Breaking News

ঐতিহাসিক স্মারক বেচে পুঁজিপতিদের ঋণ শোধ করছে বিজেপি

জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা সবই তাদের লোকদেখানো৷ আসল আরাধ্য পুঁজি৷ পুঁজিপতি শ্রেণির সেবায় কোনও রাখঢাকই রাখতে রাজি নয় বিজেপি সরকার৷ তাই দেশের অন্যতম ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্মারক লালকেল্লাও তারা তুলে দিল এক সিমেন্ট কোম্পানি ‘ডালমিয়া ভারত’–এর হাতে৷ যেন বালি সিমেন্ট স্টোনচিপ আর লালকেল্লায় ফারাক উনিশ আর বিশ৷ এই লালকেল্লা থেকেই ১৮৫৭–র মহাবিদ্রোহের ডাক দেওয়া হয়েছিল৷ এখানেই নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারপর্ব চলেছিল৷ এই লালকেল্লা থেকেই প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে ভাষণ দেন দেশের প্রধানমন্ত্রী৷ সেই লালকেল্লার গায়ে এবার কর্পোরেট সংস্থার সাইনবোর্ড ঝুলবে৷ একে একে তাজমহল, কোণার্কের সূর্য মন্দির, অজন্তা গুহা, চার মিনার প্রভৃতি ১০০টি ঐতিহ্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক সৌধকে এই ভাবে বেসরকারি সংস্থাকে ‘দত্তক’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার৷

লালকেল্লার ‘রক্ষণাবেক্ষণ’, টিকিটের হার ঠিক করা, দর্শনার্থীদের পরিষেবা দেওয়া প্রভৃতি প্রায় সব কাজই এখন থেকে করবে ডালমিয়া গোষ্ঠী৷ বদলে লালকেল্লা সংক্রান্ত সব প্রচারপত্রে তাঁদের নাম থাকবে৷ সেখানে আয়োজিত মার্কেটিং বিজনেস, বাণিজ্যিক ইভেন্টে তাদের সংস্থার নাম উল্লেখিত থাকবে৷ এমনকী লালকেল্লা  ডালমিয়া ভারত গোষ্ঠী গ্রহণ করেছে এই বোর্ডও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় লাগানোর অনুমতি তাদের দেওয়া হয়েছে৷ বেচে দেওয়া তবে আর কাকে বলে!

ঐতিহাসিক সৌধ রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া৷ তারা কি এই দায়িত্ব পালন করতে পারছিল না? ডালমিয়া গোষ্ঠী কি তাদের থেকে এই দায়িত্ব ভালভাবে পালন করবে? বাস্তবে এই ধরনের কাজে ডালমিয়া গোষ্ঠীর কোনও অভিজ্ঞতাই নেই৷ তবুও তাদের এই দায়িত্ব দেওয়া হল৷ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেস আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, লালকেল্লার ভিতরে বিভিন্ন নির্মাণ সম্পর্কে অসত্য অথবা প্রমাণিত নয় এমন বিভিন্ন ব্যাখ্যা তথ্য হিসাবে পেশ করা হতে পারে পর্যটকদের কাছে, যা আসলে ইতিহাসের বিকৃতি৷ বিরোধী দলগুলি এখন তাদের দায় এড়াতে ব্যস্ত৷ অথচ অভিযোগ উঠেছে, ৩১ জন সাংসদের যে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি মোদি সরকারের প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল, তার মাথায় ছিলেন তৃণমূল নেতা ডেরেক ও ব্রায়েন৷ এখন চাপে পড়ে ব্রায়েনদের দাবি, তাঁরা যতখানি বলেছিলেন, বিজেপি সরকার নাকি তার থেকে বেশি করেছে৷ কার মাত্রাজ্ঞান কতখানি তা তাঁরা নিজেরাই বিচার করুন৷ কিন্তু দেশের মানুষ দেখল, বিনা বিরোধিতায় এমন একটি জাতীয় স্মারককে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ বিজেপি সরকার করে ফেলতে পারল৷ এর আগে ইউপিএ সরকার পাঁচটি সৌধ বেসরকারি হাতে তুলে দিয়েছিল৷ শুধু জাতীয় সৌধ কেন, জাতীয় তথা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ কি কংগ্রেস আমলেই অবাধে শুরু হয়ে যায়নি? শোনা যায়, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে জাতির মন্দির বলে অভিহিত করেছিলেন৷ পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের মন্ত্রীরা কি সেই মন্দিরগুলিই অবাধে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেননি? পুঁজিপতিদের সন্তুষ্ট করতে ব্যগ্রতা কারও কম কিছু নয়৷

আপাতত যে একশোটি স্মারক ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলি শুধু ইট–কাঠ–পাথরের স্তূপ নয়, সেগুলি ভারত ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়৷ সেগুলির বিকৃতির অর্থ, ইতিহাসের বিকৃতি৷ এ দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের সাক্ষী এই স্মৃতিসৌধগুলি৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা না জানলে স্বদেশ–সভ্যতা থেকে ছিন্নমূল হয়ে পড়বে৷ উন্নততর সমাজ গড়ে তোলার অভিমুখ হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়বে৷ দেশের শাসক শ্রেণি তাদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে সেটাই চায়৷ এই ‘দত্তকে’র সিদ্ধান্ত সেই লক্ষ্যে এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র৷

বিজেপি এমন একটি দল স্বদেশ সাধনায় যাদের কোনও ঐতিহ্য নেই৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে দলটির নেতাদের কোনও ভূমিকা নেই৷ বিজেপির পূর্বসূরি বলে পরিচিত দলগুলির ভূমিকা জাতীয়তা বিরোধী৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতাই করেছিল হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ, আরএসএস৷ স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি নেতাদের ইতিহাস চেতনা রয়েছে এমন অতিরিক্ত আশা দেশের মানুষ করে না৷ তাঁদের কাছে ঐতিহাসিক সৌধগুলি নিয়ে আবেগ আশা করাও বৃথা৷ কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ তো সত্যিই দেশকে ভালবাসেন, তাঁদের তো ঐতিহাসিক স্মারকগুলি নিয়ে আবেগ রয়েছে৷ তাঁরা তো বিজেপি নেতাদের মতো ছিন্নমূল নন৷ নির্বাচনে খরচের হাজার হাজার কোটি টাকা, দল চালানোর দেদার খরচ বিজেপি নেতারা পুঁজিপতিদের থেকে নিতে পারেন, সাধারণ মানুষ তো তা নয়৷ বরং পুঁজিপতিরাই সাধারণ মানুষের উপর অবাধে শোষণ লুণ্ঠন চালাচ্ছে৷ ফলে পুঁজিপতিদের কাছে বিজেপি নেতাদের ‘ঋণ’ শোধ করার দায় থাকতে পারে, সাধারণ মানুষের সেই দায় নেই৷ বিজেপি নেতারা সেই ঋণ শোধ করবেন দেশের ঐতিহাসিক স্মারকগুলি বেচে, এটা দেশের মানুষ কিছুতেই মানবে না৷

(৭০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা ১৮ মে, ২০১৮)