কমরেড লুকোস ছিলেন কমরেডদের হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করা নেতা — স্মরণসভায় কমরেড প্রভাস ঘোষ

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর পলিটবুরো সদস্য, কেরালার পূর্বতন রাজ্য সম্পাদক কমরেড সি কে লুকোস ১৩ ফেব্রুয়ারি তিরুবনন্তপুরমে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে ২৫ ফেব্রুয়ারি হাওড়ার শরৎসদনে তাঁর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়৷ সভাপতিত্ব করেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ৷ শ্রদ্ধা নিবেদন করে বক্তব্য রাখেন কেরালা রাজ্য সম্পাদক কমরেড ভি ভেনুগোপাল৷ মূল বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ, যা এখানে প্রকাশ করা হল৷

এ কথা আপনারা জানেন, আমরা স্মরণসভায় প্রয়াত নেতা ও কর্মীর জীবন সংগ্রামকে স্মরণ করি একটি উদ্দেশ্য নিয়ে, তা হল, আমরা যারা জীবিত, তারা মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র হিসাবে প্রয়াত বিপ্লবীর জীবনসংগ্রাম থেকে কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি৷ এও আপনারা জানেন আমাদের পার্টি নিছক একটা পার্টি নয়৷ আমাদের পার্টি একটি নতুন ধরনের পরিবার৷ যখন পুঁজিবাদী সমাজের অবক্ষয়, চতুর্দিকে পচাগলা পরিবেশ ও মূল্যবোধের সঙ্কটে সামাজিক–পারিবারিক জীবন ভাঙছে, তখন কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে উন্নত কমিউনিস্ট নৈতিকতার আধারে একটি নতুন পরিবার গড়ে তোলার সংগ্রামে আমরা লিপ্ত আছি৷ আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিছক কাজ দেওয়া–নেওয়ার সম্পর্ক নয়, এক মহান বৈপ্লবিক আদর্শ ও নৈতিকতার ভিত্তিতে এই সম্পর্ক গভীর হৃদয়বৃত্তিজাত স্নেহ–মমতার সম্পর্ক৷ ফলে এই পরিবারের কোনও সদস্যকে যখন আমরা হারাই, অগ্রণী সদস্যকে যখন আমরা হারাই সেটা সকলের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক৷ পলিটবুরোর সদস্য প্রয়াত কমরেড লুকোসকে আপনারা নামে জানেন, দূর থেকে মিটিংয়েও দেখেছেন৷ কিন্তু তাঁর সংগ্রাম, তাঁর ভূমিকা –এ সম্পর্কে কেরালার বাইরের কমরেডরা বিশেষ অবহিত নন৷ এটা আমাদের ব্যর্থতা৷ ইতিপূর্বে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা এক একটা সীমাবদ্ধ জায়গায় পরিচিত ছিলেন, গোটা দেশে তাঁদের ভূমিকার দ্বারা কমরেডদের সাথে তাঁদের পরিচয় ঘটেনি৷ এবারের পার্টি কংগ্রেসের পর এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, যাতে গোটা দেশেই কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা কমরেডদের জানেন, কমরেডরাও তাঁদের চেনেন–জানেন৷ সেইজন্য আমি প্রথমেই এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি কথা বলতে চাই৷

মাল্যদান করছেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

এখান থেকে বহুদূরে আরব সাগরের তীরে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে কমরেড লুকোসের মতো এমন একটি চরিত্র গড়ে উঠল কী করে, সে কথাই আপনাদের বলতে চাই৷ ওখানে কাজের সূচনা হয় ’৬৮–৬৯’ সালে৷ পশ্চিমবঙ্গের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একজন ডিএসও কর্মী পার্টির সমর্থক কুইলন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে যান৷ তাঁকে বলা হয় কিছু বইপত্র নিয়ে যেতে, যাতে সেখানে কিছু প্রচার করতে পারেন৷ তাঁর প্রচেষ্টায় কিছু ছাত্র আকৃষ্ট হয়৷ তাঁদের মধ্যে কমরেড লুকোস ছিলেন অন্যতম৷ সেইসময় কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীকে কেরালায় পাঠানো হয়েছিল৷ তিনিও সেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ সেইসময় এই ছাত্রদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য যিনি ছিলেন, তাঁকেও আমরা অকালে হারাই৷ তিনি হচ্ছেন কমরেড নটরাজন, যাঁর আঁকা কমরেড শিবদাস ঘোষের একটি ছবি এখনও কলকাতা অফিসে আছে৷ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কমরেড লুকোস৷ এঁরা কয়েকজন প্রথম কাজ শুরু করেন৷ কমরেড নটরাজনের আকস্মিক মৃত্যুতে কমরেড লুকোস প্রবল বিচলিত হন৷ কিন্তু শোক ও দ্বিধা–দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে তিনি পার্টির অধিক দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন৷ এখানে আপনাদের আরেকটা দিক বলা দরকার৷ কেরালায় যখন পার্টির কাজ শুরু হয়, তখন সারা দেশে আমাদের পার্টির পরিচিতি আজকের তুলনায় অনেক কম ছিল৷ দক্ষিণ ভারতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর নাম, কমরেড শিবদাস ঘোষের নাম পৌঁছায়নি৷ পশ্চিমবাংলার মতোই কেরালায় অবিভক্ত সিপিআই খুব শক্তিশালী পার্টি ছিল৷ তাদের প্রথম যুগের নেতারা লড়াকু ছিলেন, সৎ ছিলেন৷ কেরালায় সিপিআই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল৷ নেতারা অত্যন্ত পপুলার ছিলেন৷ কেরালায়  সিপিআই প্রথম সরকার গঠন করে ১৯৫৭ সালে৷ এইরকম ছিল তাদের শক্তি ও ভূমিকা৷ এর বিরাট অংশ নিয়েই ১৯৬৪ সালে সিপিএম গঠিত হয়৷ সেইসময় তাঁদের নেতারাও সংগ্রামী ছিলেন৷ ওই সময়ে সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন তাঁদের পক্ষে ছিল৷ যে সমস্যা বা বাধা সূচনাপর্বে আমরা পশ্চিমবঙ্গে মোকাবিলা করেছিলাম, ’৪৮–’৫২ সালে, কেরালাতেও পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে প্রতি ইঞ্চিতে একই সমস্যা ছিল৷ এরাই তো কমিউনিস্ট, এরাই তো আছে, এরাই তো লড়ছে, ওদের রাশিয়া–চীন সমর্থন করছে, তাহলে আপনারা কমিউনিস্ট বলে দাবি করছেন কেন –এই প্রশ্নগুলি আমাদের কর্মীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে৷ আপনাদের জানা দরকার, পার্টি ওখানে কীভাবে গড়ে উঠেছে৷ সেই অবস্থায় গুটিকয়েক কমরেড উদ্যোগ নেন৷ তার মধ্যে কয়েকজন কঠিন সংগ্রামে এগোতে না পেরে পিছিয়ে যান৷ এরপরে কেরালা পার্টি আরও সঙ্কটে পড়ে যখন তৎকালীন সম্পাদকের বিচ্যুতি ঘটে৷ কমরেড ভেনুগোপালরা তখন ছাত্র৷ এইসময়ে কমরেড লুকোস এগিয়ে আসেন এবং পার্টিকে রক্ষা করার জন্য হাল ধরেন৷ এরপর আর তিনি পিছনে ফিরে তাকাননি৷  একথা আমি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই৷

আরেকটা কথা বলতে চাই৷ আমরা এখানে মঞ্চে যাঁরা আছি, কমবেশি আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষের সান্নিধ্য পেয়েছি৷ অনেকেই তাঁকে দেখেছেন, পেয়েছেন৷ কমরেড লুকোস কমরেড শিবদাস ঘোষকে মিটিংয়ে দেখেছেন৷ কখনও হয়তো দু’চারটে কথা হয়েছে এই পর্যন্ত৷ কিন্তু এর বেশি সুযোগ তিনি পাননি৷ কিন্তু এই সুযোগ না পেলেও কমরেড শিবদাস ঘোষের রচনার মধ্যে যে অমূল্য বৈপ্লবিক শিক্ষাগুলি আছে, তিনি সেগুলি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন৷ একদিকে কেরালা পার্টির সঙ্কট, জুনিয়ার কিছু কর্মী, তাঁদের আশা–ভরসা দিয়ে রক্ষা করা, অন্যদিকে নিজেকে যোগ্য কমিডনিস্ট হিসাবে গড়ে তোলার সংগ্রাম৷ নীরবে, নিঃশব্দে এক কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে তিনি নিজেকে আমূল পরিবর্তন করে করে ক্রমাগত এগোতে থাকেন৷ কমরেড ভেনুগোপালের কাছে শুনেছেন, পরিবারকেও তিনি কীভাবে পাল্টেছেন৷ ঘরে–বাইরে, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তিনি সংগ্রাম করেছেন৷ কোথাও আপস করেননি৷ এখানেই মার্কসবাদী তত্ত্বের একটি মূল্যবান শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়৷ মার্কসবাদী তত্ত্বে আছে, এক্সটার্নাল কন্ট্রাডিকশন ইজ দ্য কন্ডিশন অফ চেঞ্জ অ্যান্ড ইন্টার্নাল কন্ট্রাডিকশন ইজ দ্য বেসিক কজ অফ চেঞ্জ৷ বাইরের প্রভাব তখনই কার্যকরী হয়, যখন তা অন্তর থেকে গ্রহণ করা হয়৷ অনেকে বড় নেতার সাহচর্যে থেকেও অনেক বইপত্র পড়েও নিজেকে পাল্টাতে পারে না৷ আবার কেউ কেউ সংস্পর্শ না পেলেও, দূরে থেকেও, বিপ্লবী শিক্ষাগুলিকে জীবন্তভাবে গ্রহণ করে নিজেকে পাল্টাতে পারেন, নিজেকে ক্রমাগত উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেন৷ এটা যে সম্ভব কমরেড লুকোস তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত৷

কমরেড লুকোসের নেতৃত্বে কেরালাতে পার্টি সিপিএমের মতো শক্তির সাথে প্রতি পদে পদে লড়াই করে করে, প্রতি ইঞ্চিতে লড়াই করে করে– তাদের অপপ্রচার, তাদের হামলা, তাদের কুৎসা– সবকিছুকে পরাস্ত করে আজকে তারা পার্টির কত বিস্তার ঘটিয়েছে সেটা ওদের রিপোর্টেই আছে, আমি আপনাদের পড়ে শোনাই৷ কেরালাতে ১৪টি জেলার মধ্যে ১১টি নির্বাচিত জেলা কমিটি, দু’টি অর্গানাইজিং কমিটি আছে৷ আরেকটি জেলায় কাজ শুরু হয়েছে, এখনও কমিটি হয়নি৷ সেখানে পার্টি মেম্বার ও অ্যাপ্লিক্যান্ট মেম্বার এক সহস্রাধিক, তাছাড়া কয়েক হাজার সমর্থক আছেন৷ সেখানে ট্রেড ইডনিয়ন, ডি এস ও, ডি ওয়াই ও, এম এস এস সমস্ত সংগঠন কাজ করছে৷ ট্রেড ইডনিয়নের অধীনে ২৬টি ইডনিয়ন রেজিস্টার্ড আছে৷ বিজ্ঞান ও মেডিকেল সংগঠন আছে৷ কমরেড ভেনুগোপাল বলে গেছেন, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুসারে, যেটা এখনও পর্যন্ত কোনও রাজ্য করতে পারেনি, তারা কেরালায় স্থায়ীভাবে ‘জনকিয়া প্রতিরোধ সমিতি’ বলে একটি গণকমিটি গড়ে তুলেছে রাজ্যব্যাপী৷ এটা তাঁদের কৃতিত্ব৷ জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার ছিলেন তার চেয়ারম্যান৷ এই কমিটির নেতৃত্বে কেরালাতে বহু আন্দোলন হয়েছে৷ এই কমিটি আজও কাজ করে যাচ্ছে৷ এর মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ আইয়ারের সাথে এত গভীর সম্পর্ক হয়েছিল যে তিনি কলকাতায় আমাদের বহু প্রোগ্রামে এসেছিলেন৷ কেরালার পার্টি এই কাজটা করতে পেরেছিল৷ কেরালাতে সেভ এডুকেশন কমিটিতে তাঁরা এক্স ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ করিমকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন৷ ডঃ করিম পার্টির একজন সমর্থকে পরিণত হয়েছিলেন৷ কেরালাতে তাঁরা বহু বুদ্ধিজীবীকে এভাবে জড়ো করেছেন৷ কমরেড লুকোস বুদ্ধিজীবীদের যেমন আকৃষ্ট করতে পারতেন, তেমন সাধারণ মানুষকেও পারতেন৷ ওদের আর একটা বড় অবদান – গরিবদের জন্য একটা মেডিকেল সেন্টার বা হাসপাতাল অত্যন্ত কম খরচে তাঁরা চালান বহুদিন থেকে৷ রাজ্য কমিটির একজন হোলটাইমার ডাক্তার কমরেড, হোল টাইম সেখানে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন৷ এছাড়াও সেখানে মদবিরোধী কমিটি, নারী নির্যাতনবিরোধী কমিটি, কৃষক স্বার্থরক্ষা কমিটি, অ্যান্টি ইম্পিরিয়ালিস্ট ফোরাম– এরকম বহু সংগঠন তাঁরা গড়ে তুলেছেন৷ যেমন কেরালার নার্সরা রাজ্যে চাকরি না পেয়ে দেশের অন্য রাজ্যে এমনকী বিদেশে গিয়ে কাজ করেন, নানা অসুবিধায় পড়েন, অভিভাবকরা আশঙ্কায়–উদ্বেগে থাকেন, সেইজন্য পার্টি ওখানে নার্সেস পেরেন্টস ফোরাম গড়ে তুলেছে৷ কেরালার পার্টি বহু ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করেছে ও করে যাচ্ছে, যার জন্য ওখানে পাবলিকের কাছে একমাত্র আমাদের দলই লড়াইয়ের পার্টি হিসাবে আস্থা অর্জন করেছে৷ এবার কেরালায় যে ভয়াবহ বিধ্বংসী বন্যা হয়েছে, তাতেও একমাত্র দল হিসাবে আমাদের দলের কর্মী–সমর্থকেরা সর্বশক্তি দিয়ে বন্যাত্রাণে ও রিলিফের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেটা সর্বস্তরের জনগণ প্রশংসা করেছেন৷ এসব কর্মকাণ্ডে ও আন্দোলনে কমরেড লুকোস ছিলেন প্রেরণার উৎস৷ আপনারা শুনেছেন, কমসোমল সংগঠন সেখানে কীভাবে গড়ে উঠেছে৷ আমাদের পার্টির একটি বিশেষ সংগঠন হচ্ছে, পার্টি কমিউনের পূর্ববর্তী স্তর পার্টি সেন্টার৷ এটা বিশ্ব কমিডনিস্ট মুভমেন্টে আগে ছিল না৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে যৌথজীবন গড়ে তোলার জন্য এ একটা বিশেষ সংগঠন৷ কনস্ট্যান্ট কমন অ্যাসোসিয়েশন, কনস্ট্যান্ট কমন ডিসকাশন লিডিং টু কনস্ট্যান্ট কমন অ্যাক্টিভিটিস টু ডেভেলপ ইট ফারদার কনস্ট্যান্ট কমন লিভিং– দ্যাট ইজ পার্টি সেন্টার৷ এটা খুবই কঠিন সংগ্রাম৷ এর মধ্যে দ্বন্দ্ব–সংঘাত আছে, এর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আছে, এর মধ্যে তিক্ততা আছে৷ আমাদের কমরেডদের মধ্যে বুর্জোয়া কালচারের প্রভাব আছে৷ বুর্জোয়া কালচারের আক্রমণ আছে৷ পার্টি সেন্টারেও তার প্রভাব পড়ে৷ আবার এখানে কমরেড ঘোষ প্রদর্শিত সর্বহারা সংস্কৃতি আয়ত্ত করার সংগ্রামও আছে৷ এই সেন্টারগুলি আমরা চালাই কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে৷ কেরালাতে এরকম ২৬টি পার্টি সেন্টার আছে৷ এগুলির সবকটিই গাইড করেছেন কমরেড লুকোস৷ বক্তৃতা দেওয়া, লেখা তৈরি করা, এমনকী পাবলিক অ্যাজিটেশন গড়ে তোলা অনেক সহজ, কিন্তু এক একজন করে ব্যক্তিকে নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা, তাকে কেরিয়ার থেকে মুক্ত করা, পারিবারিক জীবন থেকে মুক্ত করা এবং নানা প্রতিকূল আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করা, এভাবে তাকে ডেভেলপ করানো, তাকে বিকশিত করা– এটা সহজ কথা নয়৷ এ ধরনের কয়েকশো কর্মী কমরেড লুকোস এইভাবে তৈরি করেছেন৷ কেরালাতে পার্টি হোলটাইমার হচ্ছে শতাধিক, যাঁরা ঘরবাড়ি, ব্যক্তিগত স্বার্থ সবকিছু ছেড়ে পার্টি নিবেদিত প্রাণ হয়ে পার্টির কাজ করছেন৷ কে এঁদের উদ্বুদ্ধ করেছেন? হু ইজ দ্যাট লিডার? লিডার ইজ কমরেড সি কে লুকোস – কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় সুশিক্ষিত নেতা৷

কর্মীরা সেই নেতার আহ্বানেই সাড়া দেয়, সব কিছু ছেড়ে এগিয়ে আসে, যে নেতা মুখে যা বলে, কাজে–চলনে–বলনে–আচরণে-ব্যক্তিগত জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই কথা অনুযায়ী ক্রিয়া করে, অন্তত করার সংগ্রাম চালায়৷ কমরেড লুকোস এইস্তরের নেতা ছিলেন বলেই কর্মীদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন৷ তিনি রাজ্যের লিডার নির্বাচিত হয়েছেন ১৯৮৮ সালে৷ কিন্তু তার আগে থেকেই তিনিই লিডার ছিলেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ যেটা বলতেন, দুই ধরনের লিডার আছেন৷ একটা হচ্ছে কনফারেন্সে ইলেক্টেড লিডার৷ আরেকটা হচ্ছে, ইলেক্টেড হোক আর না হোক, কর্মীদের শ্রদ্ধা ভালবাসা আস্থা বিশ্বাস অর্জন করে তাদের হৃদয় থেকে গ্রহণ করা নেতা৷ কমরেড লুকোস এই স্তর অর্জন করতে পেরেছিলেন৷ প্রত্যেকটি কর্মীর প্রতিটি সমস্যা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তিনি শুনতেন, গভীর ভালবাসায় তাঁদের সাহায্য করতেন৷ আমি দেখেছি, শুনতেন বেশি, নিজে খুব কম কথা বলতেন৷ অল্প কথায় বোঝাতেন৷ কিন্তু যে বক্তব্য রাখতেন অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ, মর্মস্পর্শী আবেদন, যেটা অপরের অন্তরকে স্পর্শ করত৷ ছোটবড় নির্বিশেষে প্রত্যেকে তাঁর সাথে মিশত৷ তাঁর চলন–বলন–আচরণ দেখে বোঝাই যেত না হি ওয়াজ এ লিডার৷ কমরেডদের সাথে যখন থাকতেন, অ্যাজ এ ফ্রেন্ড, অ্যাজ এ কলিগ থাকতেন৷ কমরেডদের সমালোচনা গ্রহণ করতেন, পার্টি কংগ্রেসের আগেও লাস্ট মিটিংয়েও যে সমালোচনা হয়েছে, সেই সম্পর্কে লিখেছেন যে, আমার ক্রিটিসিজম হয়েছে, আই অ্যাম হ্যাপি বাই দ্যাট৷ কমরেডরা মন খুলে তাঁর সাথে কথা বলতে পারতেন৷ তাঁকে কিছু বলতে, মতপার্থক্য ব্যক্ত করতে কমরেডদের কোনও দ্বিধা–সঙ্কোচ থাকত না৷ সবসময় কমরেডদের এডুকেট করতেন৷ আবার তাঁদের কাছ থেকে শেখার মনও ছিল৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র হিসাবে তিনি যেসব গুণাবলি অর্জন করেছিলেন, এর থেকে দলের অন্য নেতা ও কর্মীদেরও শিক্ষা নিতে হবে৷ মার্কসবাদের ক্ল্যাসিকস, কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য, পার্টির প্রকাশিত বক্তব্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন৷ এছাড়াও সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতিরও নানা বিষয় চর্চা করতেন৷ দেশবিদেশের সাহিত্য ও নানা পৌরাণিক কাহিনি পড়তেন এবং ছোটদের গল্প করে করে নানা বড় মানুষদের জীবন শোনাতেন, তাদের মন বিকশিত করার জন্য৷ এরকম কয়েকশো শিশুকে তিনি মানুষ করেছেন৷ তাদের কাছে মোর দ্যান ফাদার হয়ে গিয়েছেন তিনি৷

কেরালার মাটিতে যেখানে সিপিএম মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-কমিউনিজমকে কলঙ্কিত করেছে, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে কমরেড লুকোসের নেতৃত্বে মার্কসবাদ–লেনিনবাদ, তার মহত্ত্ব তার শ্রেষ্ঠত্ব ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে সেখানকার পার্টি৷ একটা যথার্থ কমিডনিস্ট চরিত্র কাকে বলে, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই চরিত্রগুলো দেখে কেরালার সচেতন মানুষ ক্রমাগত আকৃষ্ট হচ্ছে আমাদের দলের প্রতি৷ কমরেড লুকোস কেরালার বুকে একটা মডেল কমিডনিস্ট ক্যারেক্টার হিসাবে সামনে এসেছেন৷ যার জন্য পার্টির বাইরেরও বহু মানুষের শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করেছেন৷ অথচ এতটুকু অহঙ্কার–আত্মম্ভরিতা তাঁর মধ্যে ছিল না৷ আমি এই করেছি, ওই করেছি, এসব বলা তাঁর মধ্যে ছিল না৷ বরং ছিল আরও কত কিছু করা বাকি আছে৷ আমাদের সঙ্গে যখন আলোচনা করতেন, একজন ছাত্রের মতো জানবার মন নিয়ে করতেন৷ একদিকে অত্যন্ত মৃদুভাষী, বিনয়ী, কোমল চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, আবার নীতি আদর্শের প্রশ্নে অত্যন্ত দৃঢ় এবং আপসহীন ছিলেন৷

প্রথম যুগে যে নেতার সংস্পর্শে এসেছিলেন, যাঁকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালবাসতেন, খুব প্রিয় মনে করতেন, সেই নেতার যখন নৈতিক অধঃপতনের ঘটনা জানলেন, তিনি তখন অসুস্থ শয্যাশায়ী, খুবই ব্যথা পেয়েছেন, কিন্তু তীব্র ভাষায় সেই আচরণের প্রতিবাদ করেছেন৷ সেই নেতা বারবার তাঁর কাছে আবেদন করেছেন৷ কিন্তু এতটুকু বিচলিত হননি৷ অবিচলিতভাবে পার্টির সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন৷ এখানে আপনাদের স্মরণ করাতে চাই, কমরেড শিবদাস ঘোষ মজফফরপুরে একটা স্কুল অফ পলিটিক্সে বলেছিলেন যে, আমি শিবদাস ঘোষ যে আদর্শ ও নীতির কথা বলছি, কোনওদিন যদি দেখেন আমি এতটুকু তার থেকে বিচ্যুত হয়েছি, আপনারা আমাকে বের করে দেবেন৷

কমরেড শিবদাস ঘোষের এই শিক্ষা কমরেড লুকোস বুকে বহন করতেন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের সতর্ক করে গিয়েছেন, কমিডনিস্ট চরিত্র অর্জন করার সংগ্রাম অত্যন্ত কঠিন সংগ্রাম৷ আমরা সবাই বুর্জোয়া সমাজ থেকে এসেছি৷ এই বুর্জোয়া সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ ঊনবিংশ শতাব্দীর নয়, বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের নয়৷ আজকের বুর্জোয়া সমাজ অতি নোংরা, কুৎসিত, বীভৎস৷ সেই পরিবেশের মধ্যে আমরা বাস করি৷ ফলে তিনি বলেছেন, প্রতি মুহূর্তে সর্বোচ্চ নেতা থেকে শুরু করে সকলকে এই ক্লেদাক্ত পরিবেশের দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়৷ সবসময় সতর্ক সজাগ থেকে লড়তে হবে৷ না হলে অতি ক্ষুদ্র ভাবে সঙ্গোপনেও আক্রমণ ঘটবে স্নেহ–মমতা–নাম করা–হঙ্কারের প্রশ্নে এতটুকু দুর্বলতা থাকলে৷ উইপোকার মতো ভিতরটা খেয়ে দেবে৷ সর্বোচ্চ নেতারও রেহাই নেই৷ বলেছেন কোনও নেতার প্রতি অন্ধ থাকবে না৷ দলের স্বার্থ, বিপ্লবের স্বার্থ সর্বোচ্চ৷ ফলে নেতার ত্রুটি–বিচ্যুতি দেখলে পার্টি ও বিপ্লবের স্বার্থে তার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়াবে৷ ইউ মাস্ট স্ট্যান্ড আপ অ্যান্ড ফাইট আউট বোল্ডলি৷ আমি মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি কমরেড সি কে লুকোস নিজেকে কমরেড শিবদাস ঘোষের সুযোগ্য ছাত্র হিসাবে হিসাবে প্রমাণ করেছেন৷ তিনি তাঁর পূর্বতন নেতার ত্রুটির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন৷ মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করেননি৷ এটাও আমাদের কাছে একটা দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা৷

কমরেডস, মার্কসবাদী হিসাবে আমরা জানি, একটা ব্যক্তিত্ব, একটা নেতৃত্ব, একটা দক্ষতা জন্মগতভাবে আসে না৷ সৎভাবে চেষ্টা করলেও হয় না৷ আবার যেকোনও ব্যক্তি সাধারণ স্তর থেকেও অনেক উন্নত স্তরে উন্নীত হতে পারে৷ এটা নির্ভর করে যে সময়ে আমার অবস্থান সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী আদর্শ, বিপ্লবী সংস্কৃতি– তাকে বুঝে, গ্রহণ করে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে কীভাবে লড়াই করে আমি এগোচ্ছি তার ওপরে৷ সমস্যা আসবে, বাধা আসবে, আচমকা আক্রমণ আসবে, আপন লোক দূর হয়ে যাবে, মিত্র শত্রু হয়ে যাবে, সহযাত্রী বিরুদ্ধ পক্ষে চলে যাবে, যাকে ভালবেসে গ্রহণ করেছি তখন তার স্ট্যান্ডার্ড ছিল, একটা স্তরে এসে দেখছি সেই স্ট্যান্ডার্ড নেই, অবনমন ঘটছে৷ কমরেড ঘোষ বলছেন, আপস নয়,  ছিটকে যাবে, নো পিসফুল কো–এগজিস্টেন্স৷ গুলির মুখেও যে দাঁড়াতে পারে তেমন লোকও স্নেহ–মমতা–প্রেম–ভালবাসায় দুর্বল হয়ে হোঁচট খায়৷ এক্ষেত্রেও কমরেড ঘোষের ওয়ার্নিং আছে৷

আমাদের দলে নতুন ধরনের মানুষ সৃষ্টির একটা সংগ্রাম চলছে৷ যে সংগ্রামের পথ কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়ে গেছেন৷ তিনি নিজে সৃষ্টিও করেছেন৷ গোটা বিশ্বে আজ কমিডনিস্ট মুভমেন্টের চরম সঙ্কট৷ আজকের যুগে কমিউনিস্ট হওয়া খুব কঠিন৷ একসময় কমিউনিজমের হাওয়ায় অনেকে কমিউনিস্ট হয়েছিল, ’৪০–’৪২–’৪৫–’৫০ সালে৷ মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের লড়াই, এসব একটা প্রবল জোয়ার এনেছিল, কমিউনিস্ট হওয়ার জন্য মানুষের একটা প্রবল আকাঙক্ষা এসেছিল৷ আজ গোটা বিশ্বে প্রতিক্রিয়ার জোয়ার চলছে৷ কমিউনিজম সম্পর্কে মানুষের বিভ্রান্তি, হতাশা সৃষ্টি হয়েছে৷ সেই অবস্থায় কমিউনিস্ট হওয়া, কমিউনিস্ট হিসাবে নিজেকে রক্ষা করা এবং আজকের অধঃপতিত পরিবেশে এটা করা খুবই কঠিন সংগ্রাম৷ এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে কমিউনিস্ট হিসাবে কীভাবে রক্ষা করা যায় সেই সংগ্রামে কমরেড লুকোস দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন৷ তাঁর শেষ জীবনের সংগ্রাম, অসুস্থ অবস্থার সংগ্রাম কমরেড রাধাকৃষ্ণ আপনাদের কাছে রেখেছেন৷ কিছু কিছু আমিও লক্ষ করেছি৷ ওই শরীর নিয়েও সেন্ট্রাল কমিটির মিটিংয়ে আসতেন৷ শরীরের সমস্যা বলে কোনও দিন আপত্তি করেননি৷ শিবপুরে যখন থাকতেন, নানা তত্ত্বগত প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা করতেন৷ যখন আর আসতে পারছেন না, আমি দু’ বার গিয়েছি কেরালাতে৷ একটা ক্লাসে আমি দেখেছি, তাঁকে চেয়ারে করে তুলে আনছে, তিনি শুনবেন৷ বেশিক্ষণ চেয়ারে বসতে পারছেন না৷ পাশের ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে৷ আমি ভেবেছি বোধহয় রেস্টের জন্য চলে গেছেন৷ পরে জানলাম পাশের ঘরে শুয়ে শুনছেন৷ এত জানার আগ্রহ পরের বারেও একই জিনিস দেখলাম৷ শরীর খারাপ, মিটিংয়ে যেতে পারব না– এসব তাঁর ছিল না৷ হাঁটতে পারেন না, চলতে পারেন না, এমনকী কথাও বলতে পারেন না, কিন্তু তাঁর ব্রেন অ্যাক্টিভ, শোনার আগ্রহ প্রবল৷ মুখচোখে কখনও রোগের ছাপ নেই৷ আমি কখনও দেখিনি৷ হাত–পা নাড়তে পারেন না, খেতেও পারেন না, শুতে–বসতে পারেন না, কিন্তু কমরেডদের সামনে বা আমাদের উপস্থিতিতে চেহারার মধ্যে রোগের ছাপ নেই৷ মুখচোখ জ্বলজ্বল করছে৷ শেষবার আমি যখন গেলাম দেখা করতে, অস্ফুটে, অন্যের মাধ্যমে আমাকে কয়েকটি কথা বললেন, কেরালার পার্টিকে দেখবেন, আর বললেন, আপনার শরীরের যত্ন নেবেন৷ তিনি বুঝেছিলেন, মৃত্যু আসন্ন৷ কেরালা পার্টিকে দেখা কেন্দ্রীয় কমিটির কর্তব্য৷

এখানেই শেষ নয়৷ আরেকটা রিকোয়েস্ট আমাকে করেছিলেন যে, আমাকে সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দিন এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতেও রাখবেন না৷ এখানে আমি দ্বিমত জানাই৷ আমি বলি, আপনি অবশ্যই কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকবেন৷ কারণ, আপনার পরামর্শ, মতামত আমাদের প্রয়োজন৷ তিনি সম্মত হন৷ ঘাটশিলায় যখন পার্টি কংগ্রেস চলছিল, আমি দেখছি ফটো উঠছে, ছবি তুলছে অনেকে, যেটা আজকাল ঘটে৷ তারপরে আমি, কমরেড হায়দার শেষে যখন ডায়াস থেকে নামছি, কেরালার কমরেড যিনি ফটো তুলছিলেন, তিনি বললেন কমরেড লুকোস আপনার সাথে কথা বলবেন৷ জানলাম, পুরো পার্টি কংগ্রেসের খুঁটিনাটি তিনি ভিডিওতে দেখেছেন৷ কখনও বসে, কখনও শুয়ে৷ গোটা পার্টি কংগ্রেসটা ফলো করেছেন৷ ডেলিবারেশন ফলো করেছেন৷ এই অসুস্থ শরীরেও কী প্রবল আগ্রহ তারপর আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, রেড স্যালুট করলেন৷ আমরাও রেড স্যালুট জানালাম৷ তখনই বুঝলাম, এই তাঁর লাস্ট রেড স্যালুট৷

কমরেডস, এই কমরেডটিকে আমি কেমন করে ভুলব? হোয়াট এ ক্যারেক্টার দিস ইজ এ ক্রিয়েশন অফ কমরেড শিবদাস ঘোষ থট৷ এটা আমাদের সবার সামনেই একটা দৃষ্টান্ত৷ রোগ তাঁর কাছে পরাস্ত৷ হি ডিফিটেড হিজ ডিজিজ৷ হি ডিফিটেড অল পেইনস অফ ডিজিজ৷ হি ডিফিটেড ডেথ অলসো৷ হি ডইল রিমেইন ইন দ্য হার্টস অফ দ্য কমরেডস অফ কেরালা৷ জেনারেশন আফটার জেনারেশন অ্যাজ দ্য বিল্ডার অফ দ্য কেরালা পার্টি৷ অ্যাজ দ্য বিল্ডার অফ দ্য এস ইড সি আই (কমিডনিস্ট) ইন কেরালা, ফার্স্ট ইন সাউথ ইন্ডিয়া৷ হি উইল রিমেইন ইন দ্য হার্টস অফ অল ইন্ডিয়া কমরেডস অলসো৷ দিস ক্যারেক্টার ক্যানট বি ফরগটন৷ তিনি কমরেড ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজম মেইনটেইন করে কীভাবে কালেকটিভ ফাংশানিং করতে হয়, সেই শিক্ষাও একদল নেতাকে দিয়ে গেছেন৷ আমি বিশ্বাস করি, সেই কমরেডরা ওয়ান ম্যানের মতো দাঁড়িয়ে প্রয়াত কমরেড লুকোসের আরব্ধ কাজ সফল করবেন৷ এটাই হবে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন৷

কমরেডস, আমি আর একটা কথা বলব৷ এর আগেও আমি বিভিন্ন মিটিংয়ে বলেছি৷ অন্য রাজনৈতিক আলোচনায় আজ আর যাব না৷ পার্টির শক্তি বাড়ছে এ কথা ঠিক৷ যেখানেই চেষ্টা হচ্ছে, যেখানেই কমরেড ঘোষের শিক্ষা নিয়ে আমরা যাচ্ছি সেখানেই কিছু না কিছু সাড়া পাচ্ছি৷ আজ সমস্ত পার্টিগুলিই ডিসক্রেডিটেড, দেউলিয়া৷ সোস্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি অবিভক্ত সিপিআই, তারপর সিপিআই (এম) যারা একটা সময়ে আমাদের সামনে বিশাল বাধা হিসাবে কাজ করেছে, এখন তারা নিজেরাই নিজেদের ডোবাচ্ছে৷ সিপিএম এখন একটা সিটের জন্য বিভিন্ন বুর্জোয়া পার্টিগুলির দরজায় দরজায় ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে৷ সিপিএমের অবস্থা এখন এই৷ আগামী দিন আমাদের পার্টির পক্ষে আরও সম্ভাবনাময় সুযোগ নিয়ে আসছে৷ কিন্তু এখানে একটা হুঁশিয়ারি আছে৷ মহান লেনিন বলেছিলেন, এক্সপ্যানশন অফ মার্কসিজম ইজ অ্যাসোসিয়েটেড ডইথ দ্য লোয়ারিং অফ দ্য ইডিওলজিক্যাল স্ট্রাগল৷ এটা ঘটবেই তা নয়, কিন্তু আশঙ্কা থাকে৷ যখন কম লোক থাকে, কঠিন সংগ্রাম থাকে, কঠিন বাধা থাকে, সেই কঠিন বাধা, অত্যন্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাঁরা এগোয়, তাঁরা অনেক শক্তিশালী মজবুত হয়৷ কিন্তু পূর্বের তুলনায় বাধা যখন কম হয়, প্রতিকূলতা কম হয়, সাফল্য অর্জন সহজতর হয়, তখন আদর্শগত ও চরিত্রগত সংগ্রামে শৈথিল্যের ঝোঁক আসে৷ এই ওয়ার্নিংই লেনিন দিয়েছিলেন৷ আমাদের কমরেডরা, লিডাররা, ইয়ঙ্গার মেম্বারস অফ দ্য সেন্ট্রাল কমিটি, স্টেট সেক্রেটারিজ, ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারিজ ইড মাস্ট কনডাক্ট কন্টিনিউয়াস স্ট্রাগল টু আপলিফট ইয়োর ইডিওলজিক্যাল, কালচারাল স্ট্যান্ডার্ড৷ জুনিয়াররাও নেতাদের প্রতি ব্লাইন্ড থাকবে না, কারেজিয়াসলি ফাইট করবে যখনই নেতা ভুল করছে বলে মনে হবে৷ যদি কমরেডরা ম্যারেড হয়, হাজব্যান্ড ওয়াইফ একে অপরের ত্রুটি দেখলে ফাইট করবে, সন্তানদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নেও ফাইট করবে৷ মনে রাখবেন, এই একমাত্র আদর্শ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা, বিশ্বে একমাত্র আশার আলো৷

সমস্ত মানবসভ্যতা আজ চরম সঙ্কটে৷ শুধু অর্থনৈতিক সঙ্কট নয়, মনুষ্যত্বের সঙ্কট, মানবিকতার সঙ্কট, মূল্যবোধের সঙ্কট – মানুষ বলেই কিছু থাকছে না৷ গোটা মানবজাতির এই অবস্থা৷ এর মধ্যে এই পার্টিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ঝান্ডাকে রক্ষা করতে হবে, মজবুত করতে হবে৷ শুধু কোয়ান্টিটি বাড়ালে চলবে না, কোয়ালিটি চাই৷ আর কোয়ালিটি রক্ষা করতে হলে ইডিওলজিক্যাল–কালচারাল স্ট্যান্ডার্ডকে আপলিফট করার এই স্ট্রাগলটা দরকার৷ ডোন্ট স্পেয়ার এনিওয়ান৷ নট ইভেন জেনারেল সেক্রেটারি অফ দ্য পার্টি, টু সেভ দ্য পার্টি, যে কথা কমরেড ঘোষ বলে গেছেন যে, আমাকেও স্পেয়ার করবে না৷ এই ক্ষেত্রে কমরেড লুকোসের শিক্ষাও স্মরণযোগ্য৷ এই কথা বলে আমি কমরেড ঘোষের একটা আবেদন আপনাদের পড়ে শোনাব, যেটা আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক৷ ১৯৭৪ সালে কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর স্মরণসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘… এই মূল কথাটা আপনাদের ধরতে হবে যে, ভারতবর্ষের বিপ্লব আসব আসব করছে৷ বুঝতে হবে, সমস্ত দিক থেকেই এই সমাজের আর কিছু অবশিষ্ট নেই৷ শাসকগোষ্ঠী কোনও কিছু দিয়েই চেষ্টা করে এই সমাজকে আর টিকিয়ে রাখতে পারছে না৷ ভারতবর্ষের সমাজ মুক্তিযন্ত্রণায় ছটফট করছে৷ শুধু মানুষের সংগঠিত সচেতন রাজনৈতিক আন্দোলনের অভাব আর যতটুকু ন্যূনতম শক্তি হলে জনতার এই বিপ্লবের আবেগ এবং বিপ্লবমুখী অবস্থাটাকে একটা সংগঠিত লাগাতার দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী লড়াইতে নামিয়ে দেওয়া যায়, ততটুকু শক্তিসম্পন্ন একটা সত্যিকারের বিপ্লবী দলের অভাব৷ … মানুষ পরিবর্তন চাইছে৷ পুরনো সমাজের মিলিটারির তাগদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া শাসকগোষ্ঠীর নির্ভর করার মতো আজ আর কিছু নেই৷ আর, তারা নির্ভর করছে মানুষের অজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক বিভ্রান্তির ওপর – কিন্তু এটা খুব বড় নয়৷ বাস্তব অবস্থার চাপ মানুষের ওপর এত পড়ছে যে, সেই অবস্থার চাপের জন্য বিভ্রান্তির যুক্তি, ধর্মের মোহ –এইসব কোনও কিছুই মানুষকে আটকে রাখতে পারবে না৷ বিপ্লবের জোয়ার যদি শুরু হয়, কোনও যুক্তি দিয়েই মানুষকে আটকে রাখা যাবে না৷ … কিন্তু নেই কী? নেই সঠিক বিপ্লবী রাজনৈতিক লাইন, আদর্শ, সর্বব্যাপক বিপ্লবী তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি সত্যিকারের বিপ্লবী দল উপযুক্ত শক্তি নিয়ে৷ দলটা আছে, গড়ে উঠেছে, কিন্তু জনসাধারণের বিক্ষুব্ধ লড়াইগুলো যখন ফেটে পড়ে, তখন সেগুলোকে একটা নির্দিষ্ট বিপ্লবী লাইনে ঠিক রাস্তা ধরে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই শুরু করিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি আজও এই দলটা অর্জন করেনি৷ সেই শক্তিটি যেমন করে হোক, জীবন দিয়ে কর্মীদের দ্রুত অর্জন করতে হবে৷ … আগামী সময়টা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এই পার্টিটাকে দ্রুত অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবার মতো রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক দিক থেকে শক্তিশালী করে আপনাদের গড়ে তুলতে হবে৷ আগে, ভাবলেও আমরা এ কাজ পারতাম না৷ কিন্তু এখন আমাদের যা সংখ্যা, তাতে আমরা প্রতিটি নেতা ও কর্মী যদি ভেবে এটাকে রূপ দেবার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা একাজ করতে পারি৷ তার জন্য প্রত্যেকটি কর্মী তাঁদের আপন উদ্যোগ এবং বুদ্ধি অনুযায়ী – পারুন বা না পারুন, সফলতা হোক, বিফলতা হোক, – কর্মবিমুখ না হয়ে কাজ করে যেতে হবে৷ এই কাজের প্রক্রিয়া হবে– একদিকে আপনারা দলের রাজনীতি বুঝে নিচ্ছেন, আরেকদিকে সেই রাজনীতির ভিত্তিতে জনতাকে যে কোনও ক্ষেত্রে হোক সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন৷’’ এই হচ্ছে কমরেড শিবদাস ঘোষের আবেদন৷ কমরেড সি কে লুকোসের অত্যন্ত বিরল এবং অনুসরণযোগ্য চরিত্র থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের এই আবেদনকে বুকে বহন করে আপনারা এই সমাবেশ থেকে যাবেন৷ এই বলেই আমি এখানে শেষ করছি৷

কমরেড সি কে লুকোস লাল সেলাম

মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক ও শিক্ষক, পথপ্রদর্শক  

কমরেড শিবদাস ঘোষ লাল সেলাম

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩০ সংখ্যা)