Breaking News

কলেজে ‘অনলাইন’ প্রক্রিয়া কি ভর্তির দুর্নীতি আটকাবে

কলেজে ভর্তি নিয়ে দুর্নীতি এখন নিয়মিত ঘটনা৷ গত বছর এই দুর্নীতির জেরে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী সমস্যায় পড়েছিলেন৷ তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি–র তোলাবাজিতে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন, এমনকী আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে৷

প্রতি বছর কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে অনেক স্বপ্ন নিয়ে কলেজে ভর্তি হতে এসে এক কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হয়৷ শাসকদলের ছাত্রসংগঠনের দুর্নীতি, জোর করে টাকা আদায় এবং তারপরও পছন্দসই বিষয় নিয়ে ভর্তি হতে না পারা এ সবই বহু সাধারণ ছাত্রের শিক্ষাজীবনে ইতি টেনে দেয়৷

গত বছর ভর্তি দুর্নীতি এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যা শিক্ষামন্ত্রীও অস্বীকার করতে পারেননি৷ এবার তিনি বলেছেন, গোটা ভর্তি প্রক্রিয়া হবে অনলাইনে৷ কেনও ছাত্রকেই ক্লাস শুরুর আগে আর কলেজে আসতে হবে না৷ অনেকে মনে করছেন যে এতে বোধহয় দুর্নীতি আর হবে না, ভর্তি প্রক্রিয়া হবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ৷

প্রশ্ন হল, অনলাইন ব্যবস্থাই কী দুর্নীতির বন্ধের একমাত্র উপায়? দুর্নীতি কি শুধু এতদিন এই ব্যবস্থা চালু ছিল না বলেই হচ্ছিল? এ কথাটা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে৷ অনলাইন একটি প্রযুক্তিগত আধুনিক ব্যবস্থা যার সুফল রাজ্যের একেবারে প্রান্তিক ছাত্রটিরও পাওয়া দরকার এবং সরকার যদি এই ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করে তা হলে বিনামূল্যেই সমস্ত ছাত্রছাত্রী যাতে এই সুবিধা নিতে পারে তার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে৷ কিন্তু আমাদের রাজ্যে যেখানে বহু গ্রামে সামান্য বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগও ঠিকমতো নেই সেখানে এই অনলাইন পদ্ধতি ব্যবহার অনেকের কাছেই বিড়ম্বনা৷

সরকার আজকে দুর্নীতি বন্ধের নামে জোর করে ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়ে এই অপর্যাপ্ত অনলাইন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছে৷ অনলাইনে ফর্ম ফিল–আপ করতে গিয়েই ফর্মের দাম, ব্যাঙ্কচার্জ, সাইবার চার্জ সহ শয়ে শয়ে টাকা একজন ছাত্রছাত্রীকে খরচ করতে হচ্ছে৷ একাধিক কলেজে যদি ফর্ম ফিল–আপ করতে হয় তা হলে তো কথাই নেই৷ বেশ কয়েক হাজার টাকা খরচ হবে শুধু ফর্ম ফিল আপেই, ভর্তি তো অনেক দূর৷

অনলাইন পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের আরও কিছু নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে৷ ছাত্রছাত্রীদের নথি যাচাই করার কোনও ব্যবস্থা ভর্তির আগে থাকছে না৷ ফলে বহু ছাত্রছাত্রীরই সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে৷ ভর্তির অনিশ্চয়তাকে কেন্দ্র করে একসঙ্গে একাধিক কলেজে ভর্তি হয়ে থাকবে অনেক ছাত্রছাত্রী৷ ফলে ক্লাস শুরুর পরেই জানা যাবে অনেক কলেজেই আসন ফাঁকা রয়ে গিয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে ভাল পরিকাঠামোযুক্ত কলেজগুলিতেও বেশ কিছু সংখ্যক আসনই ফাঁকা থেকে যাবে৷

বহু কলেজেই শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের কাছে কলেজ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই মাথা নুইয়ে বসে আছে৷ বহু জায়গায় চাপের কাছে কর্তৃপক্ষ আত্মসমর্পণ করে৷ কলকাতা সহ বিভিন্ন জেলার কলেজের একই চিত্র৷ ফলে মেধা তালিকা প্রকাশে কলেজ কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রেখে তালিকা প্রকাশ করবে সেখানে কোনও দুর্নীতি হবে না, এরও কোনও গ্যারান্টি নেই৷ গত বছরও মৌলানা আজাদ কলেজ সহ নানা কলেজ থেকে টিএমসিপি নেতারা ফোন করে ছাত্রছাত্রীদের টাকার বিনিময়ে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলেছে৷ অনলাইনের তালিকা বদলে দিয়েছে৷ এবারেও তা হবে ধরে নেওয়া যায়৷ আবার কলেজগুলিতে বিভিন্ন বিষয়ে কত সংখ্যক আসন আছে, কত আসনে ভর্তি হচ্ছে সে সম্পর্কে কোনও স্বচ্ছ ধারণা সাধারণ ছাত্রছাত্রী–অভিভাবক সামনে প্রকাশ করা হয় না৷ ফলে এ ক্ষেত্রেও শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের কারসাজিতে দুর্নীতির ঘটনা ঘটেই৷ এ সম্পর্কে কোনও সঠিক পথ শিক্ষামন্ত্রী দেখাতে পারেননি৷ আসলে দুর্নীতি বন্ধের সাথে এই অনলাইনের কোনও সম্পর্ক নেই৷ আর দুর্নীতি যারা করবে তারা সব ব্যবস্থাতেই অসাধু উপায় অবলম্বন করতে দুর্নীতির আশ্রয় নেবে৷

গত বছর ছাত্রভর্তিতে টিএমসিপি–র যে নেতারা তোলাবাজি করেছিল, তাদের কাউকেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আজও দেওয়া হয়নি৷ ফলে বহাল তবিয়তেই সেই সমস্ত ছাত্র নেতারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ বহু কলেজের কর্তৃপক্ষ যেখানে এই দুর্নীতির সাথে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সরকার৷ তাই, দুর্নীতি বন্ধের কোনও সদিচ্ছা আদৌ সরকারের আছে কী? এ প্রশ্ন থেকই যাচ্ছে৷ ছাত্রস্বার্থের কথা সত্যিই যদি সরকার ভেবে থাকে তা হলে তার উচিত যে সব নেতারা দুর্নীতির সাথে যুক্ত তাদের শাস্তি দিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়াকে সরল ও দুর্নীতিমুক্ত করা৷ শুধু অনলাইনে নয়, পাশাপাশি অফলাইন প্রক্রিয়াও চালু রাখা দরকার৷ সমস্ত কলেজের পরিকাঠামো উন্নয়ন করা দরকার৷ যাতে ছাত্রছাত্রীরা তার পছন্দসই বিষয় নিয়ে ভর্তি হতে পারে৷ শূন্যপদগুলিতে অত্যন্ত দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ করা যাতে সামগ্রিক পঠন–পাঠনের মান উন্নত হয়৷ সরকার মেলা, খেলা, উৎসব ও বাহ্যিক চটকদারিতে বহু টাকা খরচ করলেও শিক্ষার মান উন্নয়নে খরচ করছে না৷ ফলে রাজ্যে শিক্ষার মান তলানিতে ঠেকেছে৷

এ বছর অনলাইন প্রক্রিয়ার নানান জটিলতায় এবং দুর্নীতির কারণে যাতে কেনও ছাত্রেরই ভর্তিতে সমস্যা না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটেশন দেয় ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডি এস ও৷ কর্তৃপক্ষ সমস্যাগুলি সম্পর্কে সহমত হলেও দায় এড়িয়ে গেছেন, তাই ছাত্রছাত্রী–অভিভাবক ভর্তি সমস্যা সমাধানে আন্দোলনের পথে নামার আহ্বান জানিয়েছে ডি এস ও৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা)