জনসমুদ্রে উঠেছে জোয়ার

জনজোয়ারে ভাসল কলকাতার রাজপথ

১৩ নভেম্বর, ভেসে এল এক দৃপ্ত প্রশ্ন– জনজীবনের হাজারো সংকটের সমাধানের দাবিতে লাগাতার লড়াইয়ের ক্ষমতা আছে কার? পাশ–ফেল প্রথা নিয়ে এক ধাপ মাথা নিচু করেছে সরকার, এবার তা প্রথম শ্রেণি থেকেই ফিরিয়ে আনার লড়াইটা করবে কে? কার শক্তি আছে? এনআরসির মাধ্যমে নাগরিকদের জীবন নিয়ে যেন খেলা করতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার– কে রুখে দাঁড়াবে? মদ–মাদকের নেশায় শেষ হয়ে যাচ্ছে দেশের শত সহস্র ছাত্র যুবক, সরকারের মদের প্রসার নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে কে? কে পারে? এমএলএ–এমপি–মন্ত্রী নিয়ে ক্ষমতার মসনদে আসীন কিংবা তার জন্য ভোটের খেয়োখেয়িতে ব্যস্ত বড় বড় দল করতে পারবে এ কাজ? কলকাতার হেদুয়া পার্কের সামনে সমবেত হাজার হাজার মানুষের গর্জন ভেসে এল– না৷ সমাবেশ মঞ্চ থেকে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, তাহলে পারে কে? উত্তর এল– পারে একমাত্র কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা পাথেয় করে এগিয়ে চলা রাজনৈতিক দল এস ইউ সি আই (সি), আর তার সাথে পারে সচেতন জনগণ৷

এস ইউ সি আই (সি) ডাক দিয়েছিল কলকাতায় রাজ্য সরকারের সদর দপ্তর নবান্ন অভিযানের৷ একই দিনে শিলিগুড়িতে হয়েছে উত্তরকন্যা অভিযান৷ কলকাতার হেদুয়া পার্কের সামনে সংক্ষিপ্ত সভার পর দৃপ্ত মিছিল এগিয়ে চলে নবান্ন অভিমুখে৷ কলকাতার রাজপথে সে এক জনজোয়ার৷ ২৫ হাজারের বেশি মানুষের মুখর স্রোতের ঢেউ আন্দোলিত করেছে চারপাশে দাঁড়ানো আরও কয়েক হাজার মানুষের মনকে৷ তাই দীর্ঘ চল্লিশ–পঁয়তাল্লিশ মিনিট যখন চলেছে মিছিল, বিরক্তি দূরে থাক বারে বারে ভেসে এসেছে মন্তব্য– এই মিছিলটার খুব দরকার ছিল৷

হেদুয়া পার্কে জমায়েতের একাংশ

মিছিলের দাবি, সরকার তুমি অনেক সময় ব্যয় করেছ, আর নয়– পাশ–ফেল অবিলম্বে প্রথম শ্রেণি থেকেই ফেরাও৷ দাবি– বিহারের মতো পশ্চিমবঙ্গেও মদ নিষিদ্ধ করে দরিদ্র পরিবারগুলির শান্তি এবং হাজার হাজার নারীর সম্ভ্রম রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷ দাবি উঠেছে বেকার যুবকদের কাজ দাও, বন্ধ কল–কারখানা খোল, সার–বীজ–কীটনাশক, পেট্রলের দাম কমাও, চাষির ফসলের লাভজনক দামের ব্যবস্থা কর, চা–শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরি দাও, বিদ্যুতের দাম অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ কমাও, রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি কমানো চলবে না, চিটফান্ডে প্রতারিতদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা কর৷ নাগরিকত্ব হরণের চক্রান্ত এনআরসি বাতিল কর৷

হেদুয়ায় শুরু হয়ে মিছিল বিবেকানন্দ মোড় পেরিয়ে, বিধান সরণি হয়ে কলেজ স্ট্রিটে ঢুকতেই স্থানীয় বাসিন্দা, বই ব্যবসায়ী এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সহ আরও অনেকে এগিয়ে এসেছেন, নেতৃবৃন্দকে ফুল দিয়ে, মালা পরিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন পাশ–ফেল ফেরানোর আন্দোলনে জয়ের জন্য৷ সারা রাস্তা থেকে এসেছে মিছিলের পাশে দাঁড়ানো মানুষের সমর্থনের সুর৷ মিছিলে হাঁটা মানুষগুলিও নিছক হাঁটছে না, এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে৷ তাদের চোখ–মুখের উজ্জ্বলতায় তার সাক্ষ্য৷ পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার মাইসোরা অঞ্চলের শেখ মোজাফফর হোসেন বৃদ্ধ বয়সেও সোচ্চার স্লোগান দিতে দিতে চলেছেন৷ কেমন লাগছে? এল এক অসাধারণ উত্তর, এখানে এসে ‘কুজা থেকে সোজা হয়ে গেছি’৷ ’৬৭ সাল থেকে বহুদিন সিপিএম করেছেন, ‘নীতির জন্য লড়াই আমার, তাই ওদের ত্যাগ করে এই মিছিলে আমি’৷ বললেন, ‘জালেমের (অত্যাচারীর) বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ জাগ্রত জীবনের লড়াই চলবে৷ যতদিন লাগে লড়তে হবে৷ থামা চলবে না’৷ ডিগডিগে রোগা শরীরে মাথায় একটা ভারি ব্যাগ, তাও হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছেন পুরুলিয়ার চাটুমাদারের গৈরি মাহাতো৷ স্বামী তৃণমূলের নেতা, বাড়িতে ফিরে অশান্তি হতে পারে৷ কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই– যা ঠিক তা করতে হবেই৷ বাঁকুড়ার সারেঙ্গার তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সদস্যের ঘরের ছেলেরাও মিছিলে৷ বাসন্তীর নির্মাণ কর্মীরা, কুলতলির মৎস্যজীবী, হাওড়ার শ্যামপুরের মিড ডে মিল কর্মী, নদীয়ার আশা কর্মী, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার আইসিডিএস কর্মী, সারা রাজ্যের কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, উকিল ডাক্তার শিক্ষক, ছাত্র–যুব, গৃহবধূ– কে নেই মিছিলে বাঁকুড়া জেলার বেশ কিছু জন, পরিচারিকার কাজ করেন তাঁরা এসেছেন শিশু কোলে নিয়ে৷ কেন মিছিলে জানতে চাইলে বললেন, এই দল আমাদের পাশে সবসময় থাকে৷ আর মহিলাদের দাবি নিয়ে তো এরাই লড়াই করে৷ আমরা তাই কাজ থেকে ছুটি নিয়ে রাত জেগে ট্রেনে চেপে এখানে এসেছি৷ হরিহরপাড়ার রিয়া সরকার, অন্নপূর্ণা পালমণ্ডলরা চান মুর্শিদাবাদ জেলায় মদের রমরমা, নারী পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই৷ হরিহরপাড়ারই লালন বানু, আসানারা বেগমরা এন আর সি–র মাধ্যমে দেশ থেকে মানুষ উৎখাত করার বিজেপির রাজনীতির প্রতিবাদ জানাতেই মিছিলে যোগ দিয়েছেন৷ তাঁরা পেশায় বিড়ি শ্রমিক৷ ১০০০ বিড়ি প্রতি ১০৫ টাকা রোজগার করে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন৷ তাই শ্রমিক সংগঠন এ আই ইউ টি ইউ সি অনুমোদিত বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে৷ মিছিলে হাঁটতে গিয়ে খোঁড়াচ্ছেন দেখে এক স্বেচ্ছাসেবক জিজ্ঞাসা করেছেন এক বয়স্ক মানুষকে, আপনি পারবেন হাঁটতে? দৃঢ়চেতা মানুষটির উত্তর– ‘আমাদের হয়ে কি অন্য কেউ হেঁটে দেবে? আমাকে পারতেই হবে’৷

হার মেনেছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও

রাস্তার মোড়ে মোড়ে আটকে আছেন বহু মানুষ৷ রাস্তা পার হতে তাঁদের দেরি হচ্ছে৷ কিন্তু অসন্তোষের লেশটুকুও নেই৷ বিধান সরণিতে দাঁড়ানো উমা গাঙ্গুলি তাই বলেন, এ মিছিল ন্যায্য মিছিল– এমন আরও হোক৷ বিবেকানন্দ রোডের মোড় পেরিয়ে বিধান সরণিতে এক দোকানের মালিক বলে উঠলেন, এটা যেমন তেমন মিছিল নয়, এক ব্যতিক্রমী মিছিল৷ হেয়ার স্কুলের ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রও তাই বলে– পাশ–ফেলের জন্য এই মিছিল খুব দরকার ছিল৷ আজকাল মিছিল মানেই যখন তাকে শুধু যানজট বলে চিহ্ণিত করে বড় বড় সংবাদমাধ্যম, তখন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে মিছিলের জেরে আটকে থাকা দোকানদার দেবকুমার বাবু বলছেন, আটকাক রাস্তা, হোক অসুবিধা, এই মিছিল আমাদের দরকার৷

নানা জেলা থেকে এসেছে সুসজ্জিত ট্যাবলো৷ মিছিলের সামনে নেতৃবৃন্দ, আছেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক কমরেড স্বপন ঘোষ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেডস অমিতাভ চ্যাটার্জী, শংকর ঘোষ, স্বপন ঘোষাল, মানব বেরা, অশোক সামন্ত, সুভাষ দাশগুপ্ত, ওড়িশা রাজ্য সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড ধূর্জটি দাশ সহ রাজ্য নেতৃবৃন্দ৷ হেদুয়া পার্কের সভায় বক্তব্য রাখেন কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, প্রাক্তন বিধায়ক এবং দলের রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড জয়কৃষ্ণ হালদার এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ৷ ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ বিধ্বস্ত এলাকার মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দাবিতে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়৷ পুলিশ সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের সামনে মিছিল আটকে দিলে সেখানেই শুরু হয় সভা৷ বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শঙ্কর ঘোষ, অমিতাভ চ্যাটার্জী এবং বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা ও রাজ্য কমিটির সদস্য এ এল গুপ্তা৷

কলেজ স্ট্রিট মোড়ে মিছিলকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে এলেন পুস্তক বিক্রেতা সমিতি, স্ট্রিট হকার্স অ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা৷

প্রায় দু’মাস ধরে রাজ্য জুড়ে এই মিছিলের জন্য চলেছে নিবিড় প্রচার৷ হয়েছে অসংখ্য পথসভা, হাটসভা, পাড়া বৈঠক৷ মানুষ শুধু শুনেছেন তাই নয়, সর্বতোভাবে সমর্থন করেছেন৷ মধ্য কলকাতার ৭০ নম্বর বস্তিতে মানুষ যেমন কর্মীদের হাত থেকে পোস্টার কেড়ে নিয়ে নিজেরা লাগিয়েছেন৷ কলকাতারই হরিণবাড়ি লেনের উর্দুভাষী মানুষ কর্মীদের রাত জেগে পোস্টার মারতে দেখে এগিয়ে এসেছেন, এলাকায় মিটিং করার জন্য অনুরোধ করেছেন৷ বারুইপুরের মানুষ বলেছেন, থেমো না, ১৩ তারিখের পর ১৪ তারিখেই এলাকায় এসে যোগাযোগ কোরো, আমরা বসব৷ হাওড়ার বালি ঘোষপাড়া বাজারের মানুষ সোচ্চারে বলেছেন– এগুলিই জনগণের দাবি৷ প্রচার দেখে বহু জায়গায় মহিলারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে এসে ডেকে নিয়ে গেছেন মদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য৷ পুরুলিয়ার আড়শায় এই প্রচার চলতে চলতেই প্রায় ৭০০ মহিলা মদ বিরোধী বিক্ষোভে সামিল হয়ে বিডিওতে ডেপুটেশন দিয়েছেন৷ মানুষ বলেছে এনআরসির সর্বনাশা পরিকল্পনা রুখতে এস ইউ সি আই (সি)–র বক্তব্য  সঠিক এবং অবস্থান বলিষ্ঠ৷ আন্দোলনে এরাই একমাত্র ভরসা৷

১৩ নভেম্বর তাই ডাক দিয়ে গেল আন্দোলনের এক নতুন ধাপের৷ এ আন্দোলন চলবে৷ আন্দোলন যেমন দাবি আদায়ের একমাত্র রাস্তা, একই সাথে আন্দোলনই শেখায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে৷ বাঁচিয়ে রাখে মনুষ্যত্বের দীপশিখা৷ দেখায় মুক্তিপথের দিশা৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৪ সংখ্যা)