করোনার সময়েও শিশুর পুষ্টিতে বঞ্চনা

স্কুলে স্কুলে চতুর্থ দফায় খাদ্যসামগ্রী বিলি চলছে৷ লকডাউনে স্কুল বন্ধ৷ স্বাভাবিকভাবে মিড–ডে মিলও বন্ধ৷ তাই বিলি করা হচ্ছে খাদ্যসামগ্রী৷ কিন্তু সেখানেও বঞ্চনার অন্ত নেই৷ তার ইতিবৃত্ত নিম্নরূপ৷

প্রথমতঃ দিন সংখ্যায় কারচুপি৷ স্কুল খোলা থাকলে ছুটির দিন বাদে সবদিন মিড–ডে মিল রান্না হত৷ তখন ছাত্রছাত্রীরা গড়ে ২৪–২৫ দিন খাদ্য পেত৷ কিন্তু খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে ২০ দিনের৷ অর্থাৎ মাসে গড়ে ৪–৫ দিনের একবেলার খাদ্য থেকে বঞ্চিত হল শিশুরা৷

দ্বিতীয়তঃ পুষ্টি৷ শিশুর অপুষ্টি দূর করবার জন্যই সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে মিড–ডে মিল চালু হয়েছিল৷ বর্তমানের করোনা সংক্রমণ প্রতিহত করতে শিশুর পুষ্টি অপরিহার্য হলেও গত মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে কেবলমাত্র চাল ও আলু দেওয়া হয়েছে৷ মিড–ডে মিল চালু থাকলে পুষ্টিকর খাদ্যযুক্ত তালিকা মেইনটেইন না হলেই শিক্ষক মশাইদের শো–কজ করার নিদান রয়েছে৷ কিন্তু এই দুঃসময়েও সরকারের পক্ষ থেকে শিশুদের পুষ্টি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ যার বিরুদ্ধে সর্বত্র শিক্ষক ও অভিভাবকেরা সরব হয়ে উঠেছেন৷ তবে আই সি ডি এস  মাথাপিছু ৩০০ গ্রাম করে মুসুর ডাল দিয়ে যাচ্ছে৷ অতঃপর জুলাই মাসে চতুর্থ দফায় ২৫০ গ্রাম করে ডাল বরাদ্দ করা হয়৷ প্রশ্ন উঠেছে পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করবার জন্য সয়াবিন, ডিম ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে না কেন?

তৃতীয় বঞ্চনাটি বিষ্ময়কর। চতুর্থ দফার নির্দেশিকায় Memo no.-228(24)-ES(CMDMP)/GENL-26/2014 Dt.-17.06.2020 হ্যান্ডস্যানিটাইজারও মিড–ডে মিলের খাদ্যসামগ্রীর তালিকায়৷ বর্তমানে হ্যাণ্ডস্যানিটাইজার, মাস্ক ইত্যাদি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়৷ কিন্তু তা শিশুকে তার প্রাপ্য খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে কেন? সরকারের অন্যান্য তহবিল থেকেই বা নয় কেন? তাছাড়া করোনা মোকাবিলায় ত্রাণ তহবিলও গঠন করা হয়েছে৷ তবে সেখান থেকেই বা বরাদ্দ করা হচ্ছে না কেন? হ্যান্ডস্যানিটাইজারের জন্য ২২ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে৷ তাতে প্রত্যেক শিশু অন্তত ৪টি করে ডিম পেতে পারতো৷ এ বঞ্চনা তো শিশুর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সামিল৷

সর্বশেষ হল বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটাও শিশুর জন্য ব্যয় না করা৷ এপ্রিল মাস থেকে মিড–ডে মিলে বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে প্রাথমিকে ৪.৪৮ টাকা থেকে ৪.৯৭ টাকা আর উচ্চ প্রাথমিকে ৬.৭১ টাকা থেকে ৭.৪৫ টাকা৷ যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য কিন্তু তাও শিশুরা পাচ্ছে না৷ বাস্তবে দেওয়া হচ্ছে না৷ লকডাউনের পাঁচ মাসের মধ্যে জুলাই মাসেই ডাল ও হ্যাণ্ডস্যানিটাইজার দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু তাতেও সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করা হয়নি৷ মাথাপিছু ২০ দিনের জন্য বরাদ্দ ২২ টাকা করে ২ কেজি আলু, ২৩ টাকার ডাল, ২২ টাকা, হ্যান্ডস্যানিটাইজার অর্থাৎ মোট (৪৪+২৩+২২)= ৮৯ টাকা৷ আর মাথাপিছু বরাদ্দ প্রাথমিকে (৪.৯৭X২০)৯৯.৪০ টাকা এবং উচ্চ প্রাথমিকে (৭.৪৫X২০) ১৪৯ টাকা৷ সুতরাং সরকারি কোষাগারে রেখে দেওয়া হল যথাক্রমে ১০.৪০ টাকা ও ৬০ টাকা করে৷ তাও হ্যাণ্ডস্যানিটাইজার ধরে নিয়ে৷ কিন্তু সেটা তো খাদ্য নয়৷ তাই খাদ্যের জন্য ব্যয় হল ৬৭ টাকা৷ বাস্তবে ছাত্রগণ বঞ্চিত হল যথাক্রমে ৩২.৪০ টাকা ও ৮২ টাকা করে৷ এতো কেবল জুলাই মাসের হিসাব৷ দেখা যাক বাকী মাসগুলির হিসেব কষে৷

লকডাউনের জন্য এখনও পর্যন্ত ঘোষিত ছুটি সাড়ে চার মাস বা ১৩৭ দিন৷ স্কুল খোলা থাকলে মিড–ডে মিল রান্না হত প্রায়১১২–১১৩ দিন৷ সে জায়গায় খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে ৯০ দিনের৷ যার ফলে প্রাথমিকের ক্ষেত্রে মাথাপিছু বরাদ্দের অর্ধেকেরও বেশি এবং উচ্চ প্রাথমিকে দ্বিগুণেরও বেশি কোষাগারে রেখে দেওয়া হল৷

করোনা সংক্রমণে সারা বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত৷ তার ওপর এ রাজ্যে আমফান৷ দুইয়ে মিলে রাজ্যের মানুষ দিশেহারা৷ সর্বস্ব হারিয়ে বহু মানুষ আকাশের নীচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে৷ তাছাড়া সরকারি বিদ্যালয়ে তো মূলতঃ আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের সন্তানসন্ততি আসে৷ তাদের বেশিরভাগ পরিবারই এখন কাজ হারিয়ে কেবল ত্রাণের উপর নির্ভর করেই দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে৷ এরকম একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শিশুর গ্রাস কেড়ে নেওয়া মানে তো তাকে পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেওয়া৷ যে আশঙ্কার কথা ইতিমধ্যেই ইউনিসেফ তার এক রিপোর্টে প্রকাশ করে বলেছে যে পুষ্টির অভাবেই আগামী ৬ মাসে প্রায় ৩ কোটি শিশুর মৃত্যু ঘটবে৷ বাস্তবে করোনায় আক্রান্ত এবং তার জেরে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷ যার নিয়ন্ত্রণে পুষ্টিকর খাদ্য অপরিহার্য, যা শরীরে ইমিউনিটি বাড়াবে৷ অথচ শিশুদেরকে সেই পুষ্টি থেকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে এ অপরাধ তো ক্ষমার অযোগ্য৷

এর ওপর রয়েছে স্কুল ছুটের সমস্যা৷ অপুষ্টি দূর করবার পাশাপাশি মিড–ডে মিল চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল স্কুলছুট বন্ধ করা৷ কিন্তু দীর্ঘ চার দশক ধরে পাশফেল না থাকায় এবং পরিকাঠামোর উন্নয়ন না করায় ছাত্রসংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে৷ যার জেরে বহু স্কুল ইতিমধ্যে উঠে গিয়েছে৷ বর্তমানের খাদ্যসংকটে বহু ছাত্রকে পেটের তাগিদে কাজে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে এবং ছাত্রীরা বাল্যবিবাহ বা  পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে৷ এ ধরণের বহু ঘটনা ইতিমধ্যে সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে৷

যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে লকডাউন কবে উঠবে তার ঠিক নেই৷ লকডাউন উঠে যাওয়ার পর স্কুল খুললেও ছাত্র কতজন আসবে তা একটা প্রশ্নচিহ্ণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ এ সমস্যা সমাধানে সরকার পূর্বেও তেমন কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয় নি, বর্তমানেও না৷ যদি নিত তাহলে ইতিমধ্যেই অন্ততঃ প্রাপ্যের পুরোটা শিশুরা পেত এবং সমস্ত ছাত্রের খাদ্যের দায়িত্ব অর্থাৎ প্রতিদিন দু’বেলায় পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা হত৷ সরকার সে পথে না গিয়ে স্কুলছুটের হিসেব কষতে আগামী ২৭শে জুলাই রাজ্য শিশু কমিশনকে দিয়ে একটি সভার আয়োজন করেছে৷ যাকে আই ওয়াশ ছাড়া আর কি বা বলা যেতে পারে?

আনন্দ হান্ডা

সাধারণ সম্পাদক

বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি