খেলা যখন লড়াইয়ের হাতিয়ার

১৯১১ সাল৷ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল বাংলা৷ এ উদ্দীপনা আন্দোলিত করেছিল গোটা ভারতবর্ষকেই৷ রাজনৈতিক আন্দোলন ছাপ ফেলল ফুটবল মাঠেও৷ খেলোয়াড়দের বুকেও স্বপ্ন৷ পদাঘাতের বিপরীতে পদাঘাত দিয়ে হারাতে হবে ব্রিটিশকে৷ বঙ্গভঙ্গ ও ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়ে তখন অবিভক্ত বাংলা ফুঁসছে৷ চলছে ব্রিটিশের দমন, অত্যাচার, হত্যা৷ অত্যাচারিত, শোষিত, নির্যাতিত ভারতবাসীর শোষক ইংরাজকে পরাজিত করবার, দর্পচূর্ণ করবার এক তীব্র আকাঙক্ষা ঘুমিয়ে ছিল৷ তাই ১৯১১–এর ২৯ জুলাই–এর আইএফএ শিল্ড ফাইনাল আর শুধুমাত্র খেলা থাকল না৷ ময়দান কার্যত হয়ে উঠল মিনি ভারত৷ জয়ের উল্লাসে ফেটে পড়া জনতার মুখে ‘জয়তু মোহনবাগান’ নয়, ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি৷ বুট পরা ইংরেজ খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে খালি পায়ে ভারতীয়দের জয় দিয়েছিল বিদ্রোহের নতুন ভাষা৷ এর পর তীব্রতর হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন৷ ওই বছরই ১২ ডিসেম্বর রদ হল বঙ্গভঙ্গ৷

খেলা কি নিছক বিনোদন? না– শুধু তা নয়৷ এর সঙ্গে মিশে আছে লাখো মানুষের আবেগ, ভালবাসা, জীবনবোধ৷ তাই মানুষ অনেক সময়ই তার বঞ্চনা–লাঞ্ছনা, না পাওয়ার যন্ত্রণা প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে খেলাকে বেছে নিয়েছে৷ অন্যদিকে শাসকরা চেয়েছে খেলার উদ্দামতায় মাতিয়ে দিয়ে প্রকৃত সমস্যা থেকে মানুষের চোখ ঘোরাতে৷ তাই খেলাধূলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কটা কেউ চাইলে ছিন্ন করতে পারে না৷ ইতিহাস প্রমাণ৷ যখনই প্রতিবাদের সব পথ রুদ্ধ হয়েছে, নেমে এসেছে বঞ্চনা, অপমান, অত্যাচার, খেলা– বিশেষত ফুটবল গর্জে উঠেছে৷ খেলা হয়ে উঠেছে বঞ্চিতদের হাতিয়ার৷

শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে ফুটবল খেলার অবদান অনস্বীকার্য৷ ওই দেশের কুখ্যাত রবেন দ্বীপের কারাগারে শ্বেতাঙ্গ শাসকরা প্রবল শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে স্বাধীনতাকামীদের সংগ্রামী মনোবল ভাঙতে চাইছিল৷ ওই দ্বীপের কারাগারে তখন বন্দি অবস্থায় অমানুষিক জীবন কাটাচ্ছেন নেলসন ম্যান্ডেলা৷ তিনি বুঝলেন, শাসকদের এ চক্রান্ত সফল হলে সমূহ বিপদ৷ বন্দি সংগ্রামী যোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মনোবল অটুট রাখার উপায় হিসাবে ফুটবল খেলাকে ব্যবহার করার জন্য তিনি বারংবার দাবি জানাতে থাকেন, ‘বন্দিদের ফুটবল খেলতে দিতে হবে’৷ কুখ্যাত রবেন দ্বীপের কারাগারের অমানবিক অত্যাচার যে শুধুমাত্র রটনা– সারা বিশ্বে এটা দেখাতেই শ্বেতাঙ্গ শাসকরা বন্দিদের ফুটবল খেলার অনুমতি দিলেন৷ কার্যক্ষেত্রে ফল হল সম্পূর্ণ উল্টো৷ খেলার সুযোগ বন্দিদের সম্পর্ককে নিবিড় করল৷ তাদের ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ করল, শত অত্যাচারেও ভেঙে না পড়ার মনোবল জোগাল৷ যে শিক্ষা শেষপর্যন্ত বর্ণবৈষম্যের জমানার পতনে ও তার পরেও কাজে লেগেছিল৷ ম্যান্ডেলা জেলে বন্দিদের নিয়ে ওই সময়ই ‘মাকান’ ফুটবল ক্লাব তৈরি করেছিলেন৷ ২০০৭ সালে ফিফা ওই ক্লাবকে স্বীকৃতি দেয়৷

স্পেনীয় রাজাদের কাতালানবাসীদের উপর চাপানো আধিপত্য ও অত্যাচারের জবাব হিসাবে জন্ম নিয়েছিল ফুটবল ক্লাব ‘বার্সেলোনা’৷ পরাধীন কাতালানবাসীর স্বাধীনতার লড়াইয়ের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছিল বার্সার ‘ন্যু ক্যাম্প’৷ অন্যদিকে রিয়েল মাদ্রিদ তৈরি হয় শাসকদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে৷ তাই এই দুই ক্লাবের মহারণ ‘এল ক্লাসিকো’– হয়ে উঠেছিল অনেকটা শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসাবে৷

অত্যাচারী শাসকও খেলার মাঠকে ব্যবহার করতে চেয়েছে, তার আধিপত্যের ক্ষেত্র হিসাবে৷ কখনও কখনও সফলও হয়েছে৷ যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে ১৯৩৮–এর ১৪ মে বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ড–জার্মানির খেলা৷ ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের বলা হল জার্মান জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের সময় নাৎসি স্যালুট দিতে হবে৷ মাঠ ভর্তি লাখো দর্শকের সামনে ফ্যাসিস্ট হিটলারকে খুশি করতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের নির্দেশে ইংল্যান্ডের ফুটবলাররা ‘নাৎসি’ স্যালুট দিতে বাধ্য হয়৷ আবার এই নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে খেলার মাঠকেই লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল অস্ট্রিয়ান ফুটবলার ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার এবং সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার কিয়েভ অঞ্চলের ফুটবল ক্লাব ‘স্টার্ট এফসি’৷ ১৯৩৮–এর ৩ এপ্রিল জার্মান–স্ট্রিয়ার ম্যাচে ‘জার্মানিকে হারানো যাবে না’ এই নির্দেশ অমান্য করে  ২–০ গোলে অস্ট্রিয়া জেতে৷ এই খেলায় দুরন্ত ফুটবল উপহার দেন ‘মোজার্ট অফ ফুটবল’– ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার৷ বিষয়টা ভালভাবে নেননি স্বয়ং ফুয়েরার৷ এত স্পর্ধা ফলাফল যা হওয়ার তাই হল ১৯৩৯–এর ২৩ জানুয়ারি এই মহান শিল্পী ফুটবলার আর তার বান্ধবীকে ঘুমের মধ্যে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে হত্যা করল নাৎসিরা৷ ১৯৪২–এর কিয়েভ পতনের পর পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘স্টার্ট এফসি’–র সঙ্গে জার্মান সেনাদের দল ‘ফাকেম্ফের’ ম্যাচ৷ রাশিয়ার দলকে নির্দেশ দিল নাৎসি অফিসাররা–‘হারতে হবে, আর নাৎসি স্যালুট দিতে হবে’৷ লেনিন–স্ট্যালিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত সোভিয়েত খেলোয়াড়রা তা অমান্য করেন৷ মাঠে নাৎসিদের টিমকে পর্যুদস্ত করার পর হিটলার বাহিনীর অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বীরের মৃত্যু বরণ করেন৷ ম্যাচটি ইতিহাসে স্মরণীয় ‘দ্য ডেথ ম্যাচ’ নামে৷ এটাই ফুটবলের অদম্য  স্পিরিট৷

সেই ফুটবল খেলা এখন কর্পোরেটের গ্রাসে৷  খেলোয়াড়দের করে তোলা হচ্ছে প্রায় ক্রীতদাস৷ অর্থের দাপট ফুটবল সহ গোটা ক্রীড়াজগৎকে গিলে খাচ্ছে৷ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে কর্পোরেট পুঁজি৷ খেলা এখন একটা পণ্য৷ বিশ্বকাপে দেশের হয়ে খেলোয়াড়কে খেলতে দেওয়ার বিনিময়ে ক্লাবগুলি কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ নেয় ফিফার কাছ থেকে৷ আবার দেখা যায়, বিশ্বকাপের আসরেও বহু স্বনামধন্য ফুটবলার নিজেদের উজাড় করে না দিয়ে কিছুটা যেন বাঁচিয়ে খেলেন৷ ক্লাব নামক বৃহৎ কোম্পানির কাছে তাঁর দায়বদ্ধতা অনেক বেশি৷

কিন্তু এত করেও কি খেলার প্রাণসত্তাকে গলা টিপে পুরোপুরি মারতে পেরেছে পুঁজিবাদের নিষ্ঠুর থাবা? না৷ এর মধ্যেও মাথা তোলে মনুষ্যত্বের আহ্বান৷ যাকে বাঁচিয়ে রাখা, বড় করা দরকার৷

সাম্বা ফুটবলের ভক্ত ব্রাজিলের সক্রেটিস তাঁর খেলোয়াড়জীবনে হয়ে উঠেছিলেন সে দেশের স্বৈরাচারী জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মহীরুহ৷ যখন সারা দেশে কোথাও কোনও নির্বাচন করতে দিচ্ছে না সরকার, তখন তাকে অমান্য করে তাঁর ক্লাব ‘করিন্থিয়ান্সে’ চালু করেছিলেন ভোট ভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সংস্কৃতি৷ ১৯৮২–তে একটি প্রতিযোগিতার ফাইনাল খেলায় তাঁর টিম ‘ডেমোক্রাসিয়া’ লেখা জার্সি পরে খেলতে নামলে সারা ব্রাজিলে আলোড়ন পড়ে যায়৷ এভাবেই খেলার মাঠকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন খেলোয়াড়রা৷ ফিদেল কাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারার ভক্ত এই ফুটবলার ইতালিতে খেলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি নিজে খেলা বাদে বাকি সময়টা ইতালির শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে পড়াশোনা করি’৷ লাতিন আমেরিকার আর এক ফুটবলার দিয়াগো মারাদোনা সমাজতান্ত্রিক কিউবার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা থেকে যা কিছু আসে তাকে আমি ঘৃণা করি, ঘৃণা করি সর্বশক্তি দিয়ে’৷ ২০০৫ সালে আর্জেন্টিনায় ‘সামিট অফ দ্য আমেরিকাস’–এ তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিরোধিতা করে ‘স্টপ বুশ’ (এস–এর স্থানে ছিল স্বস্তিক চিহ্ণ) টি শার্ট পরেছিলেন৷ ইরানের জনগণের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন৷ নিজের আত্মজীবনীর কিউবান সংস্করণের সম্পূর্ণ আর্থিক স্বত্ব ফিদেল কাস্ত্রোর তহবিলে দান করেছিলেন৷ এমনকী বর্তমান প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যেও এই প্রতিবাদী স্বর পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি৷ পর্তুগালের বিখ্যাত খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো রোহিঙ্গা শিশুদের কথা বিশ্বে তুলে ধরেন৷ পুরস্কার হিসাবে পাওয়া ‘সোনার বুট’ বিক্রি করে টাকা দান করেন ইজরায়েলের আক্রমণে বিপর্যস্ত প্যালেস্টাইনের শিশুদের কল্যাণে৷

শুধু ফুটবল নয়, অন্য খেলাতেও আছে একইরকম প্রতিবাদী চরিত্র৷ বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯৬৮–এর মেক্সিকো অলিম্পিকে ২০০ মিটার দৌড়ে পদক নেওয়ার সময় টম স্মিথ আর জন কার্লোস ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে ওঠেন কালো গ্লাভস আর খালি পায়ে৷ কালো মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছিল কালো মানুষদের ঐক্যের প্রতীক, আর খালি পা তাঁদের দারিদ্রের প্রতীক৷ বিখ্যাত বক্সার মহম্মদ আলি নিজের ক্রীড়াজীবন শেষ হয়ে যেতে পারে জেনেও মার্কিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে তিনি যাবেন না, কারণ এটি সাদা মানুষদের আধিপত্যবাদের লড়াই৷ শুধু তাই নয়, সম্প্রতি আমেরিকান প্রশাসনের বর্ণবিদ্বেষ মূলক আচরণ ও নীতির প্রতিবাদ করে আমেরিকার ফুটবল লিগের একটি খেলায় জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন না দাঁড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকেন খেলোয়াড় কলিন কায়োপারনিক৷ এ ছাড়াও নারীদের উপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার ও যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মঞ্চ হিসাবে ফুটবল মাঠকেই বেছে নেয় ইতালির ফুটবল সংস্থা৷

ফুটবল বড় প্রিয়,  বড় সুন্দর৷ সুবজ গালিচায় ইনসাইড–আউটসাইড ড্রিবলিং, একটা সুন্দর থ্রুতে শিল্প ফুটিয়ে তোলাই বড় খেলোয়াড়ের পরিচয়৷ কিন্তু জীবন তো ফুটবলের থেকেও বড়৷ তাই যখন সেই জীবনের ডাকে সাড়া দিয়ে খেলোয়াড়রা অন্যায়–ত্যাচার–বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়ান, মানবিকতার ডাকে সাড়া দেন, তখন তা ফুটবল আর জীবনকে মিলেমিশে আরও বড়, আরও সুন্দর করে তোলে৷

(৭০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৩ জুলাই, ২০১৮)