Breaking News

জলসংকট : সাধারণ মানুষের সর্বনাশ, ব্যবসায়ীদের পৌষমাস

নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান বছরে দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা প্রবল জলসংকটের সম্মুখীন৷ কিন্তু এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা কী? অন্যান্য বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও সরকার এই প্রবল সমস্যার কথা স্বীকার করতে চাইছে না৷ তামিলনাডুর মন্ত্রী এস পি ভেলুমনিই হোক বা কেন্দ্রের জলসম্পদ মন্ত্রী গজেন্দ্র শেখাওয়াত– দু’জনেরই বক্তব্য এটা মিথ্যা সংবাদ, সংবাদমাধ্যম যতটা ভয়ঙ্কর বলছে বাস্তবে জলসংকট ততটা ভয়ানক নয়৷ কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের রিপোর্ট কি তাহলে ভুল?

বিশুদ্ধ জল পাওয়া মানুষের অধিকার

অন্য আর পাঁচটা প্রাকৃতিক সম্পদের মতো জলও দেশের জনগণের সম্পদ৷ ধনী–গরিব নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে পর্যাপ্ত পরিস্রুত পানীয় জল দেওয়াটা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব৷ বিশ্বের জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ বাস করে নদীমাতৃক দেশ ভারতবর্ষে৷ ১৯৪৭ সালে দেশে জনপ্রতি জল পাওয়া যেত ৬০৪২ ঘনমিটার৷ ২০১৮–তে তা কমে দাঁডিয়েছে জনপ্রতি ১৩৫৫ ঘনমিটারে৷ এক্ষেত্রে ভারতের থেকে এগিয়ে আছে নাইজেরিয়া এবং ইথিওপিয়ার মতো দেশও৷ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দূষিত জল খেতে বাধ্য হয়৷ এর ফলে প্রতি বছর দু লাখ মানুষ অর্থাৎ দিনে প্রায় ৫৪৭ জন পানীয় জলের সংকটে মারা যায় আর যদি এর সঙ্গে বায়ুদূষণ ধরা হয় তাহলে বছরে প্রায় ২৫ লক্ষ অর্থাৎ দিনে ৬৮৪৯ জন মানুষ মারা যায়৷ এই মৃত মানুষদের বেশিরভাগই গরিব নিম্নবিত্ত ঘরের৷ জলের গুণমান সূচকে বিশ্বে ১২২টি দেশের মধ্যে ভারত ১২০তম স্থানে৷ দেশে ৭২ শতাংশ রোগের কারণ বিশুদ্ধ জল সরবরাহে সরকারি ব্যর্থতা৷ আর সেই রোগের চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবসায়ীদের বছরে ১০ লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে৷ বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করলে এই ব্যবসার কী হবে? দুষ্টচক্রের চেহারাটি বুঝতে অসুবিধা হয় কি?

জলসংকটের কারণ কী

এই প্রবল জলসংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হল পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, জৈব বৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ধ্বংস সাধন৷ প্রধানমন্ত্রীর সাধের বুলেট ট্রেন চালানোর জন্য ৫৪ হাজার ম্যানগ্রোভ গাছ কাটা পড়বে৷ একটা বিশাল এলাকা বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে৷ পাটনায় সরকারি উদ্যোগে ৩৫ একর জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে এইমস৷ বর্তমানে খরা কবলিত দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের জলের ট্যাঙ্ক বলা হয় পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে৷ ঘন অরণ্য ঢাকা দক্ষিণ ভারতের সমস্ত নদী ঝরনার উৎসস্থল হল এই পর্বতমালা৷ সারা বছর প্রচুর বৃষ্টি৷ সেই বৃষ্টির জলকে ধরে রাখত পাহাড়ের মাথায় গায়ে অসংখ্য ছোট–বড় জলাশয় আর পাহাড়ের গর্ভের জলসঞ্চয়কারী শিলাস্তর৷ সেখানে টান পড়েছে৷ কেন? অবৈধ খনি, পর্যটন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে, যা থেকে জমি মাফিয়ারা কোটি কোটি টাকা লাভ করছে৷ সরকার কমিটির পর কমিটি বানিয়ে উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধবংসকারী এই কুকর্মকে সিলমোহর দিয়েছে৷ তামিলনাড়ুতে চেন্নাই উন্নয়নের নামে জলাশয়গুলো বুজিয়ে, নদীর জমি দখল করে হয়েছে কংক্রিটের জঙ্গল৷ এমনকি ফ্লাড বেসিন দখল করে তৈরি হয়েছে বিমানবন্দর৷ গত মাত্র এক দশকে এর ফলে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা লাভ করেছে দু’লক্ষ কোটি টাকা আর সাধারণ মানুষ পেয়েছে দূষিত বায়ু, জল সংকট৷ এভাবেই উন্নয়নের নামে লুট হয়ে গেছে লাখো লাখো জলাশয়, সাফ হয়ে গেছে বনভূমি৷

জলের অপচয় বন্ধে সরকার উদাসীন

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু ৪০ লিটার জল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ এবারে প্রতিশ্রুতি ২০২৪ সালের মধ্যে সব ঘরে ‘নল সে পানি’৷ জল কোথায় যে দেবেন! কিন্তু ভারতের মতো নদীবহুল এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে এরকম জলসংকট কেন? ১৯০ কোটি ঘনমিটার ক্ষমতাসম্পন্ন নদ–নদীর মাত্র ৭০ হাজার ঘনমিটার জল আমরা ব্যবহার করি, বাকিটা চলে যায় সমুদ্রে৷ কেন্দ্রীয় কমিশনের একটি রিপোর্ট বলছে, ভারতবর্ষের জলের প্রয়োজন ৩০০০ বিলিয়ন ঘন মিটার আর প্রতি বছর বৃষ্টির মাধ্যমে ভারত জল পায় ৪০০০ বিলিয়ন ঘনমিটার৷ ৬৫ শতাংশ বৃষ্টির জল সমুদ্রে চলে যায়, কাজে লাগে না৷ ভারতে মাটির উপরে থাকা জলের মাত্র ২৮ শতাংশ ব্যবহার হয়, বাকিটা দূষিত জল৷ স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও জল ব্যবহারের পরিকল্পনা সরকারের নেই কেন?

উদারিকরণ দেশের জল ভাণ্ডারকে ব্যক্তিপুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দিল

উদারীকরণের আর্থিক নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের মতো জলসম্পদের ভাণ্ডারও লুটে নেওয়ার জন্য শুরু হল বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া৷ ২০০২–এ বিজেপির আমলে জাতীয় জলনীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয় ২০১২ সালে কংগ্রেস তা সম্পূর্ণ করে দেশের জলভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করে দেয় ব্যক্তিপুঁজির জন্য৷ মুনাফার গন্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশি–বিদেশি পুঁজিপতিরা৷ সকলকে বিনামূল্যে পানীয় জল সরবরাহের গুরু দায়িত্ব থেকে ধীরে ধীরে সরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার৷ মানুষ ক্রমাগত হারাতে থাকে জল সম্পদের উপর তার ন্যায্য অধিকার৷ ভারতে একদিকে চাষের জল, পানীয় জল, বাডিতে ব্যবহারের জল কমছে আর অন্যদিকে জলের নানা ধরনের ব্যবসা বাড়ছে৷ ভারতে জলের সংকটের অন্যতম তিনটি কারণ (১) ক্যাশক্রপ ইন্ডাস্ট্রি, (২) বোরওয়েল ইন্ডাস্ট্রি, (৩) ওয়াটার ট্যাঙ্কার৷ ভারতে মোট জলের ৮০ শতাংশ যায় কৃষি ক্ষেত্রে৷ সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষিতে এমন বীজ সার কীটনাশক ব্যবহার শুরু হল যাতে জল লাগল অনেক বেশি৷ ভারতের সেচ ব্যবস্থায় ড্রিপ সেচ, আর স্প্রিংকল সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে চাষ হয় যথাক্রমে মাত্র ৩.৩৭ শতাংশ আর ৪.৩৬ শতাংশ জমিতে, বাকিটা সবই মাইক্রো সেচ পদ্ধতিতে, যাতে জলের খরচ হয় বেশি৷ যত পারো জল টানো মাটির তলা থেকে৷ যদি প্রথম দু’টি পদ্ধতিতে চাষ হত তা হলে ৪০–৬০ শতাংশ জল বেঁচে যেত৷ কিন্তু তা হচ্ছে না৷ কেন? সরকারের টাকা নেই৷ ২০১৯–এর লোকসভা ভোটে দলগুলির নিজস্ব খরচ ৬০ হাজার কোটি টাকা যা ২০১৪ সালের তুলনায় দ্বিগুণ৷ এই দুই সালে নির্বাচনে খরচ হওয়া মোট অর্থ যদি সেচ ব্যবস্থার কাজে লাগানো যেত তা হলে কৃষি ক্ষেত্রে খরচ হওয়া জলের ৬০ শতাংশ আমরা বাঁচাতে পারতাম৷ কিন্তু রাষ্ট্রনায়করা শুধু তা ভাবেন না তাই নয়, তাঁরা খাদ্যশস্য চাষ ছেড়ে আখ ও বাদামের চাষে উৎসাহিত করার জন্য লোন দিচ্ছেন৷ কেন? এতে কর্পোরেটদের লাভ বেশি৷ কোল্ড ড্রিংকস কোম্পানিতে চিনির প্রচুর চাহিদা৷ কিন্তু এক একর আখ চাষে বছরে জল লাগে একশো আশি লক্ষ লিটার যা খাদ্যশস্য ফলনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি৷ শুধুমাত্র কর্পোরেটের লাভের জন্য কত জল সরকার নষ্ট হতে দিচ্ছে!

গ্রামের কৃষকদের সমস্যা হল তাদের জল চলে যাচ্ছে শহরে৷ দু’টি মার্কিন সফট ড্রিংকস কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে অবাধে মাটির ভেতর থেকে জল নিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া সহ বহু প্রদেশে এই কোম্পানিগুলিকে মাটি খুঁড়ে জল নিতে দেওয়া হয় না৷ সেখানে তা নিষিদ্ধ অথচ ভারতে তা আইনসিদ্ধ ৷ সাধারণ মানুষ যে পয়সা দিয়ে জল কেনে তার থেকে অনেক সস্তা দরে সরকার ওই সমস্ত জল ব্যবসায়ীদের দিচ্ছে৷ জনসাধারণ ১ লিটার জল কেনে ২০ টাকায়৷ কোম্পানিগুলি পায় প্রতি লিটার ২০–২৫ পয়সায়৷ শুধুমাত্র কোকাকোলা কোম্পানির একটি কারখানায় দৈনিক ৫ লক্ষ লিটার জল লাগে৷ দেশে এই কোম্পানির ৫৮টি কারখানা৷ এর সঙ্গে অন্য সফট ও কোল্ড ড্রিংক্সের কোম্পানিকে নিয়ে হিসাব করলে কত জল নষ্ট হচ্ছে তা ভাবলে চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হবে৷ এটাই সব নয়, এই বহুজাতিকরা যে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য এদেশে রেখে যায় তা প্রতিটি কারখানার ৩ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে সমস্ত জলের উৎসকে দূষিত করে৷

শুধু সফট ড্রিংক্স নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হবে বোতলবন্দি জলের রমরমা ব্যবসা, যার পরিমাণ সফট ড্রিংক্সের ব্যবসার দ্বিগুণ৷ জলসংকট বাড়ছে, পাশাপাশি বোতলবন্দি জলের ব্যবসা প্রতি বছর ২০ শতাংশ করে বাড়ছে৷ ভারতে ৫৭৩৫টি লাইসেন্স প্রাপ্ত জলের ব্র্যান্ড রয়েছে৷ আর শুধু দিল্লি–গুরগাঁও নয়ডাতেই লাইসেন্স বিহীন ৩০০০ পানীয় জলের কোম্পানি৷ তা হলে সমগ্র দেশে সংখ্যাটা কত? যেখানে সর্বত্র জলের জন্য হাহাকার সেখানে দেশের সম্পদ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে কোম্পানিগুলি এই জল পাচ্ছে কী করে? কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চলছে৷ গত বছর এই ক্ষেত্রে ১৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে৷ দেশের গ্রামাঞ্চলে মাটি খুঁড়ে জলস্তর ধবংস করে জল চুরি করে সেটাই আবার বোতলবন্দি করে চড়া দামে বিক্রি হয়৷ ১ লিটার জলের ৬৬ শতাংশ ব্যবহার হয় বোতলবন্দি জল তৈরি করতে৷ বাকিটা নষ্ট৷ যদি সরকার বিশুদ্ধ পানীয় জল দেবার ব্যবস্থা করত তাহলে এই ব্যবসার এত রমরমা হত কি? আমরা জানি, শিল্পপতিদের স্বার্থে পরিচালিত কোনও সরকারই এই ব্যবসা বন্ধে উদ্যোগী হবে না যদি না জনগণ বিশুদ্ধ পানীয় জল সরকারকে দিতে হবে এই দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত না করে৷

এরপর বোরওয়েল৷ ঝাড়খন্ড থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, জম্মু থেকে মিজোরাম হাজার হাজার বোরওয়েল এবং ট্যাঙ্কার৷ প্রতিটি শহরে হাজার হাজার ট্যাঙ্কার৷ শহরের বাইরে গিয়ে সরকারি দপ্তর আর নিয়মকে বু‍‍ড়ো আঙুল দেখিয়ে বোরওয়েল বসিয়ে মাটির পানীয় জল তুলে নিচ্ছে৷ তারপর তা চড়া দামে বিক্রি করছে৷ না খাবার জল হিসাবে নয়, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়৷

আগামী দিন গরিব মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর

বস্তুত আমাদের চোখের আড়ালে ভারতে তৈরি হয়েছে নতুন এক অর্থনীতি, জল নিয়ে৷ মাটি থেকে সব জল দিনে দুপুরে ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে আর ‘চৌকিদার’রা চোখ বুজে আছে৷ চাষের জমি জল পাচ্ছে না, গ্রামের মানুষ জল পাচ্ছে না, বস্তিবাসী জল পাচ্ছে না, মধ্যবিত্ত জল পাচ্ছে না৷ জল চলে যাচ্ছে মুনাফাখোরদের দখলে৷ সরকারি নীতি আয়োগ সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেছে, আসতে চলেছে জল–দুর্ভিক্ষ৷ আগামী দিনে পর্যাপ্ত জল পাবে শুধু ধনীরা৷ আর গরিব খেটে–খাওয়া মেহনতি মানুষকে তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনে জলটুকু পেতে গেলে গড়ে তুলতে হবে মুনাফালোভী এবং পরিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়নের এই মডেলের বিরুদ্ধে, জলের ব্যবসা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন৷ তা না হলে আগামী দিন গরিব মানুষের কাছে সত্যিই ভয়ঙ্কর৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২ সংখ্যা)