কৃষকদের মমত্ব তেজস্বিতা কষ্টসহিষ্ণুতা মনকে নাড়া দেয় (আন্দোলনের ময়দান থেকে)

আন্দোলনের ময়দান থেকে

ডাঃ স্বপন বিশ্বাস ও আমি ডাঃ কল্যাণব্রত ঘোষ মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার ( এমএসসি) ও সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম (এসডিএফ)-এর তরফে দিল্লির সংগ্রামরত কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে সিংঘুতে পৌঁছই ১৬ ডিসেম্বর ২০২০। দিল্লি থেকে সিংঘু প্রায় ২৪-২৫ কিমি রাস্তা। আমরা যে ট্যাক্সিতে গিয়েছিলাম তার ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, তিনি এই আন্দোলনের সমর্থক। তিনি জানালেন, দিল্লিতে ঢোকার বেশিরভাগ রাস্তা বন্ধ থাকায় শহর অনেকটাই ফাঁকা। বললেন, লোকজন কম থাকায় তাঁর মতো অনেকেরই উপার্জন কমে গেছে। তা সত্ত্বেও দিল্লির সাধারণ মানুষ এই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে।

সিংঘুতে পৌঁছে আমরা রোগী দেখা শুরু করলাম। আমি মূল ক্যাম্পে রোগী দেখার দায়িত্ব নিলাম আর স্বপনদা নিল ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পের আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা– সারাক্ষণ রোগী দেখেছি। সারাদিনে মূল ক্যাম্পে প্রায় ২০০-র উপরে এবং ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পে ৫০-এর উপরে রোগী আসতেন। প্রতিদিন সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছিল। দিনের শেষে ডাঃ অংশুমান মিত্র আমাদের সবাইকে নিয়ে বসতেন সারাদিনের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও পরের দিনের পরিকল্পনা করতে। ফার্মাসিতে স্নাতক পাঞ্জাবের এক মেয়ে আন্দোলনে এসেছিলেন, মোবাইল ক্যাম্পের যোগাযোগের মাধ্যমে। মেয়েটি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। আরও দু’জন যুবক একইভাবে আমাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান।

মূলত সর্দি-কাশি, গ্যাসট্রাইটিস, হাঁপানি, জ্বর, প্রস্রাবে ইনফেকশন, ফাংগাল ইনফেকশন, আর্থ্রাইটিস, অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস, অনিদ্রা, কাটা-ছেঁড়ার আঘাত ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসতেন। তার সাথে বেশ কিছু উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস মেলিটাস, ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ-এর রোগী, যাঁরা মূলত তাঁদের ওষুধ ফুরিয়ে যাওয়ায় সেটা পেতে আসতেন। এ ছাড়া বেশ কিছু মাঝবয়সী ও যুবক কৃষক আসতেন ওপিয়াম নেশার উইদড্রয়াল লক্ষণ নিয়ে। এঁরা খুব কষ্ট পেলেও আন্দোলন ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না। তবে পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা এত ভাল যে, ডায়েরিয়ার রোগী ছিল খুব কম।

করোনা নিয়ে বলতে গেলে কৃষকরা বলতেন, মোদি সরকার করোনা ভাইরাসের থেকে ভয়ানক। তারা মনে করেন করোনা তাদের কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। এই আন্দোলনে প্রচুর বয়স্ক মানুষ এসেছেন। মহিলা আন্দোলনকারীর সংখ্যাও কম নয়। একজন ৬২ বছর বয়সী মহিলার চিকিৎসা আমরা করেছি যিনি হাই ব্লাড সুগার ও প্রেসারের রোগী এবং পায়ের ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে আন্দোলনের ময়দানে এসেছেন এবং এই ঠাণ্ডায় খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন।

অপপ্রচার হচ্ছে যে এই আন্দোলন মূলত ধনী কৃষকদের আন্দোলন। কিন্তু কথা বলে দেখেছি, শতকরা ৮০-৯০ ভাগ কৃষকই ক্ষুদ্র এবং মধ্য চাষি, যাঁদের জমির পরিমাণ গড়ে ১০ বিঘার নিচে। খুব কম জনেরই একশো বিঘার বেশি জমি আছে। আবার এই অপপ্রচারও আছে যে এটা খালিস্তানিদের আন্দোলন। কিন্তু এখানে তেমন দাবির চিহ্ন পর্যন্ত পাইনি। বরং কয়েক জায়গায় পোস্টারে লেখা দেখেছি –‘আমরা খালিস্তান চাই না, কৃষি আইনের রদ চাই’।

সিংঘুতে কৃষকরা অসংখ্য ট্রাক্টর আর ট্রাকে করে প্রায় ১৫ কিমি রাস্তা জুড়ে বসে আছেন। ট্রাক্টরের ট্রলি আর ট্রাকের ছাদ পলিথিনে মুড়ে তাদের অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা তারা করে নিয়েছেন। কেবল পাঞ্জাব আর হরিয়ানার কৃষকরা শুধু নন, এখানে উত্তরপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা আন্দোলনকারীরা আছেন এবং দিনে দিনে অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

এখানে কৃষকরা পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রীর ব্যবস্থা করেছে বিভিন্ন লঙ্গরখানার মাধ্যমে। আন্দোলনে আসা যে কেউ নিখরচায় পেট ভরে খেতে পারে। এখানে রাস্তার ধারে ধারে অস্থায়ী শৌচাগারের ব্যবস্থা তারা করেছে যাতে স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকে। তারা জামা-কাপড় কেচে নেওয়ার ব্যবস্থাও করে নিয়েছে অনেকগুলো ওয়াশিং মেসিন জোগাড় করে। তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে বাকিদের জামাকাপড় কেচে দিচ্ছেন। কিছু কৃষক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিদিনের তৈরি হওয়া আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব পালন করছেন। আবার দেখলাম কিছু কৃষক নিখরচায় অন্যদের চুল-দাড়ি কাটার দায়িত্ব পালন করছেন। কয়েকজন যুবক বিনামূল্যে ইচ্ছুক কৃষকদের হাতে ট্যাটু একে দিচ্ছে, তাতে চে গুয়েভারার ছবিও দেখেছি। সন্ধ্যার পরে মাঝরাত পর্যন্ত যখন মূল মঞ্চের ভাষণ স্থগিত থাকে তখন বিভিন্ন গ্রুপে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রতিবাদী গান বা লোকসংগীত গাইছেন কৃষকরা। এখানে প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা দায়িত্ব নিয়ে একটা দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের প্রত্যয় যে জীবন গেলেও যাবে কিন্তু দাবি আদায় তারা করবেনই। ব্যক্তিবাদী স্বার্থের দ্বন্দ্ব, দায়িত্বহীনতা আর সুবিধাবাদের পরিবেশে বড় হয়ে আগে আমি এমন পরিবেশ দেখিনি যেখানে একতা আছে, বীরত্ব আছে, ভ্রাতৃত্ববোধ আছে। এই আন্দোলন আমাকে নতুন জিনিস শেখাল। নতুন দিশা দিল। এখানে শিখদের গুরুদোয়ারার বড় ভূমিকা দেখলাম। একটা বড় সংখ্যক লঙ্গরখানা গুরুদোয়ারার পরিচালনায় চলছে।

আমরা চিকিৎসকরা মূলত টেন্টে রাত কাটাতাম রাত্রিকালীন চিকিৎসা পরিষেবা বজায় রাখতে। এখানে আমাদের ছাড়াও আরও কিছু মেডিকেল ক্যাম্প ছিল, কিন্তু সেগুলো মূলত হেলথ স্টাফরা চালাত। সেই ক্যাম্পগুলিতে বিভিন্ন শহর থেকে ডাক্তাররা কখনও সকালে এসে রাতে আবার ফিরে যেতেন। একমাত্র আমাদের ক্যাম্পেই দিন-রাত সবসময় ডাক্তার পাওয়া যেত। প্রতিদিন রাত্রে আমরা বেশ কিছু ইমার্জেন্সি রোগী দেখেছি। ফলে দিনে দিনে আমাদের প্রয়োজনীয়তা ওখানে বেড়ে গেছে। ৩-৪ কিমি দূর থেকেও খোঁজ করে রোগী এসেছে আমাদের কাছে। আমাদের পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকলেও আমরাই ওখানে মূল চিকিৎসাটা দিচ্ছি। আমাদের লেখা ওষুধ অন্যান্য ক্যাম্প থেকেও দিয়ে দিচ্ছে। অনেক ক্যাম্প ও সংস্থা খোঁজ নিয়ে নিজে থেকে আমাদের ক্যাম্পের জন্য প্রতিদিন ওষুধ দিয়ে যেতেন। রোগীরা সুস্থ হয়ে পরের দিন আমাদেরকে কৃতজ্ঞতাসূচক নমস্কার করে গেছেন।

এর আগে বেশ কিছু মেডিকেল ক্যাম্প আমি করেছি কিন্তু সিংঘুর এই ক্যাম্প সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে কৃষকদের যে মমত্ব, তেজস্বিতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, একতা দেখে এলাম তা মনকে নাড়াদেয়।

ডাঃ কল্যাণব্রত ঘোষ

কলকাতা

(গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১৭ সংখ্যা_১৫ জানুয়ারি, ২০২১)