Breaking News

‘ওয়াশিংটনের কর্তারা নিজেদের সন্তানদের এক অদ্ভুত যুদ্ধে মৃত্যুর মুখে পাঠাতে চাইছে’

মার্কিন জনতার প্রতি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো ৭ ফেব্রুয়ারি এই খোলা চিঠি দেন

আমি শুধু জনগণকেই জানি৷ কারণ আপনাদের মতো আমিও সাধারণ মানুষেরই একজন৷ কারাকাসের এক গরিব এলাকায় আমার জন্ম ও বড় হওয়া৷ দারিদ্র্য ও বৈষম্যে ডুবে থাকা ভেনেজুয়েলায় গণআন্দোলনের আগুনে আমি পোক্ত হয়েছি৷ আমি ধনকুবের নই, হৃদয়ের অন্তঃস্তল থেকে আমি একজন শ্রমিক৷ আজ আমি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে জড়িয়ে সামাজিক সমতার নীতিতে পরিচালিত নতুন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট পদে কাজ করার মহান সুযোগ পেয়েছি, যে নীতি নিয়ে ১৯৯৮ সালে পথ চলা শুরু করেছিলেন সিমন বলিভারের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত কমান্ডান্ট হুগো স্যাভেজ৷

আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি৷ আগামী দিনগুলিতে যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যে কোনও একটিকে আমাদের বেছে নিতে হবে যা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে৷ ঘৃণার যে বীজ ভিয়েতনামে রোপিত হয়েছিল, সেই বীজই আবার সীমান্ত বরাবর আনতে চাইছে আপনাদের দেশের জাতীয় প্রতিনিধি৷ সেইসময় তারা যে অজুহাত তুলেছিল, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রহীনতার ঠিক সেই অজুহাত তুলেই এবার তারা ভেনেজুয়েলায় আগ্রাসন চালিয়ে তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে চাইছে৷ কিন্তু এ সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ৷ ভেনেজুয়েলায় স্বৈরাচারের যে অভিযোগ তারা তুলছে তা ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পাওয়ার অভিযোগের মতোই মিথ্যা৷ কিন্তু এই মিথ্যা অভিযোগের পরিণাম আমাদের গোটা অঞ্চলের ওপর ভয়ঙ্কর হতে পারে৷

ভেনেজুয়েলা হল এমন একটি দেশ যেখানে ১৯৯৯ সালের সংবিধান অনুযায়ী গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটানো হয়েছে, যে গণতন্ত্রের কারিগর ও নায়ক স্বয়ং জনগণ৷ গত ২০ বছরে সবচেয়ে বেশি বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ভেনেজুয়েলায়৷ আমাদের আদর্শ কিংবা আমাদের সমাজের গঠন আপনাদের মনমতো না হতে পারে, কিন্তু আমরা আমাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছি এবং সংখ্যায় আমরা বিপুল৷

 হোয়াইট হাউসের কয়েকটি অংশ ভেনেজুয়েলায় যে আগ্রাসন চালাতে চাইছে যার অভাবনীয় পরিণামের প্রভাব শুধু আমাদের দেশেই নয়, গোটা আমেরিকা অঞ্চলে পড়বে, তার গুরুত্ব অনুধাবন করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনতার প্রতি আমি এই বার্তা প্রচার করছি৷ শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ভেনেজুয়েলার পক্ষ থেকে সিএআরআইসিওএম–এর সমর্থন নিয়ে উরুগুয়ে ও মেক্সিকো আলাপ–আলোচনার যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তা–ও বানচাল করতে চান৷ আমরা জানি, ভেনেজুয়েলার ভালর জন্য আমাদের বসে কথা বলা দরকার, কারণ আলাপ–আলোচনার পথ ছেড়ে দেওয়ার অর্থ বলপ্রয়োগের রাস্তা ধরা৷ জন এফ কেনেডির কথা মনে রাখবেন যিনি বলেছিলেন, ‘‘ভয় পেয়ে যেন আমরা আলোচনা না করি৷ কিন্তু আলোচনাকে যেন আমরা ভয় না করি’’৷ যারা আলাপ–আলোচনা করতে চায় না, তারা কি সত্যকে ভয় পায়?

একদিকে ভেনেজুয়েলার বলিভার মডেলকে রাজনৈতিক কারণে সহ্য করতে না পারা, অন্যদিকে আমাদের বিপুল তৈলসম্পদ, খনিজসম্পদ সহ অন্যান্য মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন একটি আন্তর্জাতিক জোট ভেনেজুয়েলার ওপর সামরিক আক্রমণ চালানোর ভয়ানক পাগলামি করতে চলেছে মানবিক সংকটের অজুহাত তুলে, যে সংকটের কোনও অস্তিত্বই বাস্তবে নেই৷

জঘন্য বাণিজ্যিক ও আর্থিক অবরোধের কারণে ভেনেজুয়েলার মানুষকে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে বিভিন্ন দেশ কর্তৃক আমাদের আর্থিক সম্পদের লুটপাট৷ তা সত্ত্বেও সামাজিক নিরাপত্তার এই নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশগুলিতে সরাসরি নজর দেওয়ার কারণে আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে আমাদের দেশ অর্জন করেছে মানব উন্নয়ন সূচকের উচ্চ মান, কমে গেছে মানুষে মানুষে বৈষম্য৷

আমেরিকার সাধারণ মানুষের অবশ্যই জানা দরকার, রাষ্ট্রসংঘের নীতি, যেখানে বিভিন্ন দেশের মধ্যে শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার লক্ষ্যে অন্যান্য নিয়মের পাশাপাশি শক্তিপ্রয়োগ কিংবা শক্তিপ্রয়োগের হুমকি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাকে সম্পূর্ণ লংঘন করে এই আগ্রাসনের ছক কষা হচ্ছে৷

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্যের যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে আমাদের, তা আমরা বজায় রাখতে চাই৷ অন্যদিকে ভেনেজুয়েলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র অধিকারকে মর্যাদা না দিয়ে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক কর্তারা নিজেদের সন্তানদের এক অদ্ভুত যুদ্ধে মৃত্যুর মুখে পাঠাতে চাইছে৷

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী আপনাদের মতোই আমরা ভেনেজুয়েলার মানুষরাও দেশপ্রেমিক এবং নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে আমরা মাতৃভূমিকে রক্ষা করব৷ আমরা চাই, যে অর্থনৈতিক আগ্রাসন দেশের মানুষকে গলা টিপে মারতে চায় তা বন্ধ হোক এবং ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসনের ভয়ঙ্কর হুমকিও অবিলম্বে বন্ধ হোক–  এই শপথে গোটা ভেনেজুয়েলার মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ৷ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মার্কিন জনসমাজ যা তার নিজের নেতাদের কারণেই আজ বিপদগ্রস্ত, তার কাছে আমাদের আবেদন, আমাদের শান্তির আহ্বানে তাঁরা সাড়া দিন৷ আসুন, যুদ্ধের প্ররোচনা এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমরা এক মানুষের মতো দাঁড়াই৷

মার্কিন জনগণ দীর্ঘজীবী হোক!

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২৭ সংখ্যা)