কৃষক বিক্ষোভে উত্তাল রাজধানী

নানা রাজ্য থেকে আসা প্রায় দেড় লক্ষ কৃষকের পদধ্বনিতে কাঁপছে দিল্লি। হাজারো বাধায় তাদের দিল্লি অভিযান আটকাতে পারল না বিজেপি সরকার। ২২০টির বেশি কৃষক সংগঠনের যুক্ত মঞ্চ অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটি (এআইকেএসসিসি)-র নেতৃত্বে জীবন বাজি রেখে দিল্লি এসেছেন তাঁরা দাবি আদায় করতে। বলছেন, ‘চাহে কিতনা পানি ডালো, ইসসে যাদা তো হম পসিনা বহা চুকে’– যত খুশি ঢালো জলকামানের জল, তার চেয়ে ঢের বেশি ঝরিয়েছি আমাদের ঘাম! দাবি তুলেছেন, নতুন কৃষি আইন বাতিল করো, না হলে অচল করে দেব দেশের রাজধানী।

এআইকেএসসিসি, যার অন্যতম শরিক এআইকেকেএমএস ২৬ নভেম্বর ভারত বনধের অন্যতম অংশীদার ছিল। তারা আগেই ঘোষণা করেছিল ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রাজধানী দিল্লিতে পার্লামেন্ট অভিযান করবে। এই গণতান্ত্রিক কর্মসূচিটুকুও করতে দিতে রাজি নয় কেন্দে্রর বিজেপি সরকার। দিল্লির সমস্ত প্রবেশপথগুলিতে ব্যারিকেড তৈরি করে কৃষকদের আটকে দেয় পুলিশ। বনধের আগের দিন ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হয় কৃষক সংগঠনগুলির নেতাদের গ্রেপ্তারি। বাড়ি বাড়ি ঢুকে হামলা চালাতে থাকে পুলিশ। বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হল এআইকেকেএমএস নেতা হরিয়ানা রাজ্য সম্পাদক কমরেড জয়করণকে। অন্যান্য সংগঠন মিলিয়ে শতাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকার ভেবেছিল, গ্রেপ্তারেই শেষ করে দেওয়া যাবে আন্দোলন। ভয় পেয়ে যাবেন কৃষকরা। কিন্তু না, সমস্ত ভয় ভীতি তুচ্ছ করে প্রায় দেড় লাখ চাষি দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাসে, ট্রাক্টরে, পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন পার্লামেন্টের উদ্দেশে।

দিল্লির আগেই মিছিল রুখে দিতে হরিয়ানার বিজেপি সরকারের পুলিশ পানিপথ ও সোনেপতের মধ্যে বিভিন্ন রাস্তা কেটে দিয়েছে, গর্ত করে দিয়েছে, বহু জায়গায় বালির বস্তা দিয়ে, লোহার ব্যারিকেড দিয়ে পথ আটকে দিয়েছে। বহু ব্রিজের উপর ট্রাক-লরি আড়াআড়িভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। টিয়ারগ্যাস চার্জ করে, জলকামান ব্যবহার করে কৃষকদের দাবিকে স্তব্ধ করতে নেমেছে। উত্তরপ্রদেশ সরকার মধ্যপ্রদেশ সীমান্তে চাষিদের ৬৮ ঘণ্টা আটকে রাখে। দিল্লিতে ন’টি স্টেডিয়ামকে জেলখানা বানিয়ে তাতে কৃষকদের ঢোকানোর ঘৃণ্য চেষ্টা চালিয়েছে তারা। কিন্তু বিজেপি সরকারের সমস্ত বর্বরতা মোকাবিলা করেই কৃষকরা সামিল হয়েছেন দিল্লির বুকে অভিযানে। দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে কৃষকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এআইকেকেএমএস-এর সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড সত্যবান ঘোষণা করেছেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের দিল্লি চলো ডাকে যেমন করে হাজার হাজার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেভাবেই এই ডাকে সাড়া দিয়েছেন কৃষকরা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড শংকর ঘোষ কৃষকদের এই দৃঢ়তার জন্য তাঁদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়েছেন।

উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান সীমান্তে হাইওয়ের উপর কৃষক-ধরনায় উপস্থিত অল ইন্ডিয়া কিষান খেতমজদুর সংগঠনের প্রতিনিধি কমরেড সুনীল গোপাল

মোদি সরকারের তিনটি কৃষি আইনে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, গম, ভোজ্যতেল, তৈলবীজ ইত্যাদিকে যত ইচ্ছে মজুতের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ও অত্যাবশ্যক তালিকা থেকে এগুলিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মজুতদার কালোবাজারিরা চাষির কাছ থেকে সস্তায় কেনার পর এই সব জিনিসের দাম লাগামছাড়া বাড়াচ্ছে। কৃষিপণ্য কেনায় বৃহৎ পুঁজিপতিদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। চুক্তিচাষকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে সরকারের আর কৃষিপণ্য কেনার দায় থাকছে না। বাজার দখল করবে বৃহৎ পুঁজিপতিরা। ধূর্ত বিজেপি সরকার বলছে, এর ফলে চাষিরা ন্যায্য দাম পাবে। কিন্তু কৃষকরা জীবনের অভিজ্ঞতায় বোঝেন, এর ফলে বৃহৎ পুঁজির বৃহৎ শোষণের কবলেই তাঁদের পড়তে হবে। তাই কৃষকরা এত ক্ষুব্ধ। মোদি সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও এর দ্বারা কার্যত তুলে দিল। ফলে কর্পোরেট মালিকদের দয়াতেই এবার বাঁচতে হবে চাষিকে।

মধ্যপ্রদেশে কৃষক বিক্ষোভে উপস্থিত মেধা পাটকর

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী)-২০২০। এই আইন কার্যকর হলে বিদ্যুৎ আর পরিষেবা থাকবে না, হবে পণ্য। লাফিয়ে বাড়বে বিদ্যুতের দাম। সেচের খরচ বাড়বে। এমনিতেই কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পায় না। এই সব আক্রমণে চাষির পিঠ দেওয়ালে ঠেকছে। ফলে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর পথ নেই। বাস্তবে সেটাই ঘটছে।

কৃষকরা জানে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী এই বিজেপি সরকার সহজে কৃষকের দাবির কোনও মূল্য দেবে না। তাই দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের প্রস্তুতিই নিয়েছে কৃষকরা। লরি-ট্রাক্টরে খাদ্য সামগ্রী মজুত করেই তারা রওনা দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, কেরালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্য থেকে হাজার হাজার কৃষকের স্রোত পুলিশি বাধা ভেঙে দিয়ে আছড়ে পড়েছে রাজধানীর বুকে।

দিল্লি অভিযানের ডাকে সাড়া দিয়ে হরিয়ানার মানসা জেলার কৃষক ধানা সিং রওনা দিয়েছিলেন। ভিওয়ানিতে এক দুর্ঘটনায় তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। সংঘর্ষ কমিটির নেতৃবৃন্দ তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। চাষিরা সদর্পে বলেছেন, সমাবেশ থেকে করোনা সংক্রমণের ভয় দেখিও না আমাদের। ধরে নাও সর্বনাশা কৃষি আইনের প্রতিবাদে এখানে আত্মহত্যাই করতে এসেছি আমরা।

আন্দোলনরত কৃষকদের উপর বিজেপি সরকারের পুলিশি আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এসইউসিআই(সি) সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। তিনি এই বর্বরতার বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে সর্বত্র প্রতিবাদে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য রাজ্যের সর্বত্র প্রতিবাদ কর্মসূচি নেওয়ার বার্তা পাঠিয়েছেন।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১১ সংখ্যা_২৭ নভেম্বর, ২০২০)