এ আই কে কে এম এস–এর আহ্বানে হরিয়ানাতেও কৃষকরা আন্দোলনে

১৩ মার্চ৷ দৃপ্ত স্লোগানে সচকিত চণ্ডীগড়ের রাজপথ৷ হাজার হাজার দৃঢ় পায়ে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন বিধানসভা ভবনের দিকে৷ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, জলে ভিজে ফসল ফলান তাঁরা৷ নিতান্ত উন্নাসিক শহরও তাঁদের ধুলোমাখা চেহারা, ঘর্মাক্ত দেহকে উপেক্ষা করতে পারছিল না৷ হরিয়ানার প্রান্ত–প্রত্যন্ত থেকে বাসে, ট্রেনে, ট্র্যাক্টরে চেপে অথবা পায়ে হেঁটে কয়েক হাজার কৃষক সমবেত হয়েছিলেন বধির সরকারের কানে সোচ্চার স্লোগানে নিজেদের দাবিকে পৌঁছে দিতে৷

অল ইন্ডিয়া কিষান খেতমজদুর সংগঠন (এআইকেকেএমএস) ডাক দিয়েছিল হরিয়ানা বিধানসভা অভিযানের৷ দিল্লির একেবারে লাগোয়া রাজ্য হরিয়ানার ৮০ শতাংশের বেশি কৃষক ঋণের ভারে জর্জরিত৷ কৃষকরা দাবি তুললেন সমস্ত কৃষিঋণ মকুব করতে হবে৷ হরিয়ানার বিজেপি সরকার কেন্দ্রের বিজেপির পথেই ক্ষুদ্র–প্রান্তিক চাষি, মাঝারি চাষি এবং খেতমজুরদের চূড়ান্ত বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে বহুজাতিক মাল্টিন্যাশনাল পুঁজির স্বার্থবাহী নীতি নিয়ে চলছে৷ চাষিরা যখন ফসল বিক্রি করছে, তখন দাম নেই৷ অথচ খুচরো বাজারে তার বিপুল দাম৷ গুরগাঁও, চণ্ডীগড়, রোহতকের শপিং মলে বহুজাতিক কোম্পানির ছাপ মারা শাক সব্জি, ফল থেকে চাল, ডাল, আটা বিক্রি হচ্ছে আকাশছোঁয়া দরে৷ চাষিরা দাবি তুলেছেন সরকারকে সরাসরি চাষির থেকে ফসল কেনার ব্যবস্থা করতে হবে৷ ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিতে হবে উৎপাদন খরচের থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বেশি৷ ২০০৬ সালে এই সুপারিশই করেছিল স্বামীনাথন কমিটি৷ ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী ইস্তাহারে বিজেপি বলেছিল এই সুপারিশ তারা মানবে৷ এখন কোথায় সহায়ক মূল্য এআইকেকেএমএসের সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড সত্যবান কৃষকদের সামনে যখন এ কথা তুলে ধরেছেন, থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া অফিসযাত্রী, ছাত্রছাত্রী, মহিলারা সমর্থনে হাততালি দিয়ে উঠেছেন৷ শহরের খেটে খাওয়া, মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থ যে কৃষকদের এই দাবির থেকে আলাদা নয়, তা বুঝেছেন তাঁরা৷

প্রায় প্রতিদিন বাড়ছে সার–বীজ–কীটনাশকে দাম৷ বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির হাতে এই ব্যবসা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে সরকার৷ অথচ তারা চাষিদের ঠকাচ্ছে মারাত্মকভাবে৷ এ বছরই সারা দেশে মনস্যান্টো, কারগিল প্রভৃতি কোম্পানির তুলো, সরষে, ধান, গম ইত্যাদি বীজের প্রায় অর্ধেক অঙ্কুরিতই হয়নি৷ অথচ এই বন্ধ্যা বীজের কারবারি কোম্পানিগুলির পাশেই দাঁড়িয়েছে বিজেপি সরকার৷ তাদের রয়্যালটির দাবি সরকার মেনে নিয়েছে৷ ডিজেলের দাম প্রায় প্রতিদিন বাড়ার ফলে বেড়েছে ট্র্যাক্টর এবং সেচের পাম্প চালানোর খরচ৷ অধিকাংশ রাজ্যে বেড়েছে কৃষি–বিদ্যুতের দাম৷ সরকারি সেচ প্রকল্পের অধিকাংশই অকেজো হওয়ায় চাষিকে গাঁটের কড়ি খরচ করে সেচের বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে দরকার ছিল সহায়ক মূল্যে সরকারি উদ্যোগে ফসল কিনে নেওয়া৷ বর্তমান অবস্থায় এটাই চাষিকে রক্ষা করার অত্যন্ত জরুরি পথ৷ কিন্তু কী কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, কী অন্য রাজ্যের নানা দলীয় সরকার, কেউই এই পথে হাঁটেনি৷

হরিয়ানার বিজেপি সরকার সহায়ক মূল্য দেওয়ার বদলে কৃষকদের প্রতারণার পথ নিয়েছে৷ তারা চালু করেছে ‘ভাবান্তর ভরপাই যোজনা’৷ যার মাধ্যমে কৃষকদের ফসল বিক্রির পুরো ব্যবস্থাটা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ফড়ে মহাজন এবং বহুজাতিক ফুড–চেনের এজেন্টদের হাতে৷ এই যোজনায় খরিফ মরশুমের টমেটো, পেঁয়াজ, আলু আর ফুলকপির বেস প্রাইস বা ন্যূনতম দাম সরকার বলে দিচ্ছে৷ কৃষক তার থেকে কমে এই কয়টি ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হলে দামের পার্থক্যটুকু কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নাকি জমা করে দেবে সরকার৷ রবি মরশুমে হয়ত আরও কয়েকটি ফসল সরকার এই যোজনার আওতায় আনবে৷ কিন্তু এই সুবিধা পেতে গেলে চাষিকে অনলাইনে আগাম রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে৷ ক্ষুদ্র চাষি, ভূমিহীন ভাগচাষির পক্ষে যা কার্র্যত অসম্ভব৷ ফসল বিক্রির জন্য কৃষককে নির্ভর করতে হবে বড় বড় ব্যবসায়ী, বহুজাতিক কেম্পানির উপরেই৷ সরকারের কোনও দায় থাকছে না৷ শুধু তাই নয়, হাস্যকর ন্যূনতম দাম ঠিক করেছে মনোহরলাল খট্টরের সরকার৷ যে টমেটো এই পড়তি বাজারেও কিলোপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকার নিচে নামেনি তার সরকারি ন্যূনতম দাম ৪ টাকা প্রতি কিলো৷ পেঁয়াজের সরকারি দর ৫ টাকা, অথচ পেঁয়াজ সারা দেশে এই বছর বেশিরভাগ সময় ৩০ টাকা কিলোর উপরেই বিক্রি হয়েছে৷ তবে চাষি যে এইটুকু দরও পাননি তা প্রমাণ হবে কী করে? ফড়ে, মহাজন কিংবা শপিংমল যদি চাষির কাছ থেকে রসিদ দিয়ে বা চেকে ফসল না কিনে থাকে, তা প্রমাণের কোনও উপায় চাষির নেই৷ স্বাভাবিকভাবেই বৃহৎ ব্যবসায়ীরা নিজেদের লুঠের প্রমাণ রাখবে না, মরবে চাষি৷ মরছেও দলে দলে৷ আর বাকি ফসলগুলির দাম কী হবে? হরিয়ানা সরকার যেমন নীরব তেমনই নীরব কেন্দ্রের সরকার৷ একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালে খরিফ মরশুমে ধানের ক্ষেত্রে চাষি পেয়েছে উৎপাদন খরচের উপর সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ, ভুট্টায় উৎপাদন খরচের থেকে ১৩ শতাংশ কম, অড়হর ডালে ২৫ শতাংশ কম, বাদামে ক্ষতি প্রায় ৫ শতাংশ, তুলোয় উৎপাদন খরচের থেকে গড়ে ০.১ শতাংশ কম পেয়েছে চাষি৷ (ফ্রম প্লেট টু প্লাউ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২ জানুয়ারি ২০১৮)৷ চাষিকে সর্বস্বান্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে সরকার কী করেছে? তার উত্তর দিতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে আন্দোলনের মাধ্যমেই৷ বলে গেল এই কৃষক সমাবেশ৷

এআইকেকেএমএসের নেতৃত্বে চাষিরা দাবি তুলেছেন, কৃষি শ্রমিকদের সারা বছর দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরিতে কাজের গ্যারান্টি সরকারকে দিতে হবে৷ বৃদ্ধ কৃষকদের দিতে হবে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা মাসিক পেনশন৷

হরিয়ানা সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে কৃষকরা আরও এক গভীর সংকটে পড়েছেন৷ গো–রক্ষার নামে আরএসএস–বিজেপি যে তাণ্ডব এই সমস্ত রাজ্যগুলিতে চালিয়েছে, তার ফলে কৃষকরা তাঁদের অপ্রয়োজনীয় গরু মোষ বিক্রি করতে পারছেন না৷ গো–হাটা প্রায় বন্ধ৷ ফলে এই গরু–মোষগুলিকে খাওয়াতে গিয়ে একদিকে সংসারের ভাঁড়ার শূন্য হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় গবাদিপশু কেনা সম্ভব হচ্ছে না৷

প্রধানমন্ত্রী কৃষকের স্বার্থে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চার বছর আগে ক্ষমতায় বসেছিলেন৷ তাঁর সরকারের মেয়াদ ২০১৯ সালে শেষ৷ অথচ এখন তিনি ২০২২ সালে গিয়ে কৃষকের আয় বাড়াবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন৷ এতদিন কী কৃষকরা পেটে কিল মেরে বসে থাকবেন, হা–হুতাশ করবেন পরিবারের সকলে অনাহার–অর্ধাহারে ধুঁকতে ধুঁকতে মরবেন আত্মহত্যা করে জ্বালা মেটাবেন ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ২০ হাজার কোটি টাকা খরচে ৯৯টা বড় সেচ প্রকল্প চালু হবে, তাতে কৃষকের খরচ কমবে৷ এক বছরে ১০টাও পুরো হয়নি৷ বাজেটে প্রতিশ্রুত টাকার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র বরাদ্দ করেছে সরকার৷ ডেয়ারি, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পে বরাদ্দের বেশিরভাগটাই সরকার অন্য খাতে সরিয়ে নিয়েছে৷ (সূত্র : ওই)

১৩ মার্চ এআইকেকেএমএসের সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড সত্যবান, হরিয়ানা রাজ্য সভাপতি কমরেড অনুপ সিংহ মাতনহেল, রাজ্য সম্পাদক কমরেড জয়কিরণ মান্দাউতি প্রমুখের নেতৃত্বে বিশাল এই মিছিল চণ্ডীগড়ের সেক্টর ফাইভের ধরনাস্থল থেকে বিধানসভা অভিমুখে এগিয়ে যায়৷ বিধানসভার কাছে বিশাল পুলিশবাহিনী মিছিলের গতিরোধ করে৷ মিছিলের সংগ্রামী মনোভাব দেখে পুলিশ বাধ্য হয় প্রতিনিধি দলকে বিধানসভা ভবনে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার সুযোগ করে দিতে৷ নেতৃবৃন্দ বিক্ষোভ সভায় বলেন,  যুগ যুগ ধরে কৃষকরা শোষিত হচ্ছে৷ বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজি মালিকের শোষণ ও সরকারের কৃষক স্বার্থবিরোধী নীতির সাঁড়াশি চাপে কৃষক বিপন্ন৷ প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করছে৷ এদের সম্মিলিত শোষণের বিরুদ্ধে কৃষককে লড়তে হবে৷ পাল্টাতে হবে শোষণ ব্যবস্থা৷ যারা ভোটের দিকে তাকিয়ে আন্দোলনের মহড়া দেয়, চাষিদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী কে, তা চেনায় না, তারা আন্দোলনকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে না৷