‘গুজরাট মডেল’ কী জিনিস টের পেয়েছেন চাষিরা

গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিজেপি৷ ৯৯টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে৷ কিন্তু সত্যিই কি জয় হয়েছে বিজেপির?  এ তো কোনও ক্রমে মুখরক্ষা৷ ২০১২ সালের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ১১৭টি আসন৷ দলের সভাপতি অমিত শাহ এবার ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা ১৫০টি আসন পাচ্ছেনই৷ সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি৷ এমনকী নিজেদের আসনগুলিও তাঁরা ধরে রাখতে পারেননি৷ ১৮টি আসন খুইয়েছেন, ৩১টিতে জয় এসেছে নামমাত্র ব্যবধানে৷

অথচ গুজরাটে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল বিজেপি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটে ৬৪টি নির্বাচনী সভা করেছেন৷ প্রচারে নামিয়েছিলেন গোটা মন্ত্রীসভাকে৷  নেমেছিলেন দলের আট জন মুখ্যমন্ত্রী৷ নির্বাচনের আগে দেশের মানুষ বুঝতেই পারছিলেন না, নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী না গুজরাটের৷ প্রচারে নেমে প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদের মর্যাদারও কোনও তোয়াক্কা করেননি৷ এর আগে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে ‘গুজরাট মডেলের’ যে চোখধাঁধানো প্রচার মানুষ দেখেছিল এবারের প্রচারে কোথাও তার দেখা মেলেনি৷ দেখা মেলেনি ‘বিকাশ পুরুষের’৷ ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রে’র নির্বাচনী বিধিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তথা হিন্দু–মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতিই এবার প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতাদের প্রচারের মুখ্য বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল৷

‘বিকাশ পুরুষ’ হিসাবে এতদিনের তুলে ধরা মোদি এমন করে হারিয়ে গেলেন কেন? বক্তৃতায় কোথাও ‘আচ্ছে দিনে’র উল্লেখ পাওয়া গেল না কেন? বহু প্রচারিত তাঁর সেই ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ স্লোগানই বা মোদি কিংবা তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা এবার তুললেন না কেন? কেন জেতার জন্য তাঁদের শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতারই আশ্রয় নিতে হল?

স্বাধীনতার সাত দশক ধরে বঞ্চিত হতে হতে, প্রতারিত হতে হতে সংকটের আবর্তে পড়া মানুষ বিজেপির ‘বিকাশ’ আর ‘আচ্ছে দিনে’র সর্বগ্রাসী প্রচারকে খড়কুটোর মতো চেপে ধরতে চেয়েছিল৷ ভেবেছিল, বিজেপি নেতাদের প্রতিশ্রুতি যদি সত্যি হয় নিদারুণ বাস্তব মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এ সবের কোনওটিতেই বিন্দুমাত্র সত্যি নেই, সবই ‘জুমলা’– গদি দখলের জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতি মাত্র৷ গরিব মানুষ, গ্রামীণ মানুষ, শ্রমিক–কৃষক–নিম্ন মানুষ বিজেপি শাসনের কয়েক বছরেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন গুজরাট মডেল আসলে কী ভয়ঙ্কর এক মডেল মানুষ যে তাদের প্রতারণা ধরে ফেলেছে তা বুঝতে বাকি থাকেনি বিজেপি নেতাদেরও৷ তাই আর ‘উন্নয়ন’, ‘বিকাশ’ বা ‘আচ্ছে দিন’–এর ধারপাশ মাড়াননি তাঁরা৷ আঁকড়ে ধরেছেন হিন্দুত্ববাদের নগ্ন সাম্প্রদায়িক প্রচারকে৷

নির্বাচনী ফলে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ গুজরাটে বিজেপি গো–হারান হেরেছে৷ আমেদাবাদ, সুরাট, বডোদরা, রাজকোট– এই চারটি শহরকেন্দ্রিক জেলার ৫৫টি আসনের মধ্যে ৪৬টিতে জিতেছে বিজেপি৷ এর বাইরে ১২৭টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ৭১টি৷ অর্থাৎ গ্রামীণ গুজরাট বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে৷ তথাকথিত গুজরাট মডেলে উন্নয়নের যা সুফল তা গুজরাটের গ্রামীণ মানুষ, প্রান্তিক মানুষ, কৃষক–শ্রমিক কারও ভাগ্যে জোটেনি৷ শহরগুলি যখন আলোয় ঝলমল করছে, হাইওয়ে, উড়ালপুল, ব্রিজে ছেয়ে যাচ্ছে, স্মার্ট সিটি, ডিজিটাল সিটি নামের চমক দিচ্ছে, গ্রামীণ গুজরাটে তখন তুলোর দাম না পেয়ে, ঋণ–জর্জরিত হয়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছে৷ পানীয় জলের জন্য মানুষ মাইলের পর মাইল হাঁটছে৷ প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম পাবে৷ জল–সংকটে হাহাকার করা এলাকাগুলিতে নর্মদার জল পৌঁছে দেবেন৷ সারা দেশের মতো গুজরাটের চাষিরাও ফসলের দাম পায়নি, নর্মদার জলও আসেনি৷ শিল্পপতিদের জন্য অঢেল ব্যাঙ্কঋণের ব্যবস্থা থাকলেও সাধারণ কৃষকদের জন্য মহাজনই ভরসা৷ স্কুল–স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির ভগ্নদশা৷ বিজেপি নেতারা বলেছিলেন, গুজরাটকে শিল্পসমৃদ্ধ রাজ্য হিসাবে গড়ে তুলবেন, যেখানে রাজ্যের বেকাররা কাজ পাবে৷ শিল্প যতটুকু হয়েছে তাতে লাভবান হয়েছে শুধু আদানির মতো মুষ্টিমেয় শিল্পপতিরাই৷ বেকারদের কাজ জোটেনি৷ মালিকরা বিনামূল্যে কিংবা জলের দামে জমি পেয়েছেন, জল বিদ্যুৎ আর নানা রকম ট্যাক্সে হরেক রকম ছাড় পেয়েছেন৷ শিল্প–আইন গুজরাটে যা আছে তাতে শ্রমিকদের কোনও অধিকারই নেই, যথেচ্ছ শোষণের অবাধ ছাড়পত্র মালিকদের হাতে৷ ন্যূনতম মজুরি আইন গুজরাটে কার্যকর হয় না৷ আধুনিক শিল্পে চাকরিও নেই৷ সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গুজরাট মডেলের মোহ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে৷ তারই প্রতিফলন ঘটেছে নির্বাচনে৷ এমনকী জীবনের সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজেপির নগ্ন সাম্প্রদায়িক প্রচারও কাজ করেনি, যা করেছে শহরের সচ্ছল সুবিধাভোগী মানুষের মধ্যে৷

প্রধানমন্ত্রী যতই নিজেকে চা–ওয়ালা বলে প্রচার করুন, বাস্তবে তিনি কিংবা তাঁর দল যে এ দেশের পুঁজিপতিদের স্বার্থই রক্ষা করে চলেছেন, তা গুজরাটের গরিব সাধারণ মানুষ তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন৷ তার মানে এই নয় যে, কংগ্রেসের প্রতি কোনও আস্থা থেকে মানুষ তাদের ভোট দিয়েছে৷ নিরুপায় মানুষ কোনও যথার্থ বিকল্প না পেয়ে বাধ্য হয়েছে কংগ্রেসকে ভোট দিতে৷ বিজেপির প্রতি মানুষের ক্ষোভ বুঝে কংগ্রেস নেমে পড়েছিল একই রকম মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি নিয়ে মানুষকে প্রতারিত করতে৷ ক্ষমতায় এলে দশ দিনের মধ্যে কৃষিঋণ মকুব করবেন, এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন রাহুল গান্ধী৷ বিজেপি নেতাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন তিনি হিন্দু মন্দিরে গিয়ে মাথা ঠেকানোর৷ একবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি গুজরাটে বিজেপির সবচেয়ে বড় অপরাধ ২০০২ সালে ধর্মের নামে ভয়ঙ্কর সংখ্যালঘু হত্যার৷ পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম সাধারণ মানুষের বিজেপি বিরোধী মনোভাবকে খেয়াল করেই কংগ্রেসকে  এবার ব্যাপক প্রচার দিয়েছে, রাহুল গান্ধীকে বিকল্প নেতা হিসাবে তুলে ধরেছে৷ অসচেতন, নিরুপায় মানুষ বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমের প্রচারে আবার বিভ্রান্ত হয়েছে৷

তবে কি এমনই চলতে থাকবে? শোষিত বঞ্চিত মানুষ ফুটবলের মতো একবার কংগ্রেসের পায়ে আর একবার বিজেপির পায়ে গড়াগড়ি খেতে থাকবে? বাস্তবে তাই ঘটবে যতদিন না মানুষ এই দলগুলির জনবিরোধী চরিত্র, শ্রেণিচরিত্র ধরতে পারবে৷ যে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার মানুষ এ ধরনের সমস্ত রকম শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়েছিল, সেই বিপ্লবের রূপকার মহান লেনিন বলেছিলেন, ‘‘জনগণ বরাবরই রাজনীতিতে প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ শিকার হয়ে এসেছে এবং সর্বদা হতেই থাকবে যতদিন না তারা সকল নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণাবলি এবং প্রতিশ্রুতিগুলির পিছনে কোন বা কোন কোন শ্রেণির স্বার্থ কাজ করছে তা খুঁজে বের করতে শিখবে৷’’ গুজরাটের বেশিরভাগ মানুষ এটা ধরতে পারেনি যে শ্রেণি চরিত্রের দিক থেকে কংগ্রেস এবং বিজেপি দুটি দলই বুর্জোয়া তথা পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী দল৷

এ রাজ্যেও কিছু মানুষ বিজেপির এই শ্রেণিচরিত্র ধরতে না পেরে, তার নীতি, কার্যকলাপ, নেতাদের চরিত্র কোনও কিছুরই বিচার না করে এবং একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস অন্য দিকে সিপিএমের প্রতি বিরক্ত হয়ে মনে করছেন বিজেপি বোধহয় তাঁদের জীবনের দুঃখ–কষ্ট, শোষণ–বঞ্চনার অবসান ঘটাতে পারবে৷ তাঁদের সামনে গুজরাটের মানুষের অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, এই দল সাধারণ গরিব নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্যার কোনও সমাধানই করতে পারে না, বরং সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের সংহতিকেই দুর্বল করে৷ এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং বুঝতে হবে কোন দল সত্যিই তাদের মুক্তিসংগ্রামের সাথি, কারা তাদের সত্যিই শোষণ থেকে বঞ্চনা থেকে মুক্ত করতে চায়, তাদের চিনতে হবে, তাদের শক্তিশালী করতে হবে৷ তা না করে তাঁরা যদি শুধু স্রোতে ভাসতে চান, বড় দল খোঁজেন, নামকরা নেতা–মন্ত্রী খোঁজেন, বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমের প্রচারে বিভ্রান্ত হন এবং তাদের উপরই নিজেদের ভাগ্য সঁপে দিয়ে ‘নির্ঝঞ্ঝাট’ জীবন কাটাতে চান, তবে অতীতের মতোই আবারও তাঁরা ঠকবেন এবং তারপর আবার বলবেন, ও সব দলই সমান এবং রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই সব পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দলগুলিরই সুবিধা করে দেবেন৷ যত কঠিন হোক, তাঁদের শ্রেণিচরিত্র, শ্রেণিস্বার্থ বুঝতে শিখতে হবে, শ্রেণি সংগ্রামে সামিল হতে হবে, না হলে এমন করেই তাঁরা বারে বারে প্রতারণার শিকার হবেন৷