কালো টাকার কারবারিদের বাঁচানোটাই ছিল নোট বাতিলের প্রধান উদ্দেশ্য

দিল্লি, ফাইল চিত্র

নোট বাতিলের পর দেড় বছর অতিক্রান্ত, কিন্তু তার ভূত কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না মোদি–অমিত শাহদের৷ আস্তে আস্তে সামনে আসছে নোট বাতিলের আসল উদ্দেশ্য৷ গত মে মাসে আর টি আই–এর মাধ্যমে প্রাপ্ত সরকারি সূত্র জানাচ্ছে নোট বাতিলের ঘোষণার মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই গুজরাটের আহমেদাবাদ জেলা সমবায় ব্যাঙ্কে জমা পড়েছিল ৭৪৫ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা গুজরাটেরই রাজকোট জেলা সমবায় ব্যাঙ্কে ওই সময়ে জমা পড়েছিল ৬৯৩ কোটি ১৯ লক্ষ টাকা আর নোট বাতিলের সাত দিনের মাথায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়ে দিয়েছিল সমবায় ব্যাঙ্কে আর বাতিল নোট জমা করা যাবে না৷ মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে জমা পড়া ওই বিপুল টাকার পরিমাণ দেখে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল যে, তাহলে কি সমবায় ব্যাঙ্কের নানা অনিয়ম ও কিছুটা ঢিলেঢালা নিয়ম–কানুনের সুযোগ নিয়ে বিজেপি–কর্তাদের ঘনিষ্ঠ কালো টাকার মালিকরা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওই ঘোষণার আগেভাগেই তাদের জমা টাকা সাদা করে নিল? তাহলে কি বিজেপি–নেতারা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণার কথা আগাম জানতেন এবং তাঁরাই সতর্ক করে দিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ কালো টাকার মালিকদের?

এ প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক৷ কারণ, সংবাদ শিরোনামে আসা গুজরাটের দুটি ব্যাঙ্কেই ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন বিজেপির প্রভাবশালী নেতা–মন্ত্রীরা৷ প্রথমটির ডিরেক্টর খোদ অমিত শাহ এবং দ্বিতীয় ব্যাঙ্কটির চেয়ারম্যান গুজরাটের গুরুত্বপূর্ণ নেতা–মন্ত্রী জয়েশভাই বিঠলভাই রাদাদিয়া৷ আবার সুরাট জেলা সমবায় ব্যাঙ্ক, যার ডিরেক্টর বিজেপির বরদৌলির সাংসদ প্রভুভাই ভাসাভা, সেখানে ওই ক’দিনে জমা পড়ে ৩৬৯.৮৫ কোটি টাকা৷ তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই, শুধু জেনে রাখুন গুজরাটেই রয়েছে এরকম এগারোটা ব্যাঙ্ক, যার সবকটির মাথায় রয়েছে অমিত শাহ বা তার ঘনিষ্ঠ নেতা–মন্ত্রীরা৷ নোট বাতিলের পরপরই এই ব্যাঙ্কগুলিতে জমা পড়েছিল সর্বমোট ৩, ১১৮ কোটি টাকা৷ যদি সারা দেশের জেলা সমবায় ব্যাঙ্ক ধরেন তা হলে বিজেপি ও তাদের সহযোগী দল শাসিত রাজ্যগুলিতে ওই সময়ে জমা পড়ে ১৪ হাজার ২৯৩ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা৷

দেশের মানুষের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছিল বিজেপির প্রাক্তন বিধায়ক এবং অমিত শাহের রাজনৈতিক গুরু হিসাবে খ্যাত যতীন ওঝার বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়ার কারণে৷ যতীন ওঝা ১৫ নভেম্বর ২০১৬ প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন৷ চিঠিতে তিনি বলেছেন,  ৮ নভেম্বর আপনার নোট বাতিল সংক্রান্ত বক্তৃতা শুনে খুব আনন্দ হয়েছিল৷ এই রকম ঐতিহাসিক দৃঢ় পদক্ষেপের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম৷ দুর্ভাগ্যবশত সেই মনোভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি৷ ৯ নভেম্বর সকালেই আমার খুব ঘনিষ্ঠ স্নেহভাজন একজন আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ৮ তারিখ দুপুর ১২টার কিছু পরে আহমেদাবাদের এক অগ্রগণ্য শিল্পপতির স্ত্রী অলঙ্কারের একটি নামকরা দোকানে এসে আগে থেকে অর্ডার দেওয়া ২০ কোটি টাকার অলঙ্কার কিনে নিয়ে গেছেন৷ নগদ টাকা এবং অলঙ্কার হাতবদল করতে সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক মিনিট৷ এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমেদাবাদের এক প্রখ্যাত মহিলা চিকিৎসক যিনি অলঙ্কার কিনতে ওই দোকানে গিয়েছিলেন৷

আপনার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা এবং একসময় আপনার কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য থাকার সুবাদে তৎক্ষণাৎ আমি বুঝতে পারলাম, দেশের কালো টাকার ৫০ শতাংশের মালিক আপনার প্রিয় এবং ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের এই নোট বাতিলের পদক্ষেপের কথা নিশ্চিতভাবে বহু আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ সারা দিন ধরে নানা খোঁজখবর নিয়ে এই বিষয়ে যে তথ্য আমি পেয়েছি তা খুবই বেদনাদায়ক৷ এক জনপ্রিয় পদক্ষেপের আড়ালে আপনি দেশের জনগণকে বোকা বানিয়েছেন৷ তিনি আরও লিখেছেন যে, অমিত শাহের ঘনিষ্ঠরা ১ কোটি টাকার ৫০০, ১০০০–এর অচল নোট জমা নিয়ে ৬৩ লক্ষ টাকার নতুন নোট দিচ্ছেন৷ অর্থাৎ ৩৭ শতাংশ কমিশনে তারা কালো টাকা সাদা করে দিচ্ছেন৷ যতীন ওঝা দাবি করেছিলেন, এ বিষয়ে তাঁর কাছে ভিডিও প্রমাণ আছে৷ বিজেপির এইসব কর্তাদের বাড়ির সামনে কালো টাকার মালিকদের লাইন পড়ে গিয়েছিল৷ তিনি তিন–চারজন প্রবীণ সাংবাদিককে এই ভিডিও দেখাতে চেয়েছিলেন যাতে মোদি তার সত্যতা যাচাই করতে পারেন৷

তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, কীভাবে সমস্ত কাজের ব্লু প্রিন্ট তৈরিতে নরেন্দ্র মোদি সিদ্ধহস্ত তা জানা আছে বলেই তিনি নিশ্চিত যে, আটঘাট বেঁধেই মোদি এই কাজ করেছেন৷ এখন বোঝা যাচ্ছে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির অনিয়ম এবং বেআইনি কাজের বিষয়টা বিজেপির কর্তারা পরিচালনা করেছিলেন৷ যতীন ওঝা এবং অন্যান্যরা সেই সময়েই বলেছিলেন, গুজরাটের বিজেপি পরিচালিত সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে ৮ তারিখ রাত থেকে ৯ তারিখ ভোর পর্যন্ত শত শত কোটি টাকার বাতিল পাঁচশো ও হাজারের নোট বদলে দেওয়ার কাজ চলেছে৷ শুধু তাই নয়৷

কৃষিতে আয়কর দিতে হয় না বলে কালো টাকার যেসব মালিক তাদের হিসাব বহির্ভূত আয়কে কৃষি–আয় বলে দেখায়, তাদের বিরুদ্ধে রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে তদন্তের আশ্বাস দিয়েছিলেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি৷ অথচ গুজরাটের সমবায় ব্যাঙ্কে হঠাৎ জমা পড়া বিপুল টাকা নিয়ে আজও পর্যন্ত কোনও তদন্ত হল না৷ সেই সময় ওই সমবায় ব্যাঙ্কটির হয়ে সওয়াল শুরু করেছিল যে ‘নাবার্ড’ বা ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট, তাদের বক্তব্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, ওই পাঁচ দিনে মাত্র ২৩০ জন গ্রাহক ওই বিপুল পরিমাণ টাকা জমা দিয়েছিলেন সমবায় ব্যাঙ্কটিতে৷ এই ঘটনায় কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে, খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সেই সন্দেহ প্রকাশ করা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনও ওই ২৩০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হওয়া দূরের কথা, নাম পর্যন্ত প্রকাশ করা হল না৷

আসলে কালো টাকা বাতিল করে দেশের অর্থনীতির কালো দাগ দূর করার বাণী বিতরণ করে নরেন্দ্র মোদি একটি বড়সড় নাটক করেছিলেন৷ তার ধাক্কা পুরোটাই সহ্য করতে হয়েছিল দেশের খেটে–খাওয়া সাধারণ মানুষকে৷ তাঁর আহ্বান ও আশ্বাসবাণীতে বোকা বনেই দেশের জনগণ সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাঙ্কে, এ টি এমের দরজায় লাইন দিয়েছিলেন৷ নগদ টাকার অভাবে খুচরো ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উপর নেমে এসেছিল চরম আঘাত চাষিরা ফসল বিক্রি বা চাষের উপকরণ কেনার ক্ষেত্রে প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন৷ কাজ হারিয়ে পরিবার–পরিজন নিয়ে পথে বসেছিলেন অসংখ্য ঠিকা–শ্রমিক৷ অসুস্থতা উপেক্ষা করে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে মারা গিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ৷ অথচ কালো টাকার আসল মালিকদের গায়ে আঁচড়টিও পড়েনি৷ আগে থেকে তাদের সবকিছু জানিয়ে কালো টাকা সাদা করার সমস্ত রকম ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরেই প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিলের ঘোষণা করেছিলেন৷ ভোটে জেতার জন্য প্রচারের বিপুল খরচের জোগান আসে যাদের কাছ থেকে, তাদের জন্য এটুকু না করলে চলবে কেন তাই কালো টাকা বাতিলের এত হাঁকডাক সত্ত্বেও আজও পর্যন্ত একজন কালো টাকার মালিককেও হাজতবাস করতে দেখা গেল না৷

(৭০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা ২৭ জুলাই, ২০১৮)