খরায় মরছে মানুষ, এম পি–রা মত্ত ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় মাকালী’ স্লোগানে

দেশের অর্ধেকের বেশি অংশ খরায় জ্বলছে, চাষিরা আকাশের দিকে তাকিয়ে হা–পিত্যেশ করে বসে আছেন, কখন বৃষ্টি নামবে৷ একটু পানীয় জলের জন্য মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ,  তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানার জেলার পর জেলায় হাহাকার উঠেছে৷ জলাধার, ড্যামগুলি পুরোপুরি শুকনো বললেই চলে৷ রাজস্থান সহ কিছু রাজ্যে ইতিমধ্যেই জলের অভাবে গবাদি পশুর মড়ক লেগেছে৷ এর সাথে মিলেছে বিহারের মজফফরপুরে অপুষ্টিজনিত রোগে দেড় শতাধিক শিশুর মৃত্যু মিছিল৷ এই পরিস্থিতিতে দেশের নবনির্বাচিত সাংসদদের থেকে মানুষ কী আশা করে?

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে লম্বা–চওড়া প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটানো সাংসদরা জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে সংসদে এই দুর্গত মানুষদের কথা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে তুলবেন, সরকারের কাছে তাঁরা দাবি জানাবেন, এই ভয়াবহ খরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুদ্ধকালীন তৎপরতা নিতে হবে৷ এটুকু আশা করা কি দেশের জনগণের পক্ষে খুব অন্যায়? সরকার পক্ষের সদস্যরা দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় তৎপর হবেন, বিরোধীরা যে শক্তি নিয়েই থাকুন না কেন, এই কাজ করার জন্য সরকারকে চেপে ধরবেন এই তো ছিল সাংসদ হিসাবে তাঁদের দায়িত্ব কিন্তু দেখা গেল, সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসা বিজেপি সাংসদরা দেশের সমস্যা ভুলে মত্ত রয়েছেন ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘মন্দির ওহিঁ বানায়েঙ্গে’ স্লোগানে৷ আর তাদের পাল্টা হিসাবে বিরোধী সাংসদরা মত্ত হলেন জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা, জয় হিন্দ, জয় ভারত, জয় বাংলা ইত্যাদি নানা স্লোগানেই৷ জয় ভীম থেকে আল্লা হো আকবরও বাদ রইল না৷ তারপর প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সব দলের সাংসদরা পাঁচতারা হোটেলে একযোগে ভুরিভোজে চলে গেলেন!

এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ তাঁদের চারপাশে হাত কচলে অনুগ্রহ ভিক্ষায় ঘুরঘুর করা ছোট–বড় নানা মন্ত্রী, শাসক দলের তিনশোর বেশি সাংসদ কারও বিবেকে একবারও বাধল না বিরোধী বলে যাঁরা জিতেছেন তাঁরাই বা কী করলেন? একদা গণতন্ত্রের পীঠস্থান বলে কথিত সংসদকে সার্কাসের ময়দানে পরিণত করতে কেউই তো কম যাননি এই সরকারের মন্ত্রীরা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার প্রমাণ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র শেখাওয়াত৷ তিনি নিজে জিতেছেন ভারতের সব থেকে বেশি খরাপীড়িত বলে পরিচিত রাজ্য রাজস্থান থেকে৷ রাজস্থানে হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণের রাজনীতির পুরস্কার হিসাবে মোদি সরকার তাঁকে মন্ত্রীও করেছে৷ সেই শেখাওয়াত সাহেবের মুখনিঃসৃত বাণী শুনলে দেশের মানুষের প্রাণ জুড়িয়ে যাবে৷ ১১ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, জল সঙ্কট, খরা এগুলি কিছু আতঙ্কিত লোক আর সংবাদমাধ্যমের কষ্টকল্পনা মাত্র (নিউজ ১৮ ডট কম, ১১ জুন ২০১৯৷ অথচ তাঁর সরকারই মে মাসে খরার হুঁশিয়ারি দিয়ে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারকে ‘বুঝে শুনে’ জল খরচের পরামর্শ দিয়েছিল৷ কেন্দ্রীয় জল কমিশন রাজ্যগুলিকে বলেছিল কেবলমাত্র পানীয় জল ছাড়া আর কোনও ভাবে নদীগুলির জলাধারের জল ব্যবহার করলে বড় বিপদের সামনে তারা পড়বে৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যেন জানতেনই না যে তাঁর নিজের মন্ত্রক বলেছে, দেশে বেশিরভাগ জলাধারে তার পূর্ণ মাত্রার ২০ শতাংশের নিচে জল আছে৷ আজ পরিস্থিতি এমন যে, আমেদাবাদ থেকে চেন্নাই পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রায় সমস্ত শহরে সকাল থেকে দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদির ডিজিটাল ভারত একেবারে রঙিন হয়ে উঠেছে কারণ নানা রঙের পাত্র নিয়ে পাড়ার মোড়ে মোড়ে দরিদ্র বস্তিবাসী থেকে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত একটু জলের আশায় লাইন দিয়েছেন৷ মোদিজি প্রচারিত ‘স্বর্গ’ গুজরাটের রাজধানী আমেদাবাদের মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে মহিলারা ঢুকে পড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন একটু জলের জন্য৷ কলসি ভেঙে তাঁরা ক্ষোভ জানিয়ে আসছেন প্রায় রোজই৷

আর গ্রাম? ১৯ জুন ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকা পশ্চিম, উত্তর, মধ্য থেকে দক্ষিণ ভারতের গ্রামীণ এলাকার কিছু চিত্র প্রকাশ করে দেখিয়েছে কী মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে মানুষ দিন কাটাচ্ছেন৷ জলের অভাবে বিদর্ভ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাডুর গ্রামের পর গ্রাম ছেড়ে মানুষ পালাচ্ছে৷ জলের অভাবে মাঠে ফসল শুকোতে দেখে আর ঋণের জ্বালায় শুধু মহারাষ্ট্রেই চার বছরে ১২ হাজারের বেশি চাষি আত্মহত্যা করেছেন৷ এই বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে যে সংখ্যা পৌঁছেছে ৮০৮–এ৷ কুয়ো শুকনো, নদীতে জল নেই, নলকূপ অকেজো৷ এই পরিস্থিতিতে বহু গ্রামে দিনে ৫০–৬০ টাকা খরচ করে মানুষকে পানীয় জল কিনতে হচ্ছে৷ সরকারি ব্যবস্থায় ট্যাঙ্কার আসছে একেবারেই যৎসামান্য৷ বেসরকারি কোম্পানিগুলি জলের ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠছে৷ সবার ‘বিকাশ’ করবেন যে নরেন্দ্র মোদি, তাঁর সরকার মানুষকে খাওয়ার জলটুকু দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হতে পারে না?

এই পরিস্থিতি যে আসতে চলেছে তা কি সরকারের অজানা ছিল? এ বছর প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় সমুদ্র জলের তাপমাত্রা বেশি থাকার (এল নিনো পরিস্থিতি) জন্য বর্ষার আগমন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বিজ্ঞানীরা বহু আগে থেকে বলেছেন৷ যদিও গত বর্ষা থেকে পরবর্তীকালে দেশের হাতে গোনা দু–একটি অঞ্চল ছাড়া বেশিরভাগ স্থানে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়েছে৷ ২০১৯–এ বর্ষা কম হতে পারে এই হুঁশিয়ারি প্রায় এক বছর আগে পেয়েও বৃষ্টির জল ধরে রাখার সহজ দেশীয় প্রযুক্তিগুলি নিয়ে সরকার যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিল না কেন? খরা পীড়িত এলাকার মানুষের বহু দিনের দাবি জোড় বাঁধ, নদী বাঁধ, পুকুর খনন, স্থানীয় ছোট ছোট নদী বা জলাশয়ের জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা৷ অথচ এগুলিতে জোর না দিয়ে সরদার সরোবরের মতো বিশাল বাঁধ–জলাধার তৈরিতেই সরকারের নজর বেশি৷ অবৈজ্ঞানিক এবং অপরিণামদর্শী পরিকল্পনার জন্য এই সব বড় জলাধারের কার্যকারিতা যে ক্রমাগত শেষ হয়ে যাচ্ছে তা সারা দেশের বিভিন্ন নদী প্রকল্পের শুকনো বাঁধ আর নদী খাতেই বারবার প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে৷ এই সমস্ত বাঁধ তৈরি করে বহুজাতিক কন্সট্রাকশন কোম্পানি আর কাটমানি খাওয়া আমলারা লাভ তুলতে পারেন৷ কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকার যখন মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায়, প্রতিবার নিয়ম করে বলে চাষিদের স্বার্থে আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া এর অন্যতম উদ্দেশ্য৷ কিন্তু দেখা যায় সেই পূর্বাভাস কাজে লাগিয়ে বহুজাতিক সার–বীজ–কৃষি সরঞ্জাম কোম্পানিগুলির লাভ আকাশছোঁয়া হয়ে যায়৷ চাষির চোখের জল মোছাতে কোনও ব্যবস্থা নেই৷

জলের ব্যবহার নিজেদের কুক্ষিগত করার জন্য অন্য দেশের মতো ভারতেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলি সেচের দায়িত্ব, পানীয় জলের দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে৷ পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কল্যাণে পুরুলিয়ায় এমন এক বিশাল জার্মান জলপ্রকল্পের কথা মানুষ জানে৷ যেটি ছিল ভারতে বহুজাতিক জলব্যবসার অন্যতম পাইলট প্রোজেক্ট৷ বিশ্বব্যাঙ্কের শর্ত মেনে জলের উপর কংগ্রেস, বিজেপি এমনকী তৃণমূল বা অতীতের সিপিএম সব সরকারই ট্যাক্স বসিয়েছে৷ কেউ কম কেউ বেশি এটুকুই যা পার্থক্য৷ এবারের খরা পরিস্থিতির সুযোগে মহারাষ্ট্র থেকে তামিলনাডু প্রায় সর্বত্রই প্রাইভেট জল ট্যাঙ্কারের উপরই মানুষকে বেশি ভরসা করতে হচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে৷

এই পরিস্থিতি যখন, সেই সময় এমপিরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে সংসদ মাতিয়ে কী বার্তা দিচ্ছেন দেশের কোটি কোটি তৃষ্ণার্ত মানুষকে? সংসদ কোনও ধর্মীয় স্লোগানের জায়গা নয়, এ কথা দলমত নির্বিশেষে মানুষ বলেছেন৷ নিন্দা করেছেন আমাদের সংবিধান এবং সংসদীয় গণতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার যে তকমাটুকু এখনও লেগে আছে তাকেও খসিয়ে ফেলে দেওয়ার এই ঘৃণ্য প্রচেষ্টার৷ কিন্তু বিজেপি এমন কাজ করল কেন? একথাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার৷

বিজেপি চেয়েছে একদিকে হিন্দি বলয়ে মানুষের মধ্যে রামকে নিয়ে থাকা আবেগ উস্কে খরা, বেকারি, আখেরদাম না পাওয়া চাষির কান্না প্রভৃতি সমস্ত জ্বলন্ত সমস্যাকে ধামাচাপা দিতে৷ তাই এত বিপুল সংখ্যা নিয়ে জিতেও মানুষের প্রধান সমস্যাগুলি নিয়ে সংসদে কোনও বক্তব্য তাদের নেই৷ অন্যদিকে সংখ্যালঘু মানুষকে বার্তা দেওয়া– এই ভারতের সংসদ তাদের নয়৷ এখানে তাদের জন্য বিজেপি সরকার কিছু করতেও পারে, কিন্তু তা পেতে হবে অধিকার হিসাবে নয়, দয়ার দান হিসাবে৷ তাই রাম নাম নিয়ে বিজেপির এই নোংরা খেলা৷ আর বিরোধী দিশাহারা কংগ্রেস থেকে তৃণমূল, সপা এদের কারও কাছেই এই মেরুকরণের, বিদ্বেষের রাজনীতির মোকাবিলা করার মতো আদর্শগত হাতিয়ার নেই৷ ফলে তারাও এই স্রোতে গা ভাসিয়ে ভাবছে বিজেপির থেকে বড় হিন্দু সেজে, কিংবা সংখ্যালঘু ত্রাতা সেজে যদি আবার ভোটব্যাঙ্ক ফিরে পাওয়া যায়৷ কিন্তু বলতে পারছে না, বিজেপি যদি ধর্মটাকেই ঠিক ঠিক মানত তাহলে খরায় জ্বলন্ত দেশ দেখেও, মজফফরপুরে শিশুমৃত্যু দেখেও ভোজসভা করতে সাংসদদের নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে ছুটত না৷ শাসক দলের এমপিদের নতুন নতুন বিলাসবহুল বাংলো পাইয়ে দেওয়ার জন্য সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ কিছুতেই করত না৷ কর্পোরেট প্রভুদের চটিয়ে এবং নিজেদের আখের গোছানোর রাজনীতি ছেড়ে বিরোধীরাও আলাদা রকম কিছু করতে ভয় পাবে জেনেই বিজেপি এত বেপরোয়া৷

এই পরিস্থিতিতে খরা পরিস্থিতির মোকাবিলায় একটি মাত্র পথই  খোলা, তা হল গণআন্দোলন৷ বহু জায়গায় সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলন শুরু করেছেন৷ যাকে দীর্ঘস্থায়ী সংগঠিত রূপ দিতে হবে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্যে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা)