জনগণের উপর আরও মাশুলের বোঝা চাপাবে বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী) বিল–২০২০

ফাইল চিত্র

দেশ জুড়ে করোনা অতিমারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে লকডাডন চলছে৷ কোনও সমাবেশ, গণবিক্ষোভ, গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা এই অবস্থায় সম্ভব নয়৷ এই পরিস্থিতির সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার চুপি চুপি চূড়ান্ত জনস্বার্থবিরোধী বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী) বিল, ২০২০ পাশ করিয়ে নিতে চাইছে৷ এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন (অ্যাবেকা)৷ সংক্ষিপ্ত আকারে এই বিলের কিছু ভয়াবহ দিক দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরা হল৷

১) লকডাডনের মধ্যে আচমকা বজ্রাঘাতের মতো গত ১৭ এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকার এই অত্যন্ত ভয়াবহ এবং চরম জনস্বার্থ বিরোধী বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী) বিল ২০২০–র প্রস্তাব অতি সন্তর্পণে হাজির করেছে৷

স্বাধীনতার পর বিদ্যুৎ আইন–১৯৪৮ এ ঘোষণা করা হয়েছিল বিদ্যুৎ একটি পরিষেবা৷ এখানে কোনও মুনাফা নেওয়া হবে না৷ ২০০৩ সালে পূর্বের আইন সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার নতুন বিদ্যুৎ আইন–২০০৩ চালুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে বেসরকারি পুঁজিপতিদের মুনাফা অর্জনের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করেছে৷ সমাজবিকাশের হাতিয়ার বিদ্যুৎকে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার পরিবর্তে কর্পোরেট বৃহৎ পুঁজির মালিকদের মুনাফা অর্জনের পণ্য হিসাবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত জারি করেছে৷ সরকারি বিদ্যুৎ পর্ষদ ভেঙে উৎপাদন, পরিবহন, বন্টন এই তিনটি কোম্পানি গঠন করে কমপক্ষে ১৬ শতাংশ নিশ্চিত মুনাফার ব্যবস্থা এটিতে করা হয়েছিল৷ এর ফলে উত্তরোত্তর ভয়ঙ্কর মাশুল বৃদ্ধি সর্বসাধারণের ঘাড়ে চেপে বসায় আজও চরম যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন গ্রাহকরা৷

২) বেসরকারি মালিকদের স্বার্থে বিদ্যুৎ আইনকে সংশোধন করার অপচেষ্টা চলে আসছে ২০১৪ সাল থেকে৷ ২০১৫ সালে অ্যাবেকার ডদ্যোগে দিল্লি অভিযানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রীকে বিদ্যুৎ আইন–২০০৩ ও তার প্রস্তাবিত সংশোধনী বাতিল করার দাবি জানানো হয়৷ কিন্তু তথাকথিত সংস্কারের নামে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের চেষ্টা চলতেই থাকে৷ এবার মোদি সরকার ২০২০–তে সংশোধনী হাজির করেছে৷ বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির সঙ্গে আবার ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি’ নামে নতুন একটি বাড়তি মুনাফা লোটার সংস্থা হাজির করেছে৷ এতে সরকারি বন্টন কোম্পানিগুলির জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বেসরকারি কোম্পানির প্রধান ভূমিকা ও নিয়ন্ত্রণ চালু হবে৷ চতুর্থ দফায় আরও মাশুলের বোঝা চাপবে জনগণের ঘাড়ের উপর৷

৩) ১৯৪৮ সালের আইনে তো বটেই, এমনকি ২০০৩–বিদ্যুৎ আইনের ৬২(৩) ধারায় বিভিন্ন ধরনের গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন হারে বিদ্যুৎ মাশুল (ডিফারেনসিয়েশন অফ ট্যারিফ) নির্ধারণের আইন আছে৷ একই ক্যাটেগরির গ্রাহকের কমবেশি ভোল্টেজের বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য, আলাদা ভৌগোলিক পরিবেশের জন্য, পাওয়ার ফ্যাক্টর ও বিদ্যুৎ ব্যবহারের উদ্দেশ্য বিচার করে আলাদা রেট (ট্যারিফ বেনিফিট) দেওয়ার ব্যবস্থা আইনে আছে৷ একটা সময়ে হঠাৎ করে ‘ক্রস সাবসিডি’ কথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে কিছুদিন যাবৎ একটা বিভ্রান্তি প্রচার করার পর সেই তথাকথিত ‘ক্রস সাবসিডি’ বাতিল করার নামে এতকালের বিভিন্ন ধরনের বিদ্যুৎ মাশুল প্রথাকে শর্তাধীন করার মধ্য দিয়ে বাস্তবে সেটাকে তুলে দিয়ে অতি দরিদ্র থেকে শুরু করে বিশাল শিল্পপতিদের বিদ্যুৎ মাশুল একই হারে করার পরিকল্পনা এবার এই ২০২০–বিদ্যুৎ আইন সংশোধনীতে আনা হয়েছে৷ যা দেশে এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে৷ আয়ের উপায় এবং জীবনযাত্রা নির্বাহের আকাশ–পাতাল পার্থক্যের এই সমাজে বেঁচে থাকার জন্য একান্ত জরুরি হিসাবে বাজারে সকল জিনিসেরই দামের তারতম্য আছে৷ একই  ট্রেনের বিভিন্ন কামরার টিকিটের দাম বিভিন্ন রকম আছে৷ বিদ্যুৎকে বিপুল মুনাফা অর্জনের প্রয়োজনে কিংবা কোনও প্রকারে বেঁচে থাকা কী কারণে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই অনুযায়ী মাশুলের আলাদা আলাদা হার থাকা দরকার৷ কেবল তাই নয়, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে সরকারের বি পি এল কিংবা সাধারণ দরিদ্র মানুষকে অত্যন্ত কম দামে এবং দরিদ্র চাষি সহ কোনও কোনও স্তরে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য জনগণের ট্যাক্স থেকে সংগৃহীত সরকারি তহবিল থেকে ভর্তুকি দেওয়াও দরকার৷ এই দাবি জানিয়েছে অ্যাবেকা৷ কিন্তু এই সংশোধনীতে সরকার সমস্ত তথাকথিত ‘পারস্পরিক ভর্তুকি’ (ক্রস সাবসিডি) তুলে দিয়ে সকলের মাশুল সমান করা হবে বলে ঘোষণা করেছে৷ অর্থাৎ পরিকাঠামো তৈরিতে মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ যাদের জন্য বিদ্যুৎ পৌঁছতে খরচ হয়েছে, সেই বৃহৎ শিল্পপতিদের মাশুল কমবে, আর মাত্র ১০ শতাংশ পরিকাঠামো ব্যয়ে যে ক্ষুদ্র শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কৃষিতে বিদ্যুৎ যায় তাদের মাশুল ব্যাপক বাড়বে৷ লেকিন এর মত বলা হয়েছে– যদি কোনও সরকার কোনও প্রকার গ্রাহকদের কিছু ভর্তুকি দিতে চায় তবে তা সরাসরি বিদ্যুৎ গ্রাহকদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক

অ্যাকাডন্টে দিতে হবে৷ অর্থাৎ আগে বিপুল হারে পাঠানো পুরো বিলটাই মেটাতে হবে৷ এ হল রান্নার গ্যাসের মতো আস্তে আস্তে সেই ভর্তুকি বাস্তবে ডঠিয়ে দেওয়ার আইনি কৌশল৷

৪) বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থা (ডব্লিড বি এস ই ডি সি এল)/সি ই এস সি বা এই ধরনের অন্যান্য কোম্পানি বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে নতুন করে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়োগ করবে, যাদের লাইসেন্স দরকার হবে না৷ যার ফলে নতুন একটা স্তর বৃদ্ধির কারণে আর এক দফা বিদ্যুতের মাশুল বাড়বে শুধু তাই নয়, লাইসেন্সবিহীন ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে বন্টন জনিত সমস্যা (বিদ্যুৎ বিল, মিটার, লাইন মেরামত,  ট্রান্সফরমার মেরামত ও প্রতিস্থাপন, নতুন লাইন নেওয়া, নিরাপত্তা ইত্যাদি) সমাধানে গ্রাহক হয়রানি ও অর্থ ব্যয় বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পাবে৷

৫) সংশোধিত বিদ্যুৎ আইনে নতুন করে ইলেকড্রিসিটি কন্ট্রাক্ট এনফোর্সমেন্ট অথরিটি (ইসিইএ) গঠন করা হবে যার উদ্দেশ্য ঝুঁকিহীন ব্যবসার পরিবেশ গড়ে দিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক স্বার্থকে নিষ্ক্ন্টক করা৷ এর ফলে আরও এক ধাপ বিদ্যুৎ মাশুল বাড়বে এবং এই সংশোধনী আইনে পরিণত হলে কেন্দ্রীয় সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধীন এই ‘অথরিটি’ বিদ্যুতের ক্রয়, বিক্রয় ও সঞ্চালন প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র অধিকারী হবে এবং রাজ্য সরকার ও রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ক্ষমতা এবং স্বাভাবিকভাবেই ‘ওমবাডসম্যান’ এর মধ্য দিয়ে নানা সমস্যা ও কোম্পানির নানা অন্যায়ের প্রতিকারে গ্রাহকদের যতটুকু সুযোগ ছিল সেটি পুরোপুরি খর্ব করা হবে৷ এই ইসিইএ অথরিটিকে হাইকোর্টের সমতুল্য অধিকার দেওয়ার ফলে ন্যায়বিচার না পাওয়া গ্রাহকদের যে কোনও সমস্যা নিয়ে একেবারে সুপ্রিম কোর্টে যেতে হবে৷ যা কোনও সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব৷ কিন্তু কোনও বিশেষ স্বার্থে বৃহৎ পুঁজিপতিরাই সেই সুযোগ নেবে৷ ফলে এই আইন বলবৎ হলে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে নানা প্রকার জুলুমের প্রেক্ষিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বাস্তবে জনসাধারণ চিরতরে বঞ্চিত হবে৷

৬) সংবিধানগত ভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ বিষয়৷ এই বিলে নানা বিষয়ে রাজ্যের প্রায় সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷ যেমন, রাজ্যস্তরে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য মনোনয়নের প্রক্রিয়ায় রাজ্য সরকারের ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হয়েছে, যা সংবিধান বিরোধী৷

৭) এই সংশোধনীতে ক্রস–বর্ডার ট্রেডের নামে বিদ্যুতে বৈদেশিক বাণিজ্যের (আমদানি–রপ্তানি) ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে বিদেশে খাদ্য রপ্তানির মতোই, বিদ্যুৎ–ও বিদেশে যাবে যদি বিদ্যুৎ কোম্পানির সর্বোচ্চ লাভের লিপ্সা চরিতার্থ হয়, দেশের মানুষ বিদ্যুৎ পাক বা না পাক৷

সমগ্র বিষয়টি মিলে এই সংশোধনীটি একটি দানবীয় আইন জারি করার প্রচেষ্টা৷ খোলাবাজার অর্থনীতি চালু করে দেশি–বিদেশি পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থে চালু করা জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন–২০০৩ জনগণের দাবি মেনে প্রত্যাহার করা দূরের কথা, নতুন সংশোধনী–২০২০র মাধ্যমে সেই আইনকে আরও জনবিরোধী রূপ দেওয়া হচ্ছে৷ ফলে একে যে কোনও মূল্যে প্রতিরোধ করতে সবস্তরের জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে৷