বর মিছিলে প্লাবিত হবে কলকাতা

মেদিনীপুরের রঘুনাথবাড়ি হাইস্কুলের গেটে ক্লাস সেভেন এইট নাইনের ছাত্ররা ঘিরে ধরেছে দুই এআইডিএসও কর্মীকে। ‘দিদি কাল আসবে তো? আমার ক’জন বন্ধু আজ আসেনি। ওদের সইটা নিতে হবে। তুমি বরং এক কাজ করো। দুটো ফর্ম আমাকে দাও। একটা দেবো স্কুলের বন্ধুদের, আর একটা পাড়ায়।’

‘এই কি করছিস রে’, ক্লাস নাইনের এক ছাত্র হাঁক দেয় সেভেনের ছাত্রকে। সে উত্তর দেয় ‘স্কুল বেসরকারি হয়ে যাবে। প্রচুর টাকা দিয়ে পড়তে হবে। এটা যাতে না হয় তার জন্য সই করতে হচ্ছে।’ নাইনের ছাত্রটি জিজ্ঞাসা করে ‘কোথায় সই করতে হবে বলো। আমি আমার বন্ধুদেরও সই করিয়ে দিতে পারি।’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটেও চলছিল স্বাক্ষর সংগ্রহ। এআইডিএসও কর্মীরা সমস্ত ছাত্রদের কাছে আবেদন জানাচ্ছিল, ছাত্ররাও সই করছিল। পাশে এসে দাঁড়ালো মাস্টার ডিগ্রির এক দৃষ্টিহীন ছাত্র। জিজ্ঞেস করল টিপ ছাপ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে? তেমন কিছু ব্যবস্থা না থাকায় বলল, আমার নামটা তোমরাই লিখে দাও।’ বেশ কিছুক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে থেকে এআইডিএসও কর্মীদের সাথে অন্য ছাত্রদের কাছে সে-ও সই করার আবেদন জানাল। মুর্শিদাবাদের এক স্কুলে মাত্র একজন শিক্ষক ছাড়া সেই দিন উপস্থিত সমস্ত ছাত্র-শিক্ষকই সই করেন। বাঁকুড়া শহরে প্রচার অভিযান চলার সময় এক ভদ্রলোক সই করে আন্দোলনে অর্থ সাহায্য করেন এবং এআইডিএসও কর্মীদের তার এলাকায় যাওয়ার আবেদন জানান। যেদিন তাঁর গ্রামে যাওয়া হয় সেদিন অসুস্থতা সত্ত্বেও স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া যাবে এমন কুড়িটি বাড়িতে তিনি এআইডিএসও কর্মীদের নিয়ে যান। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটি বৈঠক করে জাতীয় শিক্ষানীতির ভয়াবহতা তাদের কাছে তুলে ধরার প্রস্তাব করেন তিনি।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রতিরোধে এআইডিএসও সর্বভারতীয় কমিটির আহ্বানে দেশব্যাপী যে এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান সারা রাজ্যে এমনই গণচরিত্র অর্জন করেছে। সরকার এমন প্রচার করে যেন, ছাত্র-ছাত্রীরা সব ফাঁকিবাজ, তারা পরীক্ষার ভয়ে ভীত। অথচ মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা আর থাকবে না, শিক্ষা হবে অনলাইন ভিত্তিক, জাতীয় শিক্ষানীতির এই প্রস্তাব ছাত্ররা যখন জানছে, রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। স্বাক্ষর সংগ্রহে তাদের আগ্রহ, উৎসাহ দ্বিগুণ হয়ে উঠছে। অভিভাবকরা যখন শুনছেন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে তুলে দেওয়া হবে পরিকাঠামোহীন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের হাতে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও বিষয়ভিত্তিক বই থাকবে না, স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বৃত্তিমুখী শিক্ষার আয়োজন করা হবে, শিক্ষার কোনও আর্থিক দায়িত্ব সরকার আর বহন করবে না, তখন তাঁদেরও চোখে মুখে ফুটে উঠছে সর্বনাশের আশঙ্কা। যে শিক্ষানীতি মৌলিক গবেষণার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গবেষণা ক্ষেত্রকে কর্পোরেট সংস্থার অর্থ উপার্জনের বিষয় করে তোলে, এমফিল ডিগ্রি তুলে দেয়, যে শিক্ষানীতি বিএ বিএসসি বিকমকে তিন বছরের বদলে চার বছরের কোর্সে পরিণত করার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করে, ইতিহাসকে বিকৃত করে, বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞানের চর্চা করতে চায়–গবেষক শিক্ষক অধ্যাপকরাও চান সেই নীতি বাতিল হোক। মেডিকেল ছাত্রদের দাবি ‘সিবিএমই’, ‘নেক্সট’ পরীক্ষা বাতিল করা হোক। এত রাগ ক্ষোভ-দাবি প্রতিবাদী মন– সে কি শুধু সাদা কাগজের পাতায় একটি স্বাক্ষরের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে পারে? স্বভাবতই তা আত্মপ্রকাশ করতে চায়। চায় প্রতিবাদী শত ফুল বিকশিত হোক। প্রতিস্পর্ধী হাজার হাজার চেতনা প্রস্ফূটিত হয়ে শাসকের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দিক– তোমাদের এই অগণতান্ত্রিক অবৈজ্ঞানিক সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি আমরা মানি না। তাই আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর এআইডিএসও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ডাক দিয়েছে ছাত্র বিক্ষোভ মিছিলের।

প্রস্তুতি চলছে স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০, শিক্ষায় পিপিপি মডেল নীতি প্রত্যাহার, সকল শূন্যপদে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ, সকল ছাত্রের ভর্তি ও পর্যাপ্ত ক্লাসরুম এবং সুষ্ঠু পঠন-পাঠনের দাবিতে দার্জিলিংয়ের পাহাড় থেকে সাগরদ্বীপ সবখান থেকেই সেদিন বন্যার বেগে আছড়ে পড়বে ছাত্র প্রতিনিধিদের ঢেউ কলকাতার রাজপথে। রাজধানী শহর কলকাতা প্লাবিত হবে এই সময়ের পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদী ছাত্র জনতার অপ্রতিরোধ্য এক তরঙ্গে। ছাত্র সমাজের দাবি শিক্ষার অধিকার আমরা ছাড়ব না, ‘টাকা যার শিক্ষা তার’– এই সর্বনাশা নীতি রুখবই। এ লড়াই সকলের, সমস্ত খেটে-খাওয়া মানুষের।