করোনা সংকট মোকাবিলায় ও ত্রাণে এগিয়ে আসা মানুষদের অভিনন্দন দলের

বেহালা পূর্বের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রায় বাহাদুর রোড অধ্যয়নের পক্ষ থেকে ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা বিপর্যয়ে বিপন্ন বেহালা অঞ্চলের শতাধিক মানুষের হাতে চাল, ডাল, আলু, সোয়াবিন ও সাবান তুলে দেন।

করোনা সংক্রমণ সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও ক্রমশ জটিল হচ্ছে। একদিকে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা, অন্যদিকে কর্মহীন দিনযাপন। দিনমজুর, রিক্সাচালক, ভ্যান- টোটো-অটো চালক, হকার, পরিচারিকা সহ দিন আনি দিন খাই মানুষদের রুটি-রুজি সম্পূর্ণ বন্ধ। সমস্যা অন্য রাজ্যে আটকে থাকা পড়ূয়াদেরও। আরও সংকটগ্রস্ত অবস্থা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের। এদের কথা কোনও রকম না ভেবেই ২৩ মার্চ রাত ৮টায় মাত্র চার ঘন্টার নোটিসে লকডাউন জারি করে কয়েক কোটি মানুষের জীবিকাকে কেড়ে নিয়ে খাদ্যহীন, আশ্রয়হীন, পরিজনহীন অবস্থায় চরম উৎকন্ঠায় তাঁদের ঠেলে দেওয়া হল। যে রাজ্যগুলিতে এই পরিযায়ী শ্রমিকরা আটকে রয়েছেন, তাঁরা পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে কীরকম ব্যবহার পাচ্ছেন, তার শিহরণ জাগানো কিছু নমুনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই রাজ্য সরকারগুলি জানে, এরা ভিনরাজ্যের বাসিন্দা, তাদের রাজ্যের ভোটার এরা নন। এদের ক্ষোভ-বিক্ষোভে শাসক দলের ভোটের গুনতিতে টান পড়বে না। তাই এখন এরা শাসকদের কাছে জঞ্জালসম। কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা আরও ন্যক্কারজনক। প্রধানমন্ত্রী মাঝে মাঝেই ‘জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ’ দিতে টিভির পর্দায় আবির্ভূত হয়ে থালা বাজানো, প্রদীপ জ্বালানো আর নাগরিকদেরই সব দায় নিতে নিদান দিলেও, এই পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে একটি কথা খরচ করাও তিনি কর্তব্য বলে মনে করেননি। রাজ্য সরকারও অন্য রাজ্যে আটকে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য কিছু ঘোষণা করলেও সাহায্যের বাস্তবচিত্র খুবই মর্মান্তিক।

করোনা মোকাবিলায় সরকারগুলি যে এত বিজ্ঞাপন, ভাষণ, লকডাউন ইত্যাদি করে, একে ‘কঠিন যুদ্ধ’ বলে মহাদর্পে ঘোষণা করে জনসাধারণকে চরম ক্ষতি স্বীকার করে জিতবার পণ করতে বলে, তারা যে জনস্বার্থের কত বড় চ্যাম্পিয়ান তা ক্ষণে ক্ষণে জানান দিচ্ছে, সেই সরকারগুলি – এই যুদ্ধের প্রথম সারিতে থাকা সৈনিক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং পৌরস্বাস্থ্যকর্মীদের অবশ্য-প্রয়োজনীয় পিপিই দিতে চরম ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলে আজ ‘যুদ্ধের সৈনিক’রাই আক্রান্ত হচ্ছে। করোনা পরীক্ষার ‘কিট’-এর অভাব, কোয়ারেন্টাইনের অপ্রতুল ব্যবস্থা, করোনা চিকিৎসায় হাসপাতাল ম্যানেজমেন্টের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে সংক্রমণের ফলে এক একটি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা আজ আর অজানা নেই। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের বাসস্থানেও চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাকেও কমিয়ে দেখানো হচ্ছে বলে সর্বস্তরেই অভিযোগ। কাজ-হারা কোটি কোটি মানুষের এমন জীবন-যন্ত্রণা, এত কষ্টের পরও তাঁদের ভবিষ্যত কোন গভীর বিপদের দিকে যাচ্ছে তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

বিশ্বে বিভিন্ন দেশের করোনা সংক্রমণের অবস্থা দেখে আমাদের দল মার্চ মাসের শুরু থেকেই অনুমান করেছিল যে, এমন কঠিন এক পরিস্থিতি আসতে চলেছে। দলের সাধারণ সম্পাদক সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন্দ্র, রাজ্য ও জেলা স্তরে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা হোক। দাবি করা হয়েছিল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক সংগঠন, মেডিকেল সায়েন্সের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী, হাসপাতাল ম্যানেজমেন্টের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করে তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এঁদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের মেডিকেল টাস্কফোর্স গঠনের। করোনা পরীক্ষা বাড়াতে এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগানো এবং বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবও গ্রহণ করার জন্য সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। যদি সরকার এইসব পরামর্শ গ্রহণ করত, তাহলে ভিনরাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের এমন সংকটের সমাধান, খাদ্যদ্রব্য বন্টন, চিকিৎসার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা আরও অনেক ভালভাবে করা সম্ভব হত।

এ রাজ্যের জনসাধারণ দেখেছেন, এস ইউ সি আই (সি) দল করোনা মোকাবিলায় সরকারের কাছে যেমন নানা সময়ে প্রয়োজনীয় দাবি তুলে ধরেছে, তেমনি এই নতুন ধরনের রোগের বিষয়ে অনভিজ্ঞতা জনিত যে সমস্যা, তা কাটাতে শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে কী কী সতর্কতা এবং স্বাস্থ্যবিধি জনসাধারণকে মেনে চলতে হবে এবং গোমূত্র দাওয়াই সহ অন্যান্য অবৈজ্ঞানিক চর্চা ও কুসংস্কারকে রুখতে হবে, লিফলেট আকারে তা ছেপে লকডাউন পর্বের অনেক আগেই দলের কর্মীরা জনসাধারণের কাছে বিলি করেছে।

এ রাজ্যে সরকার হঠাৎ করেই গত ২৩ মার্চ যে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিল, সেখানে দলের রাজ্য সম্পাদক মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যেসব বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন, তা মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে করোনা চিকিৎসায়, সংক্রমণ প্রতিরোধে এবং লকডাউন-জনিত কারণে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলায় দলের সেই মতামত কতটা সুচিন্তিত ছিল। যে ইতিবাচক পদক্ষেপগুলি সরকার নিতে বাধ্য হয়েছে, তার সবই দলের দাবি ও প্রস্তাবের মধ্যে ছিল।

লকডাউন চলাকালীন এই সময়ে ফুটপাথবাসী, বস্তিবাসী, পরিচারিকা, পরিযায়ী শ্রমিক, দর্জিশ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, খেতমজুর চাষি, টোটো-মোটরভ্যানচালক, আশাকর্মী, পৌরস্বাস্থ্য কর্মী, চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নানা সমস্যা, রেশনে দুর্নীতি ও অব্যবস্থা, বিদ্যুৎগ্রাহকদের বিল জমায় অসুবিধা, পানচাষিদের পান পরিবহণ ও বিপণনে সমস্যা, শিক্ষাক্ষেত্রের সমস্যা, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার সমস্যা প্রভৃতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীকে অবগত করানো হয়েছে এবং এর মধ্যে বিদ্যুৎবিল জমা সংক্রান্ত ও অন্যান্য কিছু দাবি আদায়ও হয়েছে।

করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের কাছে দাবিপত্র দেওয়া এবং জনগণের মধ্যে করোনা সচেতনতা গড়ে তুলতে খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে মেডিকেল ফ্রন্ট ও বিজ্ঞান সংগঠনগুলি। প্রায় প্রতিদিনই মেডিকেল ফ্রন্ট রাজ্যের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরকে অবহিত করছে। বিদ্যুৎগ্রাহক সংগঠন বিদ্যুৎমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে কিছু দাবি আদায় করতে পেরেছে এবং কিছু বিষয়ে সরকারকে বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। পরিচারিকাদের সংগঠন মুখ্যমন্ত্রী, জেলা প্রশাসন এবং থানায় ডেপুটেশন দিয়ে পরিচারিকাদের মাসিক বেতন পাওয়া এবং কাজের সুরক্ষার দাবি তুলে ধরেছে। অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবি নিয়ে প্রায় সব জেলাতেই শ্রমিক সংগঠন প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রেখে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট রয়েছে। রাজ্য সরকারের পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘স্নেহের পরশ’ প্রকল্প এবং সাধারণ শ্রমিকদের জন্য ত্রাণ ঘোষণা ও বাস্তবেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। তা নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

করোনা সংক্রমণের সমস্যা এমনই মারাত্মক যে অন্যান্য প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক বিপর্যয়ের থেকে চরিত্রগতভাবে যা সম্পূর্ণ আলাদা। সমস্যা মোকাবিলায় দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পরার কোনও উপায় নেই। অথচ উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ সর্বত্রই গরিব অসহায় মানুষের অবস্থা দেখে দলের কর্মীরা স্থির থাকতে পারছেন না। গরিব মানুষের এমন অভূতপূর্ব সংকট দেখে দলও নির্দেশ দিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি বজায় রেখে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। দলের বহু কর্মীই এই পরিস্থিতিতে নিজেদের চরম আর্থিক সংকটের মধ্যেও এগিয়ে এসেছেন প্রতিবেশী অসহায় মানুষটির পাশে দাঁড়াতে। সকল জেলার প্রায় সব লোকাল কমিটিই নিজেরা ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে নিরন্ন মানুষের হাতে কিছু সাহায্য তুলে দিয়েছে। শুধু দলের কর্মীরাই নন, আমাদের সহযোগিতায় ও উদ্যোগে গড়ে ওঠা সমস্ত ফ্রন্ট ও ফোরাম, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থায় যুক্ত মানুষজনও জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী সারা রাজ্যের সর্বত্র এই ত্রাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষকসমাজও। আমরা দলের পক্ষ থেকে তাঁদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।

করোনা সংক্রমণের এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে, নিয়ন্ত্রণ কিভাবে করা হবে, তা মূলত নির্ভর করবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের প্রতিটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা বা না-করার উপর। সমস্যা মোকাবিলায় কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোরে তারা যতটা তৎপর, সমন্বয় সাধনের অভাব ততটাই প্রকট। জনসাধারণের এমন চরম সংকটের সময়ে দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি– যাদের মুনাফা নির্ভর করে শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের উপর, কর্মহীন না-খাওয়া সেই শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে তারা কোনও কথা তো বলছেই না, বরং লকডাউনের সময়ে তাদের মুনাফায় টান পড়ায় সরকারের কাছে তথাকথিত ‘ত্রাণের প্যাকেজ’ ঘোষণার দাবি করছে। কেন্দ্রীয় সরকারও ইতিমধ্যে ঋণের উপর সুদের হার কমিয়ে, রপ্তানি শুল্ক কমিয়ে, আবাসন শিল্পে আরও দশ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে, লোকচক্ষুর অন্তরালে আরও নানা সুবিধা দিয়ে পুঁজিপতিদের জন্য কয়েক লক্ষ কোটি টাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। উল্টোদিকে পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি করে, আমানতকারীদের সুদ ও স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার কমিয়ে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ মানুষের উপর আর্থিক আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে।

ফলে এটা সহজেই অনুমেয় যে, জনসাধারণের চরম ক্ষতির বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত একদিন করোনা-মুক্তি ঘটলেও, পরিস্থিতি মোকাবিলার নামে বিপুল কর্মচ্যুতি, ছাঁটাই, মজুরিহ্রাস, শ্রমঘন্টা বৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, বেতন ছাঁটাই সহ আরও আক্রমণের সম্ভাবনা পুরোমাত্রায় রয়েছে। এখন করোনা মোকাবিলার নামে ভাষণ দেবার প্রয়োজনে গরিব মানুষের জন্য যতটুকু প্রতারণাপূর্ণ আর্থিক প্যাকেজ নেতা-মন্ত্রীরা ঘোষণা করছেন, তখন সেটুকু করারও আর তাদের প্রয়োজন থাকবে না। দেশকে ‘আবার শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে’, ‘আচ্ছে দিন’ আনতে সেই হতদরিদ্র জনসাধারণকেই তিলে তিলে মূল্য চোকাতে হবে। হৃদয়হীন এই সরকারগুলির শাসনে অভাব-দারিদ্র-রোগব্যাধি কোন পর্যায়ে পৌঁছবে তা ভাবতে গেলেও আতঙ্ক জাগে। তখন এই অসহায় মানুষগুলিকে সাহায্য করার প্রয়োজন আরও অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে তাঁদের দাবি তুলে ধরতে আন্দোলনে সামিল হওয়ার, আর তাঁদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। দলের প্রতিটি কর্মীকে সমাজের বিবেকবান মানুষের কাছ থেকে সমস্ত রকমের সাহায্য সংগ্রহ করে দলের উদ্যোগে ত্রাণের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাই এখন যেমন দলের কর্মীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তেমনি ঘনিষ্ঠজনদের কাছে ভবিষ্যতেও আরও বেশি সাহায্যের আবেদন জানিয়ে সেই ত্রাণের প্রস্তুতিও গড়ে তুলুন – রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে এই আবেদনও করা হয়েছে।