জাতীয় শিক্ষানীতি ডেকে আনবে  শিক্ষার মারাত্মক বিপর্যয়

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসেই বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর তড়িঘড়ি খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি–২০১৯ নামে একটি দলিল প্রকাশ করেছে৷ খসড়াটি প্রকাশ হওয়ার পরেপরেই গোটা দেশজুড়ে বিদ্যালয় স্তরে ত্রি–ভাষা নীতির মাধ্যমে অ–হিন্দিভাষী রাজ্যে জোর করে হিন্দি চাপানোর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হয়৷ তখনই বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার খসড়া নীতির এই অংশটি প্রত্যাহার করে৷ কিন্তু প্রত্যাহার করলেও অতীতের কংগ্রেস সরকারের মতোই বর্তমান সরকারও যে দেশে হিন্দি চাপানোর নীতি নিয়েই চলছে তা পরিষ্কার৷

হিন্দির বিষয়টি চাপা পড়ে যেতেই সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে নীরব৷ কিন্তু এই শিক্ষানীতি যে শিক্ষা ধ্বংসের একটি মারাত্মক পরিকল্পনা সে বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কার্যত কোনও আলোচনা নেই৷ ভাষার চাতুরির মাধ্যমে ভাল ভাল কিছু কথা বলে আনা খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতির কিছু উল্লেখযোগ্য  বিষয় হল– (১) কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শিক্ষার ধারণাকে পদদলিত করা, (২) ভারতীয়ত্ব ও ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ ও গৈরিকীকরণ, (৩) পাশ–ফেল অবলুপ্তি সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান সর্বনাশা নীতিকেই চালু রাখা, (৪) মৌলিক শিক্ষার পরিবর্তে কর্মমুখী শিক্ষার উপর গুরুত্ব প্রদান, (৫) মূলধারার শিক্ষণ পদ্ধতির বিপরীতে দূর ও অনলাইন শিক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলন (৬) দশম শ্রেণির পরিবর্তে দ্বাদশ শ্রেণিতে মাধ্যমিক পরীক্ষা চালু করা ও স্কুল স্তরে সেমিস্টার প্রথা চালু করা, ৭) শিক্ষার বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ ও কর্পোরেটকরণ৷ খসড়া শিক্ষানীতিটি প্রকাশের পর সরকার জানিয়েছিল, যদি এর উপর কেউ কোনও মতামত দিতে চান তাহলে তাঁকে এক মাসের মধ্যে তা করতে হবে৷প্রতিবাদের ফলে আরও এক মাস সময় দিয়েছে৷ কিন্তু ৪৮০ পাতার নথি পড়ে তার উপর এত দ্রুত লিখিত মিতামত দেওয়া এক মাসের মধ্যে কি সম্ভব?

শিক্ষক–শিক্ষাবিদ–ছাত্র ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলির মতামত গ্রহণ

যে কোনও শিক্ষানীতি প্রণয়নের আগে অবশ্য পালনীয় পূর্বশর্তটি হল মতাদর্শ নির্বিশেষে সর্বস্তরের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, ছাত্র এবং তাদের সংগঠনগুলির মতামত গ্রহণ করা৷ তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করে, তাঁদের মতামত না গ্রহণ করে কোনও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার অর্থই হল গণতান্ত্রিকতা বিসর্জন দিয়ে আমলাতান্ত্রিকতার শিকার হওয়া৷

পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রী প্রকাশ জাভডেকর খসড়া নীতির মুখবন্ধে দাবি করেছেন, ২০১৫ সাল থেকে তাঁর সরকার বহু দিক থেকে নানা ভাবধারার মানুষের মতামত সংগ্রহ করেছে৷ তাঁর বক্তব্য, কস্তুরিরঙ্গনের নেতৃত্বে যে কমিটি এই খসড়া প্রস্তুত করেছে তারা ৭৪টি সংস্থা ও ২১৭ জন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করেছে৷ কারা এই ৭৪টি সংস্থা? যে তালিকা তাঁরা দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরও আছে৷ আর আছে নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান৷ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আছে কিন্তু তুলনায় তা খুবই নগণ্য৷ ছাত্রসংগঠনগুলির মধ্যে কেবলমাত্র বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের মত নিয়েছে৷ আরএসএস ঘনিষ্ঠ এবং আধুনিক শিক্ষার বিরোধী ‘ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল’, তারাও এই তালিকায় আছে৷ যে ২১৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতামত তাঁরা নিয়েছেন তাঁরা মূলত সরকারি অফিসার অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করেন৷

শিক্ষার অধিকার আইন, স্কুল–ছুট ও পাশ–ফেল অবলুপ্তি

শিক্ষানীতির প্রণেতারা মেনে নিয়েছেন যে, ‘নানা সরকারি ও বেসরকারি সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা গেছে দেশে ৫ কোটি পডুয়ার বুনিয়াদী অক্ষর ও সংখ্যা জ্ঞান হয়নি’ (শিখন নীতির নথি, পৃঃ ৫৬)৷ পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার সময় যে কুযুক্তিগুলি করা হয়েছিল তার অন্যতম ছিল,  পরীক্ষা ভীতির কারণে স্কুল–ছুটের সংখ্যা বাড়ছে৷ ২০০৯–এ শিক্ষার অধিকার আইন চালু হওয়ার ১৫ বছর পর অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়েছে? নথিটিতে বলা হয়েছে, ‘২০১৫ তে ৬–১৮ বছরের পডুয়াদের ৬.২ কোটি স্কুলের গণ্ডির বাইরে চলে গেছে’৷ ‘৫ম ও ৮ম শ্রেণির পডুয়ারা অক্ষর বা সংখ্যা চিনতে পারে না’ ( ওই,পৃঃ ৬৫)৷ এত কথা জানার পরও শিক্ষানীতির প্রবক্তারা স্কুল শিক্ষার এই দুরবস্থার জন্য পাশ–ফেল অবলুপ্তিই যে অন্যতম কারণ, তা উল্লেখ করেননি৷

স্কুল স্তরে আরও একটি বিপজ্জনক প্রস্তাব তাঁরা করেছেন৷ বর্তমান ব্যবস্থায় দশম শ্রেণির পর মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়৷ এই সার্টিফিকেট নিয়ে বহু গরিব পরিবারের সন্তানরা জীবিকার সন্ধানে নেমে  পড়েন৷ এখন এই সার্টিফিকেট পেতে গেলে তাঁদের আরও ২ বছর অপেক্ষা করতে হবে৷ কারণ মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে দ্বাদশ শ্রেণির পর৷ ফলে গরিব–নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা বেশ অসুবিধার মধ্যে পডবেন৷ আবার এই  স্কুল স্তরে সেমেস্টার প্রথা চালু হচ্ছে যা শিক্ষার ভিতকেই নড়বড়ে করে দেবে৷

শিক্ষার গৈরিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণের নীল নক্সা

বর্তমান শিক্ষানীতিতে পঞ্চতন্ত্র, জাতক, হিতোপদেশের গল্পকে তাঁরা স্কুল পাঠ্য করতে চেয়েছেন (ওই, পৃঃ ৯৮), পুরাণের ৬৪ কলার চর্চা করতে বলেছেন (ওই পৃঃ ২০৭), সংস্কৃত শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন অথচ ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্বহীন করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, (ওই, পৃঃ ৮৭)৷ আরএসএস–এর দাবিতে বৈদিক গণিতও চালু হতে চলেছে৷ ডাক্তারি বিদ্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে, আয়ুর্বেদ, নেচারোপ্যাথি, যোগা, ইউনানি, সিদ্ধা প্রভৃতি মূল ধারার মেডিকেল শিক্ষায় যুক্ত হবে৷ পাঠ্যতালিকায় বহু ব্যক্তির জীবনী চর্চার উল্লেখ আছে, কিন্তু সেই তালিকায় ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ এবং এদেশে প্রথম ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে আধুনিক শিক্ষা প্রচলনের জনক রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের নাম সযত্নে বাদ দেওয়া হয়েছে (ওই, পৃঃ ৯৮)৷ পাঠ্যবস্তুকে এমনভাবে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা হয়েছে যাতে কিশোর মনে আরএসএস ও সংঘ পরিবারের অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ছাপ পড়ে৷ এই শিক্ষানীতির কেন্দ্রবিন্দুই হল মধ্যযুগীয় বাতিল চিন্তা ভাবনা ফিরিয়ে আনা৷ এটা কি সমাজ প্রগতির বিপরীতমুখী যাত্রা নয়? অন্যদিকে তাঁদের লক্ষ্যবস্তু কেবল পডুয়ারাই নয় শিক্ষকরাও৷ তাই শিক্ষানীতিতে বি এড তথা শিক্ষণ–শিক্ষার উপর নজিরবিহীন জোর দেওয়া হয়েছে৷ বলা  হয়েছে ‘শিক্ষণ–শিক্ষা উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকবে’ (ওই, চ্যাপ্টার ১৫)৷ অতীতে কোনও শিক্ষানীতিতে এত বিএড ডিগ্রি, বিএড কলেজ, ইন্টিগ্রেডেড বিএড এসব কথা ছিল না৷

শিক্ষার ব্যবসায়ীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ এবং শিক্ষা সংকোচনের সার্বিক পরিকল্পনা

যতদিন যাচ্ছে বেসরকারি (পড়ুন ব্যবসায়িক) স্কুল, সাধারণ ডিগ্রি কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ম্যানেজমেন্ট কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়ছে৷ এগুলি যাতে রমরমিয়ে চলে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলি তার যাবতীয় সুবন্দোবস্ত করে দিচ্ছে৷ গডপডতা সরকার পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির যা চেহারা, পরিকাঠামোর যা দৈন্য দশা, শিক্ষার যা মান, পঠন–পাঠনের যা হাল তাতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত তো বটেই, এমনকি নিম্নবিত্তরাও কষ্ট করে তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে আকাশছোঁয়া বেতন সত্ত্বেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটছেন৷ সরকার পরিচালিত স্কুল–কলেজে শিক্ষার মানের অবনমন ঘটাতে পারলেই ঝাঁ চকচকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি অভিভাবকদের আকর্ষণ বাড়বে৷ পশ্চিমবঙ্গেও সরকার পোষিত বহু স্কুলে ছাত্র সংখ্যা অনেকদিন ধরে নিম্নগামী৷ কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালিত বহু প্রাইমারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্রাভাবে৷ এর ফলে সরকারের নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা ও তা পরিচালনা করার খরচ কমছে৷ বেসরকারিকরণের এমনই এক অদ্ভুত পন্থা নিয়ে সমস্ত সরকারই চলছে৷ খসড়া শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, মালিকরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যত খুশি খুলুক৷ কিন্তু খুলতে হবে ‘মানব কল্যাণের’ উদ্দেশ্যে৷ পুঁজিবাদের এই যুগে মালিক মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে এটাও তারা আজ মানুষকে বিশ্বাস করতে বলছে!

খসড়া শিক্ষানীতিতে শিক্ষা বিকাশের জন্য সুপারিশ অনেক থাকলেও তার জন্য অর্থ বরাদ্দ যথেষ্ট নয়৷ শিক্ষাবিদদের বহুদিনের দাবি, বাজেটের ১০ শতাংশ বা মোট উৎপাদনের ৬ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে হবে, কোনও সরকারই এটা মানেনি৷ অন্যদিকে ২০০ টি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে এদেশে ক্যাম্পাস খোলার অনুমতির কথা বলা হচ্ছে৷ ফলে সব মিলিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রটিকে দেশি–বিদেশি পুঁজির মুনাফা লোটার বাজার করে দেওয়ার ব্যবস্থাই হয়েছে এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে৷

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হবে

একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিক্ষা পরিচালনার মূল বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার৷ মোদি সরকারের  খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার এই মৌলিক নীতিটিকেই অগ্রাহ্য করেছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে ‘গভর্নিং বোর্ড’, কিন্তু তা নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা গঠিত হবে না৷ তার সকল সদস্যই হবেন সরকার মনোনীত৷ এই মনোনয়নের জন্য যে পদ্ধতি প্রস্তাব করা হয়েছে তা খুবই গোলমেলে৷ বলা হয়েছে, (১) ‘খুব যত্ন সহকারে মনোনীত ব্যক্তি’, (২) ‘অত্যন্ত দক্ষতা সম্পন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তি’, (৩)‘সমাজের খ্যাতনামা ব্যক্তি’ – এঁরাই হবেন বিশ্ববিদ্যালয় ‘গভর্নিং বোর্ডের’ সদস্য৷ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন এমন নামদার ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কী সম্পর্ক রয়েছে? তা ছাড়া স্বনামধন্য, খ্যাতনামা ব্যক্তি সরকারের সমালোচক হলে বোর্ডে মনোনীত হওয়ার কতটুকু সম্ভাবনা থাকছে?

গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই শাসক দলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে চাওয়া হয়েছে৷ পেশাগত শিক্ষা সমেত সামগ্রিকভাবে উচ্চশিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি নতুন সংস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার নাম হবে ‘ন্যাশানাল হায়ার এডুকেশন রেগুলেটরি অথরিটি’ (এনএইচই আরএ)৷ দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ দেশে একদা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার জন্য অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন, আইন শিক্ষার জন্য বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া, ডাক্তারি শিক্ষার জন্য মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল ওই সমস্ত পেশাগত শিক্ষার মান নিয়মমাফিক করার উদ্দেশ্যে৷ বিধিবদ্ধ এই সংস্থাগুলি দীর্ঘ ঐতিহ্য সম্পন্ন৷ এই সমস্ত সংস্থাগুলিকে মিলিয়ে একটি নতুন সংস্থা গঠনের কথা তারা বলছে৷ স্বাধীনতার পরে একটি স্বশাসিত সংস্থা হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউ জি সি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল দেশজুড়ে উচ্চশিক্ষার মানের একটা সমতা প্রদান ও তার জন্য অর্থ মঞ্জুরি করার উদ্দেশ্যে৷ যতদিন গেছে স্বশাসনের তোয়াক্কা না করে কংগ্রেস থেকে শুরু করে কেন্দ্রের সমস্ত শাসক দল নিজের প্রয়োজনে তার অপব্যবহার করেছে৷ গত পাঁচ বছরে এই অপব্যবহার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ একটা সময় তাকে তুলে দেওয়ার চেষ্টাও বিজেপি করেছে৷ এই শিক্ষানীতি ইউ জি সি–র নাম পরিবর্তন করে তাকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে দিচ্ছে৷ মেডিকেল কাউন্সিল বিল সম্প্রতি পাশ করিয়ে এম সি আই তুলে দিচ্ছে এবং পাশ করার পর রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার আগে ছাত্রদের আর একটি সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করেছে৷ এসব করার একটাই উদ্দেশ্য– সমগ্র উচ্চশিক্ষাকে একটা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে রাখা, আর সেই উদ্দেশ্যেই ‘এনএইচইআরএ’ গড়ে তুলছে৷

এই ‘এনএইচইআরএ’–র মাথার উপর থাকবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি নয়া সংস্থা যার নাম হবে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ (আরএসএ)৷ এই সংস্থার উপর বিদ্যালয় শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা তথা সমগ্র শিক্ষার ভার অর্পিত হবে৷ ‘আরএসএ’–র চেয়ারপার্সন হবেন প্রধানমন্ত্রী নিজে, ভাইস চেয়ারপার্সন হবেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী (উল্লেখ্য, বর্তমান কেন্দ্রীয় ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’টি পরিবর্তিত হয়ে হবে ‘শিক্ষা মন্ত্রক’)৷ এছাড়া ‘আরএসএ’–তে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, ক্যাবিনেট সচিব, নানা দপ্তরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, পালা করে থাকবেন কিছু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী৷ ‘সযত্ন মনোনীত’ কয়েকজন শিক্ষাবিদও থাকবেন শিক্ষা নিয়ন্ত্রক ওই সর্বোচ্চ সংস্থায়৷ যে কমিটির মাথায় থাকবেন প্রধানমন্ত্রী নিজে, সেই কমিটির অন্য সদস্যদের কোনও সরকার বিরোধী কথা বলার ক্ষমতা থাকবে? অর্থাৎ দেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাটি নিয়ন্ত্রণ করবেন প্রধানমন্ত্রী নিজে৷ এমনকি  উচ্চশিক্ষায় রাজ্য সরকারগুলোর কথা বলার কোনও জায়গা থাকবে না৷ যদিও সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা যুগ্ম তালিকা ভুক্ত এবং উচ্চশিক্ষার মূল আর্থিক দায়িত্ব রাজ্য সরকারগুলিই বহন করে, কেন্দ্রীয় সরকারের অবদান যৎসামান্য৷ খসড়া নীতির এই সুপারিশ সংবিধান বিরোধী৷ আবার রাজ্য সরকারগুলির হাতে কিছু রাখা হয়নি তা নয়৷ আরএসএ–র মতো একটি সংস্থা থাকবে রাজ্য স্তরে যার মাথায় থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী, যে সংস্থা স্কুল স্তরের শিক্ষার নিয়ামক হবে৷ ফলে প্রধানমন্ত্রী হবেন উচ্চশিক্ষা সমেত গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক, আর স্কুল শিক্ষায় ছড়ি ঘোরাবেন মুখ্যমন্ত্রীরা৷ ক্ষমতা ভাগের এ এক নয়া দৃষ্টান্ত৷

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকার তথা শাসক দলের হাতে কুক্ষিগত করা শুধু নয় কেন্দ্রীকরণের এমন সুপরিকল্পিত ও নগ্ণ প্রয়াস অতীতের সমস্ত নজির ছাড়িয়ে গেছে৷ এটা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা না কি শিক্ষার সমস্ত কিছুকে শাসকদলের হাতে কেন্দ্রীভূত করা বিরোধী পক্ষকে লেজুড়ে পরিণত করাই উদ্দেশ্য৷ এই নীতির উদ্ভব আকস্মিক নয়৷ সুদীর্ঘ কংগ্রেসী শাসনকালে শিক্ষানীতির ধারাবাহিকতাতেই এর বনিয়াদ প্রতিষ্ঠা৷ বস্তুত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক ও সার্বজনীন শিক্ষার যে দাবির জন্য পরাধীনতার সময় থেকে রেনেসাঁসের যুগের মনীষীরা লড়াই করেছিলেন, স্বাধীনতার পর নানা দলের নেতৃত্বে যে সরকারগুলি ক্ষমতাসীন হয়েছে তারা তাকে কার্যকরি করার পরিবর্তে ঠিক বিপরীত কাজটি করে এসেছে৷ পুঁজিবাদ যত সংকটগ্রস্ত হয়েছে অবাধ ও মুক্ত জ্ঞানচর্চা এবং গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য তাদের বিসর্জন দিতে হয়েছে৷ নানা বাকচাতুরির আড়ালে সরকারগুলি শিক্ষা সংকোচনের পথে হাঁটছে৷ শাসক শ্রেণির নৈতিকতা ও শাসিতদের নৈতিকতা যখন এক হয়ে যায় তখনই একটা জাতির সর্বনাশ হয়৷ ইতিহাসে তার সাক্ষ্য কিছু কম নেই৷ বিজেপির নতুন শিক্ষানীতির এই সর্বনাশকে প্রতিহত করার দায়িত্ব আজ তাই দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকেই নিতে হবে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৫ সংখ্যা)