কৃষক আন্দোলন প্রমাণ করছে জনগণই আসল শক্তি

প্রধানমন্ত্রী নাকি এখন কৃষক নেতাদের একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করছেন? আলোচনায় বসার জন্য তিনি নাকি তৈরি! দেড় বছরের জন্য কৃষি আইন স্থগিতের কথা বলতে হচ্ছে তাঁকে! প্রমাণ হচ্ছে, চরম উদ্ধত, অগণতান্ত্রিক একটা সরকারের কানে জল ঢোকাতে পেরেছেন কৃষকরা। অনেক মূল্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই পরিকল্পিত মৌনতা ভাঙতে তাঁরা বাধ্য করেছেন। কিন্তু শুধু এর জন্য তাঁরা দু’মাসের বেশি খোলা আকাশের নিচে বসে থাকেননি। যে ১৫০-র বেশি কৃষক প্রবল ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যু বরণ করলেন তবু বাড়ি ফিরে গেলেন না, যাঁরা আন্দোলনেকে আরও উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে আত্মাহুতি দিলেন, তাঁরা তো এইটুকু শুকনো প্রতিশ্রুতির জন্য প্রাণ বলিদান দেননি। তাই কৃষকরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কোনও টালবাহানা নয়, তিন কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল-২০ অবিলম্বে বাতিল বলে ঘোষণা করো। অবিচল নিষ্ঠায় আন্দোলনের সংকল্পে অটল থাকা কৃষক সমাজ নিশ্চিত, এই দাবি তাঁরা আদায় করবেনই। তাঁরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, সরকারের অত্যাচার, অপপ্রচার, পুলিশের লাঠি, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের টাকার জোরে বিকিয়ে যাওয়া মন্ত্রী-নেতা-প্রশাসনযন্ত্র-সংবাদমাধ্যম-গুণ্ডাবাহিনী কেউ শেষ কথা বলে না। বলে, জনগণের সংগঠিত শক্তি। শেষ কথা বলতে পারে সচেতন সংঘবদ্ধ গণজাগরণ।

কেন্দে্রর বিজেপি সরকার ভেবেছিল অপপ্রচার, পুলিশি জুলুম আর আরএসএস-বিজেপির গুণ্ডাবাহিনীর তাণ্ডবেই ভেঙে যাবে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন। ২৬ জানুয়ারি কৃষক প্যারেডের বদনাম করতে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার কম কিছু করেনি। তাদের ধামাধরা কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমও প্রচার করে গেছে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাকেই। অথচ লক্ষাধিক কৃষকের ট্রাক্টর প্যারেড ওই দিন যে শৃঙ্খলা এবং দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে গণআন্দোলনের ইতিহাসে তা অনন্য। ২৬ জানুয়ারি লালকেল্লায় একেবারেই বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনাকেই প্রচারের প্রধান বিষয় করে তুলে বিজেপি সরকার ভেবেছিল তারা এই সুযোগে কৃষক আন্দোলন ভেঙে দিতে পারবে। ভেবেছিল দেশের সাধারণ মানুষের দেশপ্রেমের বোধকে ভুল পথে চালনা করে সস্তা প্রচারের ঝড় তুলতে এবারও ওরা সফল হবে। কিন্তু সত্য চাপা দিতে পারেনি ওরা। যেমন পারেনি এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনকে ভেঙে দিতে।

বিপরীতে দেখা গেল ২৮ জানুয়ারি ভোর থেকেই উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার কৃষক ট্রাক্টারে, বাইকে মিছিল করে চলেছেন ধরনা অভিমুখে। উত্তরপ্রদেশের জেলায় জেলায় হাজার হাজার কৃষক রাত জেগে মহাপঞ্চায়েতে যোগ দিয়েছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লাঠি চলুক, গুলি চলুক, সরকার যত দমন পীড়ন চালাক, আন্দোলন থেকে তাঁরা পিছু হটবেন না। ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই গাজিপুর-দিল্লি সীমান্ত জনসমুদ্রের রূপ নিয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রতিটি ঘর থেকে অন্তত একজন সামিল হবেন ধরনায়। একই ভাবে এগিয়ে এসেছেন রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড, বিহার সহ প্রায় সারা ভারতের কৃষক। সিংঘু এবং টিকরি বর্ডারও একইভাবে জনসমুদ্রের আকার নিয়েছে। আন্দোলনের খবর যাতে না ছড়ায় তার জন্য সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে দিল্লি সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকায়। দমেননি কৃষকরা, তাঁরা মন্দির মসজিদের মাইক ব্যবহার করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন আন্দোলনের বার্তা। ক্রমাগত বেড়েই চলেছে আন্দোলকারী কৃষকের সংখ্যা।

নতুন করে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দেশের অগণিত কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র যুব। সংযুক্ত কিসান মোর্চা এবং এ আই কে কে এম এস নেতৃবৃন্দ সমগ্র কৃষক সমাজ তথা দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সমস্ত মানুষের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের চক্রান্ত ব্যর্থ করে যে আন্দোলন আবার নতুন শক্তিতে মাথা তুলেছে তাকে বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সংকল্পে অটল থাকতে।

আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা সরকার এবং আরএসএস-বিজেপি শুরু থেকেই করেছে। নভেম্বর মাসের শেষেই কৃষকরা যখন দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন, তাঁদের আটকাতে দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধেই কার্যর্ত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের আরএসএস-বিজেপি পরিচালিত রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁদের দিল্লির সীমান্তেই আটকে দিতে রাস্তা কেটে দিয়েছে, বিশাল ব্যারিকেড তৈরি করেছে পুলিশ। কৃষকরা পুলিশের মারে ক্ষত-বিক্ষত দেহ কিন্তু সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ সজীব মন নিয়েই অবস্থান চালিয়ে গেছেন ওই দিল্লি সীমান্তের অঞ্চলগুলিতেই।

২৬ জানুয়ারি সরকারের মদতেই তৈরি কিছু ঘটনা নিয়ে সরকারি প্রচারের তোড়ে কৃষকরা সামান্য থমকে গিয়েছিলেন। যার সুযোগে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার ২৭ জানুয়ারির মধ্যেই পুলিশের লাঠির জোরে গাজিপুরে কৃষক ধরনা ভেঙে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল। জল, আলো, বন্ধ করে দিয়ে, খাবার পেতে বাধা দিয়ে ভেবেছিল কৃষকদের মনোবল ভেঙে দেবে। পুলিশ এসে গাজিপুরে আদেশ জারি করেছিল, অবিলম্বে ধরনাস্থল খালি করে দিতে হবে। হরিয়ানা থেকে দিল্লি ঢোকার অন্যতম পথ সিংঘু এবং টিকরি সীমান্তে, যেখানে দু’-মাসেরও বেশি সময় ধরে কৃষকরা তাঁদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন, সেখানেও দিল্লি এবং হরিয়ানা পুলিশ হুমকি দিয়েছিল অবিলম্বে ধরনা তুলে নিয়ে এলাকা খালি করতে হবে। বর্বরতা এখানেই শেষ নয়, আরএসএস-বিজেপি বাহিনী পুলিশের উপস্থিতিতে কৃষকদের উপর বোমা ছুঁড়েছে, পাথর ছুঁড়েছে, মহিলাদের তাঁবুগুলিতে পর্যন্ত হামলা চালিয়েছে। তারা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেছে, দিল্লি পুলিশ আমাদের সাথেই আছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে চলা দিল্লি পুলিশ কর্তৃপক্ষও তার কোনও প্রতিবাদ করেনি। বরং তারা কৃষকদের উপরেই লাঠিচার্জ করেছে। কৃষক আন্দোলনকারীকে মাটিতে ফেলে পুলিশ যে ভাবে বুট দিয়ে পিষেছে, তা মার্কিন বর্ণবিদ্বেষী পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডকেই মনে করিয়ে দিয়েছে। কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা দিয়েছে, তাঁদের নামে ‘লুক আউট’ বা নজরবন্দির নোটিস জারি করেছে। কৃষক আন্দোলন এবং তার উপর সরকারের অত্যাচারের সংবাদ যাতে না প্রকাশিত হতে পারে তার জন্য প্রশাসন কৃষক ধরনা এলাকাগুলিতে ইন্টারনেট পরিষেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে শুধু তাই নয়, সাংবাদিকদের উপর শুরু করেছে নিপীড়ন। রাজদীপ সারদেশাই, মৃণাল পাণ্ডে সহ ৬ জন সিনিয়ার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা দেওয়া হয়েছে। ‘দ্য ওয়্যার’ পোর্টালের প্রধান এবং ভারত বিখ্যাত সাংবাদিক সিদ্ধার্থ বরদারাজনের বিরুদ্ধেও মারাত্মক অভিযোগে মিথ্যা মামলা করেছে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ। সিংঘু বর্ডারের কৃষক ধরনার উপর যারা ‘স্থানীয় গ্রামবাসী’ সেজে হামলা চালিয়েছিল, তারা যে আসলে নানা রাজ্য থেকে জড়ো হওয়া আরএসএস-বিজেপি কর্মী– এই সত্য তুলে ধরার পরেই সাংবাদিক মনদীপ পুনিয়া ও ধর্মেন্দ্র সিংকে গ্রেপ্তার করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় পুলিশ। ধর্মেন্দ্রকে পরে ছেড়ে দিলেও মনদীপকে জেলে ভরেছে তারা। বর্বরতায় যুদ্ধক্ষেত্রকেও ছাড়িয়ে গেছে বিজেপি সরকারের প্রশাসন।

এই বর্বরতাকে উপেক্ষা করেই গ্রামবাসীরা কৃষকদের জন্য খাবার নিয়ে, জল নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন ধরনা স্থলে। যে স্বেচ্ছাসেবকরা কৃষকদের খাবার, জল, ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ তাদের আটকে দিচ্ছে, এমনকি গ্রেপ্তারও করছে। জলের ট্যাঙ্কার পর্যন্ত যেতে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু জনগণের থেকেই রসদ পাচ্ছে কৃষক আন্দোলন। সে রসদ শুধু খাবার কিংবা জলেই সীমাবদ্ধ নয় আসল রসদ তাঁরা পাচ্ছেন জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন, ভালবাসা, সহমর্মিতার মধ্যে। আন্দোলনের ময়দানে প্রজ্জ্বলিত সংগ্রামের অগ্নিশিখায় পুড়ে খাঁটি আর দৃঢ় হয়ে উঠছে এই সব ইস্পাত। আন্দোলন তৈরি করছে নতুন নেতৃত্বের আকাঙক্ষা। ভোটবাজ সংসদীয় দলগুলির যে নেতারা রোজ কাগজে, টিভিতে, টুইটারে বিরাজ করেন, তাঁদের প্রবেশাধিকার দেয়নি কৃষক আন্দোলন। আন্দোলনের মধ্যেই জনগণ তার নেতা তৈরি করছে। খুঁজে চলেছে প্রকৃত পথ।

এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে জনগণের প্রকৃত শক্তি কী হতে পারে! দেখিয়ে যাচ্ছে ভোটের বাক্সে রঙ-বেরঙের নেতা আর দল পাল্টে নয়, অধিকার অর্জন করতে গেলে এই মাটিতে দাঁড়িয়েই লড়তে হবে মানুষকে। দেখিয়ে যাচ্ছে বুর্জোয়া গণতন্তে্রর অন্তঃসারশূন্য দশাকে। যেখানে লক্ষ লক্ষ কৃষকের দু’মাস ধরে ধরনা, দেড় শতাধিক মৃত্যু, শত শত মায়ের চোখের জল, পরিবারের হাহাকার, কোনও কিছুই গণতন্তে্রর তথাকথিত রক্ষক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কর্ণধারদের বিচলিত করে না। যে কৃষকরা দেশের সকল কৃষক, সকল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষার দাবি তুলে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শান্তিপূর্ণভাবে, দেশের সরকার তাদেরই বলে দেশদ্রোহী! ওদের কাছে দেশ মানে দেশের জনগণ নয়। ওদের কাছে দেশ হল মুষ্টিমেয় কর্পোরেট পুঁজি মালিক। দেশের স্বার্থ মানে ধনকুবেরদের স্বার্থ!

ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন জন্ম দিয়েছে এক উন্নত নৈতিকতার। যে নৈতিকতা নিয়ে একদিন ভগৎ সিংয়ের মা সন্তানকে ফাঁসির দড়ি পরার আগে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে বলেছিলেন, সে নৈতিকতার ছাপ আজ কৃষক আন্দোলনে পড়েছে। লড়ছেন যাঁরা মাসের পর মাস, তাঁদের পরিবারের অভাব, চাষ করতে না পারা, এমন শত সমস্যা আছেই, তবু সব ভুলে লক্ষ লক্ষ মানুষ একই লক্ষ্যে অবিচল– সকলের জন্য দাবি আদায় করেই তাঁরা ঘরে ফিরবেন। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জনজোয়ারের জন্ম হয়েছে তার অভিজ্ঞতায় তাঁরা নিশ্চিতভাবে অনুভব করছেন, শুধু আইন বাতিলের দাবি আদায় করলেই হবে না, দেশের জল-মাটি-সম্পদকে নিজেদের তাঁবে দখল করে রেখেছে যে পুঁজিপতি শ্রেণি, তাদের স্বার্থে চলা এই বুর্জোয়া গণতন্তে্রর মুখোশটা খুলে দিতে হবে। সেই কাজটা অনেকটাই করে চলেছে এই আন্দোলন। একে আরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে হলে দেখিয়ে দিতে হবে, একজন বা দু’জন কোনও পুঁজিপতি কিংবা কর্পোরেট মালিক নয়, গোটা বুর্জোয়া ব্যবস্থাটাই তাঁদের লুঠ করছে। সেই ব্যবস্থাকেই সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলে শোষণহীন নতুন সমাজের প্রস্তুতিতে এই আন্দোলন একটা দিশা হয়ে থাকবে।