চাষি-মজুরের অন্তহীন সংগ্রামের কথা

৩১ আগস্ট জয়নগরে শিবনাথ শাস্ত্রী ভবনে শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ। বক্তব্য রাখছেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু।

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর নেতৃত্বে গণআন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, বিপ্লবী আন্দোলনের শহিদের রক্তধারা বারবার ভিজিয়ে দিয়ে গেছে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবনের নোনা মাটি। একটি মাত্র জেলাতেই দলের ১৯২ জন বিপ্লবী সৈনিক, আন্দোলনের নেতা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। কত মা-বোনের সম্ভ্রম লুঠ করেছে শাসকের পোষা গুণ্ডা আর পুলিশ বাহিনী। সরকারি গদিতে ক্ষমতাসীন দল পেশি শক্তির জোরে কত প্রতিবাদী পরিবারের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে, জমির ফসল কেটে নিয়ে, পুকুরে বিষ ঢেলে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে চেয়েছে তার হিসাব রাখাও কঠিন। তবু কি মাথা নোয়াতে পেরেছে প্রতিবাদী মানুষের? পেরেছে সত্যের পথ থেকে সংগ্রামী মানুষকে সরিয়ে দিতে?

উদ্বোধনের পর শহিদদের ইতিহাস সংবলিত বইটি কমরেড রবীন মণ্ডলের হাতে তুলে দিচ্ছেন কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার।

না, মাথা নোয়ানো যায়নি এই সংগ্রামী চেতনার– উত্তর দিয়ে গেল ‘চাষী মজুরের অন্তহীন সংগ্রামের কথা’ বইটির প্রতিটি অক্ষর।

৩১ আগস্ট, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের গণআন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের রচনা এই দিনটিকে ঘিরেই। ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনের ৮০ জন অমর শহিদ, ১৯৯০-এর বাসভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ, মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের অমর শহিদ মাধাই হালদারের স্মরণে এই দিনটিতে সারা বাংলার সংগ্রামী মানুষ শপথ নেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের। দিনটিকে নতুন করে স্মরণীয় করে তুলল ওই দিন ঐতিহাসিক জয়নগর শহরের শিবনাথ শাস্ত্রী হলে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গণআন্দোলনের শহিদের স্মৃতি বহনকারী পুস্তকের প্রকাশ অনুষ্ঠান।

কিশোর কমিউনিস্ট বাহিনী কমসোমলের গার্ড অফ অনার

কোভিড মহামারি জনিত পরিস্থিতিতে জমায়েত সীমাবদ্ধ করতে হয়েছে। তবু অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার প্রান্তে প্রান্তে উঠেছে আবেগের ঢেউ। তার স্পন্দনে আন্দোলিত হয়েছে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানও। যে লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেছে এই বই, তার সাথে জড়িয়ে আছে এই জেলার অসংখ্য মানুষের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তাঁদের সকলকে জয়নগরে অনুষ্ঠানে আসতে বলা যায়নি। তবু শিবনাথ শাস্ত্রী ভবনে এই সীমাবদ্ধ জমায়েতেরও জায়গা কুলোয়নি। হলের চত্বরে এবং বাইরের রাস্তাতেও চেয়ার পেতে বসে জায়ান্ট স্ক্রিনের মাধ্যমে মঞ্চে চোখ রেখেছিলেন কয়েক শত মানুষ। রাস্তায় প্রখর রোদ, কিন্তু তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই তাদের। নতুন সংগ্রামের মানসিক পাথেয় সংগ্রহ করতেই যে তারা এসেছেন। অঞ্চলে অঞ্চলেও শত শত মানুষ ফোনেই অনলাইন সম্প্রচারে চোখ রেখে যুক্ত হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে।

হলের বাইরে রক্তপতাকা উত্তোলন করে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন দলের পলিটবুরোর প্রবীণ সদস্য এবং জেলা সম্পাদক কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার। গণআন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রেণি সংগ্রামের রাস্তায় যাঁরা শহিদ হয়েছেন তাঁদের স্মরণে শহিদ বেদিতে মাল্যদান করলেন কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার এবং তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা কমরেড রবীন মণ্ডল। রক্তপতাকা ও শহিদ বেদির সামনে কিশোর কমিউনিস্ট বাহিনী কমসোমল সদস্যরা রক্তপতাকা হাতে গার্ড অব অনার জানালেন শহিদদের প্রতি।

হলের মধ্যে সমাবেশের একাংশ

মূল মঞ্চে শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান। কমরেড রবীন মণ্ডল গ্রহণ করলেন সভাপতির আসন। জেলার প্রবীণ নেতা কমরেড নলিনী প্রামাণিক বয়সের ভারে চলৎশক্তি হারিয়েছেন, কিন্তু অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে বাড়িতে থাকতে পারেননি। কর্মীদের সাহায্যে কিছুক্ষণের জন্য এসেছিলেন ইতিহাসের ছোঁয়া নিয়ে যেতে। উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ নেতা কমরেড পাঁচু নস্কর। মঞ্চে তখন উপস্থিত দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু, পলিটবুরো সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যবৃন্দ এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড মানস নন্দী।

শহিদদের স্মরণে গৃহীত হল শোক প্রস্তাব। নীরবতার মধ্য দিয়ে সকলে স্মরণ করলেন অমর শহিদদের সংগ্রামকে। সুন্দরবনের মৈপীঠ সূচিত করেছে মহান সংগ্রামের এক বড় অধ্যায়। সেই মৈপিঠের সংগ্রামের স্মরণে রচিত গান মনে গেঁথে দিয়ে গেল একটি লাইন ‘নোয়াতে পারেনি কেউ মাথা তার’। এই তো সেই কথা যাকে ভিত্তি করে এই শহিদ স্মরণ সমাবেশ, যে কথা রক্তের অক্ষরে মানুষের অন্তরে লিখে দিয়ে গেছেন ১৯২ জন শহিদ। এরপর মাধাই হালদার স্মরণে গান– ব্যথা আর শপথে মিলে ধাক্কা দিয়ে যায় যে কোনও মানুষের বিবেকের দরবারে।

কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার শহিদদের ইতিহাস সংবলিত বই উদ্বোধন করে তা তুলে দিলেন সভার সভাপতি ও তেভাগা আন্দোলনে জনগণের মুখে মুখে ‘সুন্দরবনের রবিনহুড’ বলে পরিচিতি লাভ করা কমরেড রবীন মণ্ডলের হাতে। দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ এই জেলার বহু সংগ্রাম, বহু আত্মদানের ইতিহাসের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে। তিনি অনলাইন ভাষণে তুলে ধরলেন সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। হলের পর্দায় এবং সর্বত্র অসংখ্য কর্মী-সমর্থক সাধারণ মানুষ গভীর আগ্রহে তা শুনেছেন।

কমরেড সৌমেন বসু তাঁর ভাষণে বলেন, লেনিন কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের রূপরেখা দিয়ে গিয়েছিলেন। আজকের সময়ের চূড়ান্ত ব্যক্তিবাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে তাকে বিকশিত ও উন্নত রূপ দিয়েছেন এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ। এই পথেই তিনি জন্ম দিয়েছেন এসইউসিআই (সি) দলকে।

কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, এক মহান বিপ্লবী দলের একজন হতে পেরে আমরা আজ গৌরব বোধ করি। এই দলের জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠার পিছনে এই দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার অগণিত কর্মী-সমর্থক-নেতা এবং সাধারণ মানুষের যে অবদান তার জন্য আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।

কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণে গান এবং আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সভা। এলাকায় ফিরে যাচ্ছেন কমরেডরা, সঙ্গে সদ্য প্রকাশিত লড়াইয়ের ইতিহাস। এ নিছক কিছু কাহিনি বর্ণনার ইতিহাস নয়। রক্তে ভেজা নোনা মাটির সংগ্রামের এ ইতিহাস কত নতুন নতুন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে সঠিক লক্ষে্য অবিচল থাকার জন্য। মনে হচ্ছিল– যাঁরা পরম যত্নে বুকে করে নিয়ে যাচ্ছেন এই বই, তাঁদের আরও কত জনের রক্ত ঝরবে এই মাটিতে, কত জন প্রাণ দিয়ে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনা করে যাবেন। ভারতের মাটিতে শোষণহীন নতুন সমাজ গড়ার ব্রতে অবিচল সংগ্রামের শেষ নেই।