কেন্দ্র ও রাজ্যের ‘উন্নয়ন’–এর ধাক্কায় মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস মানুষের

২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তাঁকে ক্ষমতায় বসালে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমিয়ে দেবেন৷

তাঁর ক্ষমতায় বসার পর তিন বছর পার হয়ে গেছে৷ দাম কমানো দূরে থাক জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে৷ শুধু রান্নার গ্যাসের দাম দেখলেই এর ভয়াবহতা টের পাওয়া যাবে৷ ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে গত ১ নভেম্বর পর্যন্ত ১৬ মাসে ১৯ বার বেডেছে দাম৷ কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত আগামী মার্চের মধ্যে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি তারা সম্পূর্ণ তুলে দেবে৷ পেট্রোল ও ডিজেলের দামও প্রতিদিন বাড়ছে৷ চালাকি করে সরকার প্রতিদিন এই দাম কিছু কিছু করে বাডিয়ে যাচ্ছে যাতে মানুষ এই দাম বাড়ার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ না হয়ে ওঠে৷ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে সরকার তেলের দাম বাড়ায়৷ অথচ যখন দাম কমেছে তখনও সরকার তেলের দাম একইভাবে বাডিয়ে চলেছে৷ ডিজেলের দাম বাডলে পরিবহণের খরচ বাড়ে, ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, কারণ ব্যবসায়ীরা বাড়তি খরচ নিজেদের পকেট থেকে দেয় না, ক্রেতাদের থেকেই আদায় করে৷

শুধুমাত্র রান্নার গ্যাস বা পেট্রোল–ডিজেল নয়, সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে৷ গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত অ্যাসোচেমের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে আটটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রায় ৭২ শতাংশ বেড়েছে৷ এই সমীক্ষা অনুযায়ী মশলার দাম বেডেছে প্রায় ১৫৮ শতাংশ, মাছ– মাংস–ডিমের দাম বেডেছে প্রায় ৭৯ শতাংশ, ডালের দাম বেডেছে প্রায় ৭৪ শতাংশ৷ এই সময়ের মধ্যে চা, কফি, গম, ফল ও শাকসবজির দাম বেডেছে যথাক্রমে প্রায় ৬৭ শতাংশ, ৬৩ শতাংশ এবং ৫৯ শতাংশ৷ দাম বেডেছে চাষের উপকরণ–বীজ–সার–কীটনাশকের৷ এগুলির মূল্য মূলত নির্ধারণ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি৷ সরকারও এসবের বাজার তাদের হাতেই ছেডে দিয়েছে৷ ফলে চাষের খরচ দিন দিন বাডছে, আর চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছে৷

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে মজুতদার, মুনাফাখোর ও কালোবাজারিরা৷ সরকারি সংস্থা কম্পিটিশন কমিশন অফ ইন্ডিয়াও বহুবার বলেছে ফাটকাবাজ–মজুতদাররা কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ায়৷ সব জেনেও কোনও সরকারই তাদের বিরুদ্ধে  ব্যবস্থা নেয় না৷ পেঁয়াজের দাম বাজারে ৫০–৬০ টাকা৷ অথচ কয়েক মাস আগে নাসিকের চাষিরা পাঁচ পয়সা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে৷ সরকার চোখ বুজে থেকেছে৷ কারণ নাসিকের পেঁয়াজ ব্যবসা নিয়ন্ত্রক পুঁজিপতিদের জোট সরকারি দলগুলির নির্বাচনী তহবিলে খরচ জোগায়৷ এ ব্যাপারে বিজেপি–কংগ্রেসে ফারাক নেই৷

কৃষি উপকরণের বিপুল দাম বাড়িয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি কৃষি ফসলের দাম বৃদ্ধির পথ প্রশস্থ করলেও কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মধ্যস্বত্বভোগী অর্থাৎ ফড়ে–মহাজনরা বহুলাংশে দায়ী৷ এস ইউ সি আই (সি) দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করার৷ কিন্তু কোনও সরকারই সে দাবিতে কান দেয়নি৷ কারণ তাদের কাছে জনগণের স্বার্থের থেকে এই সব মুনাফাখোরদের স্বার্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই চাষিরা হাজারে হাজারে আত্মহত্যা করলেও কংগ্রেস সরকারের মতোই বিজেপি সরকারও মুনাফাখোরদের হাতেই বাজার ছেডে রেখেছে৷ যখন ফসল ওঠে সরকার চাষিদের থেকে সরাসরি ন্যায্যমূল্যে ফসল কিনে নেয় না৷ চাষিরা অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়৷ বাধ্য হয় আত্মহত্যা করতে৷

গত বছর জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে একটি টাস্ক্ ফোর্স গঠন করেছিল৷ মুখ্যমন্ত্রীও দু’একটি বাজারে হানা দিয়েছিলেন৷ রাজ্যের মানুষ ভেবেছিল, বোধহয় কালোবাজারি–মজুতদারির দিন শেষ হল৷ কোথায় কী এ সবই লোক দেখানো৷ দুদিন পরে কারও দেখা নেই– না টাস্ক ফোর্সের, না মুখ্যমন্ত্রীর৷ সরকার এখানে ওখানে কয়েকটি স্টল খুলে জিনিস বিক্রির ব্যবস্থা করে দেখাতে চাইল তারা মূল্যবৃদ্ধি রোধে পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই তা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে পারেনি৷ এ বছরও সরকারের ভূমিকা শুকনো বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ যেমন রাজ্যে ডিম নিয়ে ফাটকাবাজি শুরু হলে সরকার সাড়ে চার টাকার ডিমকে ছ’টাকায় বেঁধে দিল৷ গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করল, বাজারে  দাম বেশি হলে কম দামে সরকারি দোকান থেকে কিনতে পারেন ক্রেতারা৷

বাস্তবে কী কেন্দ্রীয় সরকার কী রাজ্যসরকারগুলি– সকলেই জনস্বার্থের প্রতি উদাসীন৷ তারা পুঁজিপতিদের সেবায় নিয়োজিত৷ নির্বাচন এলেই সরকারি দলগুলি মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা বলে৷ তার একমাত্র উদ্দেশ্য জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে ভোট পাওয়া৷ বাস্তবে পাইকার–আড়তদার–কালোবাজারি-সরকারি নেতা–মন্ত্রীদের মধ্যে গড়ে ওঠা চক্রই এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী৷ সরকারি নেতা–মন্ত্রীদের মিষ্টি কথায় ভুললে চলবে না৷ এমন মিষ্টি কথা গত সাত দশক ধরে সরকারি নেতা–মন্ত্রীরা একই কায়দায় বলে আসছেন৷ চাই তীব্র গণআন্দোলন৷ চাই সেই গণআন্দোলনে মূল্যবৃদ্ধির যাঁতাকলে পিষ্ট জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ৷ একমাত্র তেমন গণআন্দোলনের চাপই এই সব প্রতারক নেতাদের বাধ্য করতে পারে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে৷ এই রাস্তাতেই যেতে হবে মানুষকে৷