কৃষক কল্যাণে প্রধানমন্ত্রীর বাগাড়ম্বর

সরকারে আসার পাঁচ বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গ সফর করে গেলেন মেদিনীপুর শহরে জনসভার মধ্য দিয়ে৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনের মহড়া এটি৷ কর্মসূচির অগ্র–পশ্চাতেও বলছে সেই কথাই৷ বিজেপি–কংগ্রেস সহ ভোটবাজ দলগুলির কল্যাণে এমন একটা ধারণা তো জনমনে বদ্ধমূল হয়েই আছে যে, নির্বাচনের আগে ‘জনকল্যাণ’ ও ‘দেশপ্রেমের’ বন্যা বইতে থাকে৷ আর ক্ষমতার দখল পেলেই সম্পূর্ণ উল্টে গিয়ে পুঁজিপতিদের কল্যাণে মরিয়া হয়ে ওঠে ক্ষমতালোভী দলগুলি৷ লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে, তাই এখন জনদরদের পরাকাষ্ঠা দেখতে থাকবে দেশবাসী৷

২০১৪ নির্বাচনের আগে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে বিজ্ঞাপন সংস্থার দ্বারা একের পর এক জনকল্যাণকামী প্রচারে দেশকে ভাসিয়ে দিয়েছিল বিজেপি৷ প্রধানমন্ত্রীর এখন আবার মনে পড়ছে কৃষকদের কথা৷ কারণ ভোটদাতাদের সিংহভাগই কৃষিনির্ভর৷ তাই সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে ফসলের সহায়কমূল্য বাড়ানোর কথা৷ আর তার পরেই মেদিনীপুরে বিপুল খরচ করে আয়োজন করা হয়েছিল ‘কৃষক কল্যাণ সমাবেশ’৷

মঞ্চে আড়ম্বর করে কৃষকের টুপি মাথায় পরিয়ে প্রতীকী লাঙল তুলে দেওয়া হল প্রধানমন্ত্রীর হাতে৷ কৃষক কল্যাণের ফিরিস্তি শুনিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, চাষিদের আর আত্মহত্যা করতে হবে না–কুইন্টাল প্রতি ধানে ২০০ টাকা, ভুট্টায় ৩০০ টাকা ইত্যাদি হারে তাঁর সরকার সহায়ক মূল্য বাড়িয়েছেন৷ এই সব বলে তিনি ‘অপারেশন গ্রিন’ নামে একটি প্রকল্পের ঘোষণা করে গেলেন৷ মাছ চাষ, মৌমাছি পালন ইত্যাদির মাধ্যমে ‘ব্লু রেভলিউশন’ ঘটানোর প্রকল্পও তিনি হাজির করেছেন ওই মঞ্চে৷ এসব দিয়ে কোটি কোটি কৃষকের আয় যে বাড়ে না তা প্রধানমন্ত্রীও ভাল জানেন৷ কিন্তু ভোটার ধরতে ‘কৃষক কল্যাণে’র ছদ্মপ্রীতি তাঁকে দেখাতেই হচ্ছে৷

বাস্তবে কৃষি ফসলের সহায়ক মূল্য ঘোষণা কৃষকদের প্রতি একটি মস্তবড় ধাপ্পা৷ সরকার কতটুকু ফসল কেনে? নেতা–মন্ত্রীরা সংবাদমাধ্যমে প্রচার দিয়ে দু–এক জায়গায় ধান, গম ইত্যাদি কেনার নাটক করে৷ তার পরে ফড়ে এবং মিল মালিকরা চাষিদের কব্জা করে লুঠ চালায়৷ সরকারি তথ্য বলছে, গত বছর জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া পাট কিনেছে মাত্র ১.৯ শতাংশ৷ বাকি ৯৮.১ শতাংশ লুঠ করল কারা? এ হিসাব কোনও দিন সরকারি ঘোষণায় মিলবে না৷

মেদিনীপুর জেলাতে মিটিং করে গেলেন প্রধানমন্ত্রী৷ এই জেলার শিলাবতী নদী সংস্কার না হওয়ায় ফি–বছর ঘাটাল পৌরসভা পর্যন্ত জলের তলায় চলে যায়৷ মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণের জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর স্থানীয় বানভাসি মানুষ দাবি তুলে আন্দোলন করে আসছে৷ দিল্লি অভিযান পর্যন্ত করছে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার একটি পয়সাও বরাদ্দ করেনি৷ জেলার কাঁসাই, শিলাবতীর বন্যায় লক্ষ লক্ষ চাষি পরিবার প্রতি বছর সর্বস্বান্ত হয়ে যায়৷ এই তো ‘কৃষক কল্যাণ’৷

যখন প্রধানমন্ত্রী সভায় কৃষক কল্যাণের মহড়া দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময়েই মেদিনীপুরের এগরায় চাষিরা তাদের রক্ত জল করা ফসল কুইন্টাল কুইন্টাল চিনা বাদাম, লঙ্কা রাস্তায় ঢেলে পুড়িয়ে আর্তনাদ করছে৷ বাঁচার জন্য ন্যায্য দামটুকু চেয়েছে সরকারের কাছে৷ কিন্তু কোথায় কী? মহারাষ্ট্রে দুধ উৎপাদকরা ন্যায্য দাম না পেয়ে ট্যাঙ্কার ট্যাঙ্কার দুধ রাস্তায় ফেলে দিয়ে হাহাকার করছে৷ উৎপাদকদের কাছ থেকে ১৭ টাকা লিটার দরে কিনে ডেয়ারি মালিকরা শুধু প্যাকেটজাত করে সেই দুধ বিক্রি করছে ৪২ টাকায়৷ ‘গো মাতার রক্ষক’ সরকারের চোখে ঠুলি, কানে তুলো৷ অথচ ওই মহারাষ্ট্রেই বিজেপি সরকারের বিধানসভাতে দেওয়া তথ্য হল– মাত্র গত তিন মাসে ঋণের দায়ে ৬৩৯ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন৷ গত বছরে আত্মঘাতী হয়েছে ১৫০০ জন৷ গত ৪ বছরে সংখ্যাটা ১৩ হাজারের বেশি৷ (বর্তমান ১৫.০৬.’১৮)৷ বিপ্লবী মেদিনীপুরকে কুর্নিশ করে তিনি সভা শুরু করেছিলেন৷ ঠিক যেমন ২০১৪তে ভোটে জিতে লোকসভায় প্রথম প্রবেশের দিন তিনি মহাভক্তিভরে লোকসভা মন্দিরকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানিয়েছিলেন৷ তা যে নিছক লোক ঠকানো ছিল–এ কথা কে না জানে? মেদিনীপুরের সভায় কৃষক কল্যাণ কিংবা বিপ্লবীদের স্মরণ করা নিয়েও মানুষ বলেছে– ভণ্ডামিরও একটা সীমা থাকে!

(৭০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা ২৭ জুলাই, ২০১৮)