গো–রক্ষা না তোলাবাজি?

আবার গো–রক্ষার নামে মানুষ খুন করল বিজেপির মদতপুষ্ট রাজস্থানের গো–রক্ষক বাহিনী৷ রাজস্থানের আলোয়ারে হরিয়ানার দুধ ব্যবসায়ী রাকবর খানকে গোরু পাচারের মিথ্যা অজুহাতে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তারা৷ এ কাজ যে বিজেপি–আরএসএসের মদতপুষ্ট তা স্পষ্ট হয়েছে আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমারের কথায়৷ তিনি বলে দিয়েছেন, মুসলমানরা গোরুর মাংস খাওয়া বন্ধ না করা পর্যন্ত এসব চলবেই৷ রাজস্থানের এক বিজেপি মন্ত্রীও একই সুরে এই হত্যাকে সমর্থন করেছেন৷ তেলেঙ্গানার এক বিজেপি বিধায়ক বলে দিয়েছেন গোরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ ঘোষণা না করা পর্যন্ত এমন সন্ত্রাস চলবে৷ উত্তরপ্রদেশের আগ্রাতেও মোষের মৃতদেহ সৎকারে নিয়ে যাওয়ার সময় একজন আক্রান্ত হয়েছেন৷ এই সমস্ত কিছুকে সমর্থন জানিয়ে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন গোরু মানুষের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ অর্থাৎ তাঁর কথার মানে দাঁড়ায় গরুর নামে নরহত্যা তেমন কিছু বড় অপরাধ নয় গো–সন্ত্রাস, গুজব রটিয়ে পিটিয়ে মারার মতো ঘটনা রুখতে কড়া আইন ও পদক্ষেপের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের এক সপ্তাহের মধ্যে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটল৷ বিজেপি সংঘ পরিবার জোর গলায় যেভাবে তাকে কার্যত সমর্থন জানিয়েছে তা দেখিয়ে দেয় তারা দেশে কোন পরিস্থিতি কায়েম করতে চায়!

হরিয়ানার দুধ ব্যবসায়ী রাকবর খান এবং তাঁর বন্ধু আসলাম রাজস্থানের আলোয়ারের হাট থেকে দুটি গরু এবং বাছুর কিনে বাড়ি ফিরছিলেন হেঁটে৷ রাজস্থানের বিজেপি সরকারের পুলিশের সাহায্যে বিজেপি–বিশ্বহিন্দু পরিষদের মদতপুষ্ট গো–রক্ষক নামধারী তোলাবাজরা সর্বত্র ‘গো–চেকপোস্ট’ তৈরি করেছে৷ তারাই পিটিয়ে মেরেছে রাকবর খানকে৷ গরু কেনার বৈধ কাগজপত্র দেখানো সত্ত্বেও রেহাই মেলেনি৷ শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি তার মৃত্যু সুনিশ্চিত করবার জন্য পুলিশের সাথে হাত মিলিয়ে এমন ব্যবস্থা করেছে যে, পুলিশ ঘটনার সাড়ে চার ঘন্টারও বেশি পরে রাকবরের মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে গেছে৷

হাসপাতালে যাওয়ার আগে পুলিশ রাকবরের গরুগুলিকে আগে গোশালায় পাঠিয়েছে, নিজেরা দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছে৷ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্থানীয় নেতারা এবং স্থানীয় বিজেপি এমএলএ জ্ঞানদেব আহুজার প্রত্যক্ষ পরিচালনাতেই যে পুরো ঘটনাটি পরিচালিত হয়েছে তা ঘটনাক্রমে পুরোপুরি স্পষ্ট৷ রাকবরের সঙ্গী আসলাম কোনও রকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন৷ তিনি এফআইআর–এ বলেছেন, গো–রক্ষকরা রাকবরকে মারতে মারতে বলছিল, আমরা এমএলএ–র লোক, কেউ আমাদের টিকিও ছুঁতে পারবে না৷ বিজেপি সরকার, বিজেপি দল এবং বিশ্বহিন্দু পরিষদ রাকবরের মৃত্যুর জন্য পুলিশের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে যাতে চুনোপুঁটি দু–একজন এএসআই বা কনস্টেবলের উপর দোষ দিয়ে সরকার পার পেয়ে যেতে পারে৷

তথ্য বলছে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হওয়ার পর বিগত চার বছরে সারা দেশজুড়েই গুজব রটিয়ে হত্যা, গো–রক্ষার নামে পিটিয়ে হত্যা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে৷ ২০১০ থেকে ৮ বছরে এ ধরনের যত পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার ৯৮ শতাংশই ঘটেছে গত চার বছরে৷ সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে সরকারকে অবিলম্বে এই গুন্ডাবাজি বন্ধ করতে হবে৷ তাতে সরকার কী করেছে? তারা বেশ কিছুদিন টালবাহানা করার পর এক বশংবদ আমলার নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠন করে দিয়েছে, গো–রক্ষার নামে কেন সন্ত্রাস হচ্ছে তা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দিতে৷ তারপর হয়ত আর একটি কমিটি হবে এই সন্ত্রাস বন্ধ করার পথ কী তা খুঁজতে হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীর মতো অনেক মাথা খাটিয়ে তাঁরা কী সমাধান বার করবেন জানা নেই৷ তবে সাধারণ মানুষ কিন্তু এর কারণ এবং সমাধানটি জানেন৷

রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র কিংবা গুজরাটের মতো বিজেপির শক্ত ঘাঁটি যে রাজ্যগুলিতে যেখানে আরএসএস–বিজেপি–বিশ্ব হিন্দু পরিষদ–বজরং দল ইত্যাদি হিন্দুত্বের স্বঘোষিত অভিভাবক দলের নেতারা এখন ‘গো–রক্ষা’র নামে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাচ্ছেন৷ রাজস্থানের আলোয়ারেই এদের পরিচালনায় বেশ কয়েকটি ‘গোশালা’ চালু হয়েছে৷ হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যে কেউ রাজস্থানের হাট থেকে গরু, ছাগল, ভেড়া, উট যে কোনও পশুই কিনুক না কেন এই বাহিনীকে তোলা না দিয়ে তাদের উপায় নেই৷ টাকা আদায়ের জন্য এরা চালু করেছে ‘চেকপোস্ট’ যেখানে স্থানীয় থানার পুলিশও বিজেপি মদতপুষ্ট বাহিনীর সাথে বখরার ভিত্তিতে পাহারা দেয়৷ পশু কিনে কেউ রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা গাড়িতে গেলেই এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ টাকা না পেলে কেড়ে নেয় গরু–ভেড়া যা পায়৷ এমনকী গো–রক্ষার ধুয়ো তুলে নানা গ্রামে হানা দিয়ে গরু কেড়ে আনে ওরা৷ টাকা দিয়ে ছাড়াতে পারে না যারা তাদের পশুগুলিকে আবার বিক্রি করে দেয় এই ‘গো–রক্ষকরা’৷ এদের হাতে পশুপালক ‘রাবারি’ উপজাতিদেরও ছাড় নেই৷ ধর্মে হিন্দু এই উপজাতির মানুষরা গুজরাট থেকে হাঁটাপথে রাজস্থানে এসে পশু কিনে আবার গুজরাটে ফিরে যান৷ বহুকাল ধরে তাঁদের এই জীবিকা চলছে৷ কিন্তু এখন আলোয়ার পার হওয়ার সময় ‘গো–রক্ষা চেকপোস্টে’ তোলা না দিলে জোটে মারধোর, জোর করে টাকা কেড়ে নেওয়াটা গো–রক্ষকদের কাছে তো জলভাত৷ রাবারি উপজাতির এক প্রধান, রাকবর খানের মৃত্যুর পর সাংবাদিকদের বলেছেন, বাঁচতে গেলে ওদের টাকা না দিয়ে উপায় নেই (দ্য টেলিগ্রাফ ২৪ জুলাই)৷ এর মধ্যে শিকার যদি মুসলমান হয় এবং সময়টা ভোটের কাছাকাছি থাকে তাহলে দু–চারজনকে পিটিয়ে খুন করে আতঙ্ক এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোটাই এদের কাজ৷ তাতে বহুমুখী লাভ– টাকাও কেড়ে নেওয়া গেল, গরু–ভেড়া ইত্যাদিও লাভ হল৷ আবার ভোটের জন্য হিন্দুত্বের পালে বাতাস লাগানোও হল যে কারণে রাকবরকে মারতে মারতে ‘গো–রক্ষক’ গুন্ডারা বলছিল ‘এমএলএ আমাদের সাথে আছে, তোকে কেটে জ্বালিয়ে দিলেও কেউ কিছু বলবে না’৷

রাজস্থানের সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম কোলগাঁওতে বহু প্রজন্মের দুধের ব্যবসা নিহত রাকবরের পরিবারের৷ তাঁর মৃত্যুর পর সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে দেখেছেন গরু–ছাগল সহ সমস্ত গৃহপালিত জীবকে রাকবরের পরিবার যথেষ্ট যত্নে রাখেন৷ কোনও হিন্দু পরিবারের সাথে এক্ষেত্রে তাঁদের কোনও পার্থক্যই নেই৷ প্রতিবেশী হিন্দু–মুসলমানে কোনও শত্রুতাও সেখানে নেই৷ কিন্তু  লোকসভা ভোট আর রাজস্থান বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে  তত  এলাকার মানুষের আতঙ্ক বাড়ছে৷ অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা জানেন ভোট এলেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরির চেষ্টায় ওৎ পেতে বসে থাকে বিজেপি–সংঘপরিবার্ এমনকী কংগ্রেসও৷

মানুষ দেখেছে এই আলোয়ারেই হরিয়ানার আর এক ডেয়ারি চাষি পহেলু খানকে একইভাবে হত্যা করেছিল গো–রক্ষক বাহিনী৷ বিজেপির পক্ষে ধর্মীয় মেরুকরণের জিগির তোলাই ছিল উদ্দেশ্য৷ পহেলু খানের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে রাজস্থান সরকারের পুলিশ এমনভাবে মামলা সাজিয়েছিল যে তারা সকলেই ছাড় পেয়ে গেছে৷ তাদের মালা পরিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে বিজেপি নেতারা সংবর্ধনা দিয়েছেন৷ রাকবরের আত্মীয় প্রতিবেশীরাও নিশ্চিত তাঁর হত্যাকারীদের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটাবে বিজেপি সরকারের পুলিশ৷ একইভাবে বিহারে এক সংখ্যালঘু মানুষকে পিটিয়ে মারার জন্য সাজাপ্রাপ্ত দুষৃক্তীরা সরকারের সাথে যোগসাজশে উচ্চ আদালতে জামিন পেতেই কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের মন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা, তাদের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছেন৷ আর এক মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ দাঙ্গার দায়ে আদালতে শাস্তিপ্রাপ্তদের একইভাবে সংবর্ধনা দিয়েছেন৷ কোনও ক্ষেত্রেই বিজেপির নেতৃত্ব বা প্রধানমন্ত্রী–স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনও প্রতিবাদ করেননি৷

কেন্দ্রীয় মসনদে বসে চার বছরের বেশি সময় পার করে দেওয়া বিজেপি নেতৃত্ব জানে তাদের বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা, সবকা সাথ সবকা বিকাশ, আচ্ছে দিন ইত্যাদি স্লোগানগুলি আজ কোনও বেকুবেও বিশ্বাস করে না৷ নরেন্দ্র মোদি প্রচারিত মেক ইন ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে গুজরাট মডেল এমনকী বহুল প্রচারিত ভাইব্র্যান্ট গুজরাট পর্যন্ত এমন থরথর করে কাঁপছে যে মোদি সাহেব নিজেও তাতে পা রেখে আর দাঁড়াতে ভরসা পাচ্ছেন না৷ তাই তাদের কাছে ২০১৯–এর ভোট বৈতরণী পার হওয়ার উপায় একটাই– প্রবল হিন্দুত্ববাদের হাওয়া তুলে হিন্দু ভোটকে সংহত করা৷ সে কারণেই গো–রক্ষা, রাম মন্দির, বৈদিক যুগের মাহাত্ম্য প্রচার এগুলিই তাঁদের প্রচারের একমাত্র হাতিয়ার৷

বিজেপির কাছে গো–রক্ষার ধুয়ো যে কেবল মাত্র বিদ্বেষ সৃষ্টি করে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির হাতিয়ার তা পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন নাগাল্যান্ডে, কেরালায়, বিজেপির সর্বভারতীয় ও রাজ্য নেতারা এই সমস্ত রাজ্যে গোমাংস খাওয়াকে সমর্থন করেন৷ না হলে সেখানে ভোট হারাবেন তাঁরা৷ অন্যদিকে ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে আফ্রিকার বাজারের উমেদারি করতে গিয়ে গোরক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যাম্পিয়ান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি রোয়ান্ডাতে গরুর ফার্মে ২০০ গরু উপহার দিয়ে এসেছেন এ কথা জেনেই যে, রোয়ান্ডার জনপ্রিয়তম খাদ্যের নাম ‘বিফ স্টু’৷ অভিযোগ, এদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ টন গো–মাংস রপ্তানির সঙ্গে অনেক বিজেপি নেতাও যুক্ত৷

বাস্তবে গো–রক্ষা নয়, বিজেপির কাছে একমাত্র প্রয়োজন এই ইস্যুতে হানাহানির জিগির তোলা৷ গোরুর নামে এই তাণ্ডব শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে তাই নয়, দলিত, আদিবাসী, খ্রিস্টান সহ নানা উপজাতির মানুষও এই জিগিরে আক্রান্ত হচ্ছেন৷ এমনকী প্রাণ হারাচ্ছেন৷ গোরক্ষার নামে শুরু হয়ে এই সন্ত্রাস শুধু তাতে আটকে নেই৷ যে কোনও একটা অজুহাত খুঁজে নিয়ে গণপিটুনিতে হত্যা, কোনওভাবে কারও কাজ অপছন্দ হলেই সোশ্যাল মিডিয়াতে তার চরিত্র হনন– এ সমস্ত যেন গণহিস্টিরিয়ার মতো সমাজ জীবনে ছড়িয়ে পড়ছে৷ গুজব ছড়ানো, ফেক নিউজ বা মিথ্যা খবর ছড়ানো এবং তা নিয়ে মানুষকে উন্মাদ করে তোলাকে বিজেপি একটা সংগঠিত ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করছে৷ আদর্শগতভাবে এবং মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতায় সম্পূর্ণ দেউলিয়া বিজেপি সস্তায় ভোট–চমকের স্বার্থে গোরুকে বাঁচানোর ছলে মানুষ খুন, ধর্ম বিদ্বেষের কারবারে নেমেছে৷ ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেরই তাতে সর্বনাশ৷

(৭১ বর্ষ ১ সংখ্যা ৩ আগস্ট, ২০১৮)