কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তীর জীবনাবসান

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তী  দীর্ঘ ৬ বছর দুরারোগ্য স্নায়ুরোগে ভোগার শেষে গত ১৮ জানুয়ারি সকালে বেহালার বিদ্যাসাগর হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর৷

মৃত্যুসংবাদ পেয়েই বেহালা–বড়িশা অঞ্চলের নেতা–কর্মীরা হাসপাতালে ছুটে যান৷ রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড সান্টু গুপ্ত, কমরেড নভেন্দু পাল, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড শিলাজিৎ সান্যাল, কমরেড তপন চক্রবর্তী সহ আঞ্চলিক সম্পাদকরা যান ও মরদেহে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান৷ কমরেড চক্রবর্তীর মরদেহ বেহালায় তাঁর বাড়ি ঘুরিয়ে পূর্ব বেহালার দলীয় কার্যালয়ে আনা হয়৷ সেখানে বহু মানুষ সমবেত হয়ে শ্রদ্ধা জানান৷ এরপর তাঁর মরদেহ লেনিন সরণিতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়৷

কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তী ছোট–বড় সকলের কত প্রিয় ও ভালবাসার পাত্র ছিলেন, বোঝা গেল কেন্দ্রীয় অফিসে বহু কর্মীর উপস্থিতিতে৷ সংবাদ শুনেই তাঁরা চলে এসেছেন বিপ্লবী শ্রদ্ধায় তাঁকে বিদায় জানাতে৷ মরদেহে সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের পক্ষ থেকে মাল্যদান করেন কমরেড স্বপন ঘোষাল৷ পলিটব্যুরোর প্রবীণ সদস্য কমরেড রণজিৎ ধর মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান৷ পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড মানিক মুখার্জী ও কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের পক্ষে মাল্যদান করা হয়৷ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড সৌমেন বসুর পক্ষেও মাল্যদান করা হয়৷ এছাড়া দল ও গণসংগঠনগুলির রাজ্য, জেলা ও অঞ্চল কমিটির পক্ষ থেকে মাল্যদান করে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়৷

১৯৬৭–’৬৮ সালে বেহালায় ‘অধ্যয়ন পাঠাগার’–এর মধ্য দিয়েই তিনি এস ইউ সি আই (সি)–র সংস্পর্শে আসেন৷ ছবি তোলায় তাঁর প্রবল আগ্রহ দেখে একদিন কেন্দ্রীয় অফিসে তাঁকে ডেকে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেন, আপনি তো পার্টি কর্মসূচিগুলির ছবি তোলার দায়িত্ব নিতে পারেন৷ কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তী তৎক্ষণাৎ সেই দায়িত্ব নেন, পার্টিতে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা ওখান থেকেই৷ তিনি নিজে কেবল ফটো তুলতেন তা নয়, অন্য আগ্রহী কমরেডদের শেখাতেন, ক্যামেরাবন্দি ফিল্ম থেকে ছবি তৈরির কাজ নিজ হাতে করার জন্য বাড়িতে ও পার্টির প্রেসে ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন৷ পরবর্তীকালে পার্টি যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে, তিনি নিষ্ঠার সাথে খুশি মনে তা পালন করেছেন৷ নেতৃত্বের কাছে তিনি খোলা মনে সব বিষয় রাখতেন৷ জ্ঞানচর্চায় তাঁর প্রবল আগ্রহ ও নিষ্ঠা ছিল৷ নিজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হলেও তাঁর জ্ঞানচর্চার পরিধি ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান– সর্বত্র বিস্তৃত ছিল৷ মন ছিল গবেষণাধর্মী৷ পার্টির যখন যা প্রয়োজন পড়েছে, তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন৷ লেখালেখিও করতেন অনায়াস সাবলীলতায়৷ সাপ্তাহিক ‘অন্যচোখে’ পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেছেন বহু কাল৷ তারপর পার্টির বাংলা মুখপত্র গণদাবীর মধ্য দিয়ে দলের মতাদর্শগত প্রচারে অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন৷ তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন৷ পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের মুখপত্র ‘পথিকৃৎ’ পত্রিকায় বহু মূল্যবান রচনা ও সম্পাদনায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল৷ ভাষাতত্ত্বে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল, যেজন্য নেতৃত্ব যখন তাঁকে রুশ ভাষা শেখার দায়িত্ব দেন, অতি অল্প সময়ে তিনি সেই ভাষা পড়া ও লেখার ক্ষমতা আয়ত্ত করেন৷ কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তী তাঁর স্বভাব ও বহুমুখী গুণাবলির জন্য পার্টির সর্বস্তরে অত্যন্ত পরিচিত ও প্রিয় ছিলেন৷ শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, অন্যান্য রাজ্যের বহু কমরেডদের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল৷

এত ধরনের ক্ষমতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে অহঙ্কারের প্রকাশ কেউ দেখেনি৷ নম্রতা ও বিনয় ছিল তাঁর স্বভাববৈশিষ্ট্য৷ ২০০৯ সালে বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় নেতৃত্ব তাঁকে গণদাবী প্রেসের কর্মাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন৷ ২০১২ সাল নাগাদ তাঁর শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণগুলি দেখা দিতে শুরু করে৷ প্রধান লক্ষণ ছিল হঠাৎ পড়ে যাওয়া, শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা৷ কলকাতার চিকিৎসায় রোগ নির্ণয় সঠিকভাবে না হওয়ায় তাঁকে কেরালায় ত্রিবান্দ্রম তিরুমল ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, এই রোগের নাম সুপার নিউক্লিয়ার পলসি৷ মাথার পিছন দিকের যে কোষগুলি মানবদেহের স্নায়ুগুলি নিয়ন্ত্রণ করে, সেই কোষগুলি ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে৷ এর কোনও চিকিৎসা নেই, ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন৷ এই রোগের কারণেই সদা কর্মব্যস্ত কমরেড বিপ্লব ধীরে ধীরে ঘরবন্দি হয়ে যান, অবস্থার অবনতি হতেই থাকে৷ অবশেষে তাঁকে প্রথমে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক হাসপাতাল এবং পরে বেহালায় বিদ্যাসাগর হাসপাতালে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে ভর্তি করা হয়৷ চিকিৎসকরা তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখেন৷ ওখানেই ১৮ জানুয়ারি সকালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে৷

বিকাল  ৪টায়  কেন্দ্রীয়  অফিস  থেকে  শোকমিছিল  করে  আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে প্রয়াত কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তীকে শেষবিদায় জানানো হয়৷ বেহালার সিরিটি শ্মশানঘাটে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়৷ কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তীর মৃত্যুতে দল একজন নিবেদিতপ্রাণ ও অত্যন্ত মূল্যবান বিপ্লবী কর্মীকে হারাল৷

কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তী লাল সেলাম