জনস্বার্থ রক্ষায় রেল বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে  চাই ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলন

পাটনা

রেলকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল বিজেপি সরকার

জনস্বার্থ রক্ষায় চাই ব্যাপক প্রতিরোধ

রেলকে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজে বড় মাপের পদক্ষেপ নিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ এক ধাক্কায় ১৫১টি রুটের দূরপাল্লার ট্রেনকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দ্রুত কার্যকর করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে সরকার৷ এর মধ্যে এ রাজ্যের ১৫টি রুটের দূরপাল্লার ট্রেন রয়েছে৷

মোদি সরকার ২০১৪–তে ক্ষমতায় বসেই রেলকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ভাঁজতে শুরু করেছিল৷ রেলের ১৭টি ক্ষেত্র একশো শতাংশ বিদেশি লগ্নির জন্য খুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল৷ এর মধ্যে রয়েছে বুলেট ট্রেন, হাই স্পিড করিডর, বিশ্বমানের স্টেশন, পণ্যবাহী করিডর, যাত্রী নিরাপত্তার ক্ষেত্রগুলি৷

এ বছর বাজেটের পর নীতি আয়োগ ও রেলমন্ত্রক ঘোষণা করেছিল ৫০টি রেল স্টেশন, ১৫১টি দূরপাল্লার ট্রেন, আন্তঃশহর এক্সপ্রেস (ইন্টারসিটি) ও কলকাতা, চেন্নাই, মুম্বাই, সেকেন্দ্রাবাদের লোকাল ট্রেন তারা কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেবে৷ গত বছর প্রথম লখনৌ–দিল্লি বিলাসবহুল বেসরকারি ‘তেজস এক্সপ্রেস’ চালু হয়েছে৷ বেসরকারি তেজস সময় নেয় সাডে ছ’ঘন্টা, আর ওই একই পথে শতাব্দী এক্সপ্রেস সময় নেয় ৫ মিনিট বেশি৷ সেজন্য তেজসের পথ মসৃণ করতে গোমতী এক্সপ্রেস তুলেই দেওয়া হয়েছে৷ বেসরকারি ট্রেনগুলি যাতে যথেষ্ট যাত্রী পায় ও দ্রুত ছুটতে পারে তার জন্য দেশ জুড়ে অন্তত শ’খানেক ধীর গতির ট্রেন বসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল৷ যার মধ্যে পূর্ব রেলেই রয়েছে ১৭ জোড়া ট্রেন৷ এমনকি বেসরকারি ট্রেন ছাড়ার ১৫ মিনিট আগে ও পরে একই রুটের কোনও ট্রেন যাবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে সরকার৷ শুধু রেল রুট নয়, গত বছর বাজেটেই বিজেপি সরকার জানিয়ে দিয়েছিল, ৭টি গুরুত্বপূর্ণ রেল কারখানাকে কর্পোরেট কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হবে৷ ইতিমধ্যে চেন্নাইয়ের ঐতিহ্যপূর্ণ ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে রেল কোচ তৈরির দায়িত্ব কর্পোরেট পুঁজিপতিদের দেওয়ার পরিকল্পনা সরকার জানিয়ে দিয়েছে৷ এ ছাডাও আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম থেকে লাইন পাতা, বৈদ্যুতিকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি বেসরকারি কোম্পানিগুলির সাথে হাত মিলিয়ে পিপিপি মডেলে করা হবে বলে সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে৷ খাবার, সাফাই, টিকিট বিক্রি, ইন্টারনেট পরিষেবা– এসব বেসরকারি হাতে চলে গেছে অনেক আগেই৷

এই ব্যাপক বেসরকারিকরণের ফল যাত্রী এবং কর্মচারীদের উপর কী প্রভাব ফেলবে? টিকিটের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা যেহেতু বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তাই টিকিটের প্রকৃত দাম আর বেসরকারি সংস্থার লাভ মিলিয়ে টিকিটের যা দাম হবে তা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে৷ যাত্রী থেকে রেলকর্মী, কারও নিরাপত্তার দায়িত্বই আর সরকারের থাকবে না৷ প্রবীণ নাগরিক, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী, শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের ছাড় থাকবে না৷ ধাপে ধাপে সরকার সরকারি ট্রেন বন্ধ করে দিলে, বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ–তিনগুণ ভাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষকে যাতায়াত করতে হবে৷ দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ যারা প্রতিদিন জীবিকার প্রয়োজনে শহরে যান, লোকাল ট্রেনে গাদাগাদি করে তুলনামূলক কম ভাড়ায় যাতায়াত করেন, সস্তায় সবজি বিক্রি করেন, তাদের অবস্থা হয়ে উঠবে অসহনীয়৷ মানুষের রোজগার তলানিতে চলে যাবে৷ বাজার সঙ্কট আরও বাড়বে৷ অন্য দিকে লক্ষ লক্ষ রেল কর্মচারী ছাঁটাই হবেন৷ এই কর্মচারীরা তাঁদের বহু সংগ্রামে অর্জিত নানা সুবিধা ও অধিকারগুলি হারাবেন৷

বুঝতে অসুবিধা হয় না, রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির মতো রেল ব্যবস্থাকেও দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই বিজেপি ক্ষমতায় বসার অনুমোদন আদায় করেছিল৷ ধাপে ধাপে সেই প্রতিশ্রুতিই তারা রক্ষা করছে৷ অথচ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের মতো রেল–ব্যবস্থা এবং তার সমস্ত পরিকাঠামোই জনসাধারণের টাকায় গডে উঠেছে৷ তা ছাড়া দেশের সাধারণ মানুষের জন্য রেল একটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা৷ ন্যূনতম খরচে সেই পরিষেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে একটি নির্বাচিত সরকার দায়বদ্ধ৷ বিজেপি সরকার একের পর এক স্বৈরাচারী পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সেই বিষয়টিই ভুলিয়ে দিতে চাইছে৷ রেলের মতো একটি গণপরিষেবার এই বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তে দলটির শ্রেণিচরিত্রও দেশের সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই সব দলগুলি, তাদের পরিচালিত সরকারগুলি যতই নিজেদের গণতান্ত্রিক বলুক, জনসাধারণের স্বার্থরক্ষা দাবিদার বলে গলা ফাটাক, বাস্তবে তারা যে একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের হয়েই কাজ করে চলেছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল৷ বিজেপি সরকারের বেসরকারিকরণের এই চরম জনবিরোধী সিদ্ধান্ত দেশের জনগণকে এটাও বুঝতে সাহায্য করবে যে, যতই জনগণের ভোটে একটি সরকার নির্বাচিত হোক, সরকার আসলে কারা চালায়, কাদের নির্দেশ সরকারি নীতি ঠিক হয়৷

বিজেপি সরকারের এই মারাত্মক আক্রমণের গুরুত্ব বুঝে আজ দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষকে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে ব্যাপক আন্দোলন এবং দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য৷ এ ছাড়া বাঁচার অন্য কোনও রাস্তা নেই৷

Check Also

দেশে বামপন্থী দলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসনে লড়ছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)

১৫ এপ্রিল কলকাতায় দলের কেন্দ্রীয় দফতরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, …