Breaking News

চিকিৎসাহীন সুপার স্পেশালিটি

  ভোটের প্রচারে তৃণমূল সরকার বলছে, রাজ্যে তারা চিকিৎসার ব্যবস্থার বিরাট উন্নয়ন করেছে৷ কী উন্নয়ন? তাদের বক্তব্য, তৃণমূল সরকার রাজ্যে ৪১টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল করেছে, স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের মাধ্যমে চিকিৎসা বিমার ব্যবস্থা করেছে৷ হাসপাতালে তারা নাকি বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে৷ নায্য মূল্যের ওষুধের দোকানকেও তারা বিরাট সাফল্য হিসাবে দাবি করছে৷

এই দাবির সাথে বাস্তবের মিল কতটুকু? সুপার স্পেশলিটি হাসপাতালগুলির কথাই ধরা যাক৷ এখানে কেমন চিকিৎসা মেলে? গত ২০ এবং ২১ মার্চ এ বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিক যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তার শিরোনাম ‘‘ইমারজেন্সি রোগী এলে পত্রপাঠ বিদায়’’ কেন বিদায়? কারণ নামটি সুপার স্পেশালিটি হলেও চিকিৎসার ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই৷ চোখ ধাঁধানো ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং থাকলেই তো চিকিৎসা হয় না৷ দরকার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা৷ সেই কাজটা সরকার করেছে কি?

সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বলতে কী বোঝায়? বোঝায় এমন হাসপাতাল যেখানে কার্ডিওলজি, কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি, নিউরোলজি, নিউরো সার্জারি, প্লাসটিক সার্জারি, এন্ডোক্রিনোলজি, নেফ্রলজি, ইউরোলজি, পেডিয়াট্রিক সার্জারি ইত্যাদি বিভাগ থাকবে এবং পর্যাপ্ত সংখ্যায় থাকবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, চিকিৎসার সরঞ্জাম পরিক্ষা–নিরীক্ষার ব্যবস্থা, অপারেশনের ব্যবস্থা অন্তর্বিভাগ–বহির্বিভাগ এবং নার্সিং স্টাফ, টেকনিশিয়ান, জেনারেল ডিউটি স্টাফ সহ পর্যাপ্ত লোক বল৷ এগুলির ব্যবস্থা না করে কেবল সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিলেই কোনও হাসপাতাল সুপার স্পেশালিটি স্তরে পৌঁছে যায় না৷  

সরকারের উদ্দেশ্য যদি সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসার সুযোগ সহজে পৌঁছে দেওয়া হত, তা হলে তারা রাজ্যের ১৩টি মেডিকেল কলেজকেই বেছে নিতে পারত, সেগুলিকে সুপার স্পেশালিটির স্তরে উন্নিত করাই ছিল সহজ উপায়৷ আর জেলায় জেলায় দরকার ছিল পূর্ণাঙ্গ সাধারণ হাসপাতাল৷ কারণ মানুষের সবচেয়ে বেশি দরকার লাগে এই ধরনের হাসপাতালেরই৷ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল দরকার বিশেষ কিছু বিরল রোগের জন্য৷ মুখ্যমন্ত্রী বলবার তোড়ে মাল্টি স্পেশালিটির সাথে সুপার স্পেশালিটিকে গুলিয়ে ফেলছেন৷ কলকাতার এস এস কে এম–এর মতো হাসপাতাল বর্তমানে আংশিকভাবে সুপার স্পেশালিটি বিভাগগুলি চালু রয়েছে৷ তাও ধুঁকছে লোকবল এবং পরিকাঠামোর অভাবে৷ সেখানে ভর্তি হতে, পরীক্ষা–নিরীক্ষার তারিখ পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়৷ অন্য মেডিকেল কলেজগুলির ক্ষেত্রে ২৪ ঘন্টার জরুরি পরিষেবা কোথাও নেই৷ নিউরোসার্জারির অপারেশনের ব্যবস্থা অন্য কোথাও নেই বললেই চলে৷ হার্টের অপারেশন এস এস কে এম, এন আর এস, কলকাতা মেডিকেল কলেজ, আর জি কর মেডিকেল কলেজে কিছু কিছু হলেও অন্যান্য মেডিকেল কলেজে এই বিভাগগুলির অস্তিত্ব প্রায় নেই৷

মনে রাখা দরকার স্বাধীনতার পর ভারতে যত স্বাস্থ্য কমিশন বসেছে তারা কেউই ত্রিস্তরীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাইরে যাওয়ার কথা বলেনি৷ তাদের বক্তব্য প্রথমে থাকবে প্রিভেন্টিভ কেয়ার অর্থাৎ রোগের প্রতিষেধক ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা, তারপর থাকবে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা বা প্রাইমারি হেলথ সেন্টার৷ সেখান থেকে প্রয়োজন হলে রেফার করতে হবে সেকেন্ডারি বা টার্সিয়ারি কেয়ার সেন্টারে অর্থাৎ মহকুমা জেলা হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজগুলিতে৷ তা হলে স্বাস্থ্য কমিশনগুলির এই পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দেওয়া হল না কেন? দ্বিতীয়ত, জনগণের চিকিৎসাই যদি লক্ষ্য হয় তা হলে তৈরি হওয়া সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে ৮০ শতাংশেরও বেশি চিকিৎসক পদ পূরণ করা হয়নি কেন? যে ২০ শতাংশেরও কম চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছে, তথ্য বলছে তারা কেউই সুপারস্পেশালিটি ডাক্তার নন৷ তাদের পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে, যার ফলে মেডিকেল কলেজের চিকিৎসাও বিঘ্নিত হচ্ছে৷

আবার এঁরা সুপারস্পেশালিটি ডাক্তার না হওয়ার কারণে সুপারস্পেশালিটি পরিষেবা দিতে পারছেন না৷ দুদিক থেকেই সমস্যার৷ এই ৪১টির মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে অন্তর্বিভাগ চালু হয়েছে, ৩৬টিতে অন্তর্বিভাগ নেই৷ ফলে ইমারজেন্সি রোগী এলে পত্রপাঠ রেফার করা করা ছাড়া ডাক্তারদের কি কিছু করণীয় আছে?

ডাক্তার ছাড়া হাসপাতাল চলবে না– রাজ্য সরকারের কর্তারা তা বোঝেন না এমন নয়৷ তা হলে সরকার এই নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে দিল কেন? এর উদ্দেশ্য হল, ‘সরকারি জমিতে সরকারি টাকায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি করে তারপর চালাতে পারছি না’ এই অজুহাতে হাসপাতালগুলিকে বেসররকারি মালিকদের হতে তুলে দেওয়া৷ আর এই হাসপাতালগুলিতে রোগী সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য পরিকল্পিত ভাবে সরকারি চালু হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসাকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে৷ মিডিয়ায় পরিকল্পিতভাবে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সরকার চালাতে না পারলে বেসরকারি হাতে দিক৷ সরকার দিতেও শুরু করেছে৷ ইতিমধ্যে শালবনী সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল জিন্দাল গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷

 অন্যদিকে স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প বিমা নির্ভর৷ রোগীকে এইজন্য প্রিমিয়াম দিতে হয়৷ সব চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এর সুবিধা মিলবে না৷ মিলবে শুধু ভর্তি হলে৷ এ ক্ষেত্রেও সরকারের উদ্দেশ্য বিমা কোম্পানিগুলির সুবিধা করে দেওয়া৷ ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের যে কথা সরকার বলছে, সেখানেও রয়েছে অনেক প্রশ্ন৷ প্রথমত, সব ধরনের ওষুধ সব দোকানে মেলে না৷ দ্বিতীয়ত, যে ওষুধগুলি পাওয়া যায়, কিছুটা কমিশন মিললেও তার গুণমান নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যেই মতানৈক্য রয়েছে৷ সর্বোপরি হাসপাতালে একসময় বিনামূল্যে ওষুধ মিলত, সেখানে এখন ন্যায্য মূল্যের নামে দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে সব ওষুধ৷ এ সবের মধ্য দিয়ে সুকৌশলে হরণ করা হচ্ছে বিনামূল্যে চিকিৎসার অধিকার৷

লাভবান পুঁজিপতিরা, খুশি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ে নিযুক্ত কর্পোরেট মালিকরা৷ সরকারের এই দুরভিসন্ধির পর্দা ফাঁস করে দিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসার দাবিতে লড়ছে এসইউসিআই(সি)৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা)