কর্মসংস্থানে ডাহা ফেল মোদি সরকার

খালি পদ দশটা৷ আবেদনপত্র জমা পড়েছে কুড়ি লক্ষ৷ এসব খবর ভারতবর্ষে জলভাত হয়ে গেছে৷ সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিওন পদের জন্য পিএইচডি, এমটেক ডিগ্রিধারীদের আবেদন করার কথা প্রকাশ পেয়েছে৷ দেশে এত উন্নয়ন হয়েছে এবং হয়ে চলেছে যে মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ যা–হোক একটা কাজ পাওয়ার জন্য মরিয়া৷

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আই এল ও) উদ্যোগে কর্মসংস্থান বিষয়ে বিশ্বজুড়ে নিয়মিতসমীক্ষা করা হয়৷ গত জানুয়ারি মাসে তেমনই এক সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, যা ভারতের ক্রমবর্ধমান ভয়ঙ্কর বেকারিচিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে৷ সমীক্ষাটি নানা স্তরের নানা খুঁটিনাটি তথ্য দিয়ে দেখিয়েছে ভারতে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা লাগাতার কী ভাবে বেড়ে চলেছে৷ নথি বলছে ভারতে প্রতি বছর গড়ে ২ কোটি করে নতুন বেকার সৃষ্টি হয়৷

খেয়াল করলেই দেখা যায়, রাজ্যে রাজ্যে এবং কেন্দ্রেও মাঝে মাঝেই সরকারি নেতা–মন্ত্রীরা ক্যামেরার সামনে বিবৃতি দেন, দাবি করেন– তাঁরা এত লক্ষ কর্মসংস্থান করেছেন, তাঁদের আমলে এত হাজার কোটি টাকা শিল্পপতিরা বিনিয়োগ করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এবং তারপরেই তাঁদের বক্তব্য, আবার যদি ভোটে জিতিয়ে আমাদের ক্ষমতায় আনেন, আরও চাকরি হবে, আরও বিনিয়োগ হবে৷ যেমন ২০১৪ সালে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢেলে বিজেপি নির্বাচনের ময়দান গরম করেছিল৷ নিশ্চয়ই মনে আছে নরেন্দ্র মোদির সেই টানটান অভিনয়, যেখানে তাঁর সংলাপ ছিল, ‘‘পঞ্চাশোর্ধ্বদের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারব না৷ কিন্তু যারা কুড়ির ঘরে পা দিয়েছে এবং কাজ খুঁজছে, তাদের জীবন বদলে দিতে চাই৷’’ তিনি খুব জোর গলায় বলে বেড়িয়েছিলেন, যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে তাহলে প্রতি বছর দু’কোটি করে বেকারের কর্মসংস্থান করা হবে৷ কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের প্রায় ৪ বছর হতে চলল, অর্থাৎ, ৮ কোটি বেকারের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা৷ গোঁজামিল দিয়েও খুব বেশি হলে ৬–৭ লক্ষ নতুন চাকরি দেওয়ার দাবি তারা করতে পারে৷ কিন্তু গত ৪ বছরে নতুন করে কর্মহীন হয়েছেন কত মানুষ? গড় হিসাবে কম পক্ষে দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন৷ এর মধ্যে একটা বড় অংশ গুজরাটের, যে গুজরাটকে বিজেপি একসময় উন্নয়নের মডেল হিসাবে তুলে ধরেছিল৷

বস্ত্র, ধাতু, অটোমোবাইল, রাসায়নিক সমস্ত বৃহৎ শিল্পই মরণাপন্ন নরেন্দ্র মোদির সাধের গুজরাটে৷ এই শিল্পক্ষেত্রগুলিতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করত যে অসংখ্য ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান, স্বাভাবিক নিয়মে সেগুলোও মরতে বসেছে৷ বছর পাঁচেক আগেও সুরাটে বস্ত্রশিল্পের প্রায় দশ হাজার কোম্পানি ছিল যা কমতে কমতে এখন দু’হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে৷ পাঞ্জাব, ওড়িশা, তামিলনাড়ু সর্বত্রই কমবেশি একই ছবি৷ যে আইটি শিল্প নিয়ে উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের তরুণদের একাংশের মধ্যে অনেক প্রত্যাশা ছিল, সেখানেও আজ ভয়াবহ অবস্থা৷ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটা খবর অনেককেই চমকে দিয়েছিল৷ খবরটি ‘ডেভেলপড স্টেট’ বলে পরিচিত চেন্নাইয়ের৷ হেডিং ছিল, ‘নব্বই শতাংশ আইটি কোম্পানিতে তালা, অধিকাংশ কারখানা বন্ধ’৷

২০১৫ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দেশে একশোটা ‘স্মার্ট সিটি’ তৈরি করা হবে৷ এতে দেশটাকেও সুন্দর দেখাবে আর প্রচুর কর্মসংস্থানও হবে৷ ছ’বছরের এই প্রকল্পের জন্য সরকারি বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৪ লক্ষ কোটি টাকা৷ তারপর থেকে তিন বছর হতে চলল, এখনও পাঁচ শতাংশ কাজও হয়নি৷ এমনকী সেই কাজের ফলে ক’জন কোথায় ক’দিনের জন্য কাজ পেয়েছেন তারও কোনও হিসাব নেই৷ প্রধানমন্ত্রী ওই সময়ই আরও বলেছিলেন যে, ‘কর্মসংস্থান হচ্ছে না কারণ দেশের ছেলেমেয়েদের কর্মদক্ষতা নেই৷’ প্রশ্ন ওঠে, তাহলে হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার, টেকনোলজিস্ট বেকার কেন? আমরা তখনই বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই কথার মধ্যে কোনও সত্যতা নেই৷ এই দক্ষতার যুক্তি দেশে বহুকাল ধরেই চলছে এবং সেই অজুহাতে সরকারি কোষাগারের লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে বহু প্রকল্পও ঘোষিত হয়েছে৷ এরকম যত প্রকল্প আনা হয়েছে তার ফল হয়েছে একটাই– বছর বছর ‘প্রশিক্ষিত’ বেকার সংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি৷ এই কারণেই দেখা যায়, ‘প্রশিক্ষিত’রা যোগ্য কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে এমনকী গ্রুপ–ডি পদের জন্যও আবেদন করে চলেছেন৷

এতদসত্ত্বেও, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও আবার নতুন করে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করলেন ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ প্রকল্প৷ সরকারি কোষাগার থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হল৷ রাতারাতি এখানে সেখানে আবারও কিছু তথাকথিত ট্রেনিং সেন্টার খোলা হল৷ আবারও বহু ছেলেমেয়ে ছুটে গেল, যা–হোক তা–হোক কিছু ট্রেনিং পেল৷ কিন্তু তারপর? ট্রেনিংপ্রাপ্ত কত জন স্থায়ী কাজ পেয়েছে? কোথাও এর কোনও তথ্য সম্ভবত পাওয়া যাবে না ওই বছরই স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী খুব জমকালো কায়দায় ঘোষণা করেছিলেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের৷ বলেছিলেন, এতে উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে৷ প্রথম বছরেই সরকারি কোষাগার থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল এই প্রকল্পে৷ কিন্তু কত জনের চাকরি হল? ১১ জুন ২০১৭, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে একজন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া আদতে একটি ফাঁপা বুলি মাত্র৷ যার ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতিই ঘটেনি বরং ক্ষেত্রটি ক্রমশ দুর্বলতর হয়েছে৷’ ফলে চাকরির রাস্তা যে খোলেনি তা বলাই বাহুল্য৷

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন ‘স্টার্ট আপ’ প্রকল্প৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে দিতে বলেছিলেন যাতে তারা বেকারদের ব্যবসার জন্য ঋণ দিতে পারে৷ এর পর দু–দুটো বছর কেটে গেছে, দশ শতাংশ টাকাও ব্যাঙ্ক থেকে বেরোয়নি৷ উল্টে যে ক’জন ছোটখাট চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করবে বলে ঋণ নিয়েছিল, দেখা গেল তারা বড় পুঁজির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই বেকারে পরিণত হয়েছে৷ অর্থাৎ, কর্মসংস্থান তো হলই না বরং নতুন করে বেকার বাড়ল৷ প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগে রাজ্যসভায় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং–এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৬ লক্ষ কেন্দ্রীয় কর্মপদ খালি পড়ে রয়েছে৷ এগুলিতে নিয়োগ হচ্ছে না৷ দেশের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে দেওয়ার ন্যূনতম সদিচ্ছা যদি বিজেপি সরকারের থাকত, তাহলে এই পদগুলো কি বছরের পর বছর খালি পড়ে থাকত?

কেন বিজেপি সরকার এই পদগুলিতে নিয়োগের অনুমতি দিচেছ না? দিলে তো তার জনপ্রিয়তা বাড়ত৷ আরও ভোট পেত৷ তাহলে দিচ্ছে না কেন?

এই বিষয়টাই খুব স্পষ্ট করে বোঝা প্রয়োজন৷ এই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ানো দরকার যে, বিজেপির জায়গায় কংগ্রেস বা অন্য যে–ই থাকুক, কেউই চাকরি দিতে পারবে না, পারবে শুধু চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে৷ কারণ, কোনও দেশের জনগণের কর্মসংস্থানের প্রক্রিয়াটা কোনও সরকারের ইচ্ছা–নিচ্ছার উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে সেই দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর৷ বর্তমানে আমাদের দেশে যে ব্যবস্থাটি চলছে সেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় কী উৎপাদন হবে, কতটা উৎপাদন হবে তা নির্ভর করে মালিকের লাভ–লোকসানের হিসাবের উপর৷ লাভ না হলে মালিকরা উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, অর্থাৎ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়৷ তাতে শ্রমিক মরলেও মালিক নির্বিকার৷

শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মুনাফা লুটের নেশায় পুঁজিপতি শ্রেণি কংগ্রেস–বিজেপির মতো পেটোয়া দলগুলিকে সরকারে বসিয়ে দেশের মেহনতি জনতাকে লাগাতার শোষণ করে চলেছে৷ সেই শোষণের ফলেই ৮০ শতাংশ মানুষ হতদরিদ্র, তাদের কেনার ক্ষমতা নেই৷ সে জন্যই বাজারে বিক্রি কম৷ শিল্পপতিরা একের পর এক কল–কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে৷ দেশে এই মুহূর্তে আনুমানিক ৩ লক্ষ কল–কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে৷ এগুলি খুলছে না কেন? কারণ খোলার কোনও উপায় নেই৷ কারণ, উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে না, মজুত করে রাখতে হচ্ছে, লাভ ঘরে ঢুকতে অনেক দেরি হচ্ছে, লাভের মাত্রাও কমে যাচ্ছে৷ ফলে, সাধারণ জনজীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ক্ষেত্র ছেড়ে শিল্পপতিরা দেশের অতি ক্ষুদ্র আপাত সচ্ছল মানুষের অপরিহার্য পরিষেবা ক্ষেত্রগুলিতে ব্যাপক ভাবে প্রবেশ করছে৷ স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে হাসপাতাল–নার্সিংহোম নিয়ে ব্যবসা শিল্পপতিদের  আজ সবচেয়ে পছন্দের৷ এখানে প্রায় অগ্রিম নগদলাভ, তাও সম্পূর্ণ সুরক্ষিত৷ সে জন্যই শিল্পপতিরা এই ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ করে চড়া নগদ মুনাফা লুটছে এবং তথাকথিত নির্বাচিত সমস্ত সরকারগুলি তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজারের কাজ করছে৷

অন্যদিকে, ফি বছর যে শ’য়ে শ’য়ে কল–কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেগুলিতে কর্মরত শ্রমিক–কর্মচারীদের পরিণতি কী হচ্ছে? কোটি কোটি সাধারণ মানুষ কর্মচ্যুত হয়ে কাজের সন্ধানে রাজ্যে রাজ্যে দেশ দেশান্তরে ঘুরে ঘুরে মরছে৷ খিদের জ্বালায় সপরিবারে আত্মহত্যা করছে৷ সন্তানকে বাঁচাতে পারবে না বুঝতে পেরে দু–পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে ক্ষুধার্ত বাবা–মা৷ অসংখ্য মা–বোন দারিদ্রের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে এমনকী দেহ বিক্রির মর্যাদাহীন জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে৷ আর, সরকারি নেতা–মন্ত্রীরা, যারা জনগণের সেবা করার জন্য ভোট চায়, ভোটের জন্য মানুষে মানুষে দাঙ্গা লাগায়, তারা নির্বিকারে লাগাতার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিয়ে ডাহা মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছে৷

এই অসহনীয় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই ফুঁসে উঠছে মানুষ৷ স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ–বিক্ষোভ ফেটেও পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে৷ শাসকরা কৌশলে এই ক্ষোভ–বিক্ষোভ জ্বালা যন্ত্রণা চাপা দিতে চায় ভোটের দামামার বিকট আওয়াজের নিচে৷ কিন্তু তাদের এই কৌশলে ভুললে কি বেকারদের কাজ জুটবে? শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার ভোটবাজ সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির সামনে প্রশ্ন তুলতে হবে– কেন সব থাকা সত্ত্বেও সুজলা–সুফলা এই দেশের মানুষ না খেয়ে মরে? কী করে গুটিকয় লোক দেশের সমস্ত সম্পদের দখলদারি নিয়ে মালিক হয়ে বসে থাকে? যে সরকারই আসুক, কেন তারা শুধু মালিকদের হয়েই কাজ করে? এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে, ভোট দিয়ে নয়, সরকার বদলে নয়, সমস্যার সমাধান করতে হলে চাই এই শোষণমূলক ব্যবস্থাটারই আমূল পরিবর্তন৷ শ্রমসৃষ্ট সম্পদের উপর ব্যক্তিবিশেষের মালিকানা ধ্বংস হলে তবেই সকলের জন্য খুলে যাবে সুস্থ জীবনযাপনের রাস্তা৷

আজ প্রতীক্ষা শুধু চেতনার এই সঠিক চাবিকাঠিটির, যা ক্ষোভের বারুদের পাহাড়ে একদিন আগুন ছুঁইয়ে নিয়ে আসবে নতুন দিন৷

70 Year 34 Issue13 April, 2018