এসইউসিআই(সি) বাম ঐক্য চায় সংকীর্ণ নির্বাচনী স্বার্থে নয়, গণআন্দোলনের প্রয়োজনে

মার্কসিস্ট কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (ইউনাইটেড)–এর কেন্দ্রীয় কমিটি কেরালার এর্নাকুলামে তাদের চতুর্থ পার্টি কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে উপস্থিত থাকার জন্য এসইউসিআই(সি)–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষকে অনুরোধ করেছিল৷ তাতে সাড়া দিয়ে কমরেড প্রভাস ঘোষ দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড কে রাধাকৃষ্ণকে প্রতিনিধি হিসাবে পাঠান৷ ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য অধিবেশনে তিনি বক্তব্য রাখেন৷ ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিআই(এমএল) রেড ফ্ল্যাগ, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, আরএমপি ইত্যাদি দলের নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন৷

কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ বলেন, এস ইউ সি আই (সি)–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের পক্ষ থেকে আমি এম সি পি আই (ইউ)–এর পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত হয়েছি৷ আপনাদের কংগ্রেস ও সমস্ত প্রতিনিধিদের উদ্দেশে তাঁর আন্তরিক অভিনন্দন আমি বহন করে এনেছি৷ আমি আশা করি, আমাদের সাধারণ শত্রু পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাম ও গণতান্ত্রিক দল এবং শক্তিসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে এই কংগ্রেস আরও জোরদার করবে৷ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী–সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্ব জুড়ে কী ধরনের দস্যুবৃত্তি চালাচ্ছে, সে বিষয়ে আমরা বামপন্থীরা সচেতন৷ দুনিয়ার মেহনতি মানুষের উপর তারা সীমাহীন শোষণ–পীড়ন করে চলেছে৷ সাম্প্রতিক অতীতে তারা ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, লিবিয়ার মতো বহু দেশে হানাদারি চালিয়ে নিজেদের কব্জায় এনেছে৷ এখন ভেনেজুয়েলার দিকে তাদের শ্যেন দৃষ্টি৷ এই অবস্থাতেও পুঁজিবাদী শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকায় একের পর এক আন্দোলন গড়ে উঠছে, কিন্তু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সেগুলি সফল হতে পারছে না৷

ভারতেও শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির অনুসৃত নীতির দৌলতে বিশেষ করে উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে হাতে গোনা কিছু একচেটিয়া পুঁজিপতি বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছে, পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে–খাওয়া মানুষ সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন৷ বেকারত্বের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷ আমরা বামপন্থী শক্তিগুলি ঐক্যবদ্ধ নই বলে প্রতিবাদ আন্দোলন দুর্বল৷ তাই সহজেই এ সব ঘটতে পারছে৷ মেহনতি  মানুষের মহান শিক্ষক কমরেড লেনিন এ বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশ করে বলেছেন, নিজেদের মধ্যে যতই মতবিরোধ থাকুক, সর্বসম্মত ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত৷ তিনি আরও বলেছেন, সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি বামপন্থীদের উচিত নিজেদের মতপার্থক্যের বিষয়গুলিকে সর্বসমক্ষে আলোচনার জন্য তুলে ধরা৷ যাতে শুধু শ্রমজীবী মানুষই নয়, বামপন্থী দলের কর্মীরাও এ থেকে শিক্ষা নিতে ও সচেতন হতে পারেন৷ ঐক্য–সংগ্রাম–ঐক্যের নীতি এবং আচরণবিধির ভিত্তিতে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালিত হওয়া উচিত৷ এই পদ্ধতির মধ্য দিয়েই সঠিক রাজনৈতিক লাইন বেরিয়ে আসবে এবং জয়যুক্ত হবে৷

১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকে পশ্চিমবঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সময়ের কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে কমরেড রাধাকৃষ্ণ বলেন, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির জনবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয়েছিল, এসইউসিআই(সি) তার শরিক ছিল৷ বিভিন্ন রাজ্যে তখন জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে আন্দোলন (‘জে পি মুভমেন্ট’) শুরু হলে সর্বত্রই আমরা সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম৷ সেই আন্দোলনে সিপিএম–সিপিআইকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে জয়প্রকাশজি বারংবার অনুরোধ জানালেও তারা সামিল হয়নি৷ এই আন্দোলনে, আরএসএস এবং জনসংঘ আছে –এই অজুহাত দেখিয়ে সিপিএম ও সিপিআই তাতে যোগ দেয়নি৷ আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে, যথার্থ অর্থেই এটি একটি গণআন্দোলন৷ এই আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে বিভিন্ন শক্তি তাদের রাজনৈতিক লাইন অনুযায়ী ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ এই সময়ে একটি যথার্থ বিপ্লবী পার্টির কর্তব্য হল, এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং তার মধ্য দিয়ে আন্দোলনেবিপ্লবী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা৷ এই পথে বিপ্লবী আন্দোলন শক্তিশালী হয়৷ কিন্তু সিপিএম ও সিপিআই লেনিনের এই শিক্ষা নিয়ে আন্দোলনে এল না এহং দূরে থাকল৷

পরে সিপিএম–সিপিআই ও সহযোগী বামপন্থীরা যখন আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল, আমাদের দল এসইউসিআই(সি) তখন বলল, এই পশ্চিমবঙ্গ বামপন্থী আন্দোলনের ঘাঁটি৷ এখানে বামপন্থীরা নিজেরাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারে৷ অন্য কারও প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু সিপিএম আমাদের এই বক্তব্যকে নস্যাৎ করে পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনকে আহ্বান জানায় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য৷ প্রফুল্ল সেন ছিলেন জনগণের চোখে অত্যন্ত ধিক্কৃত৷ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তিনি গণআন্দোলনের উপর গুলি চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করেছিলেন৷ এইরকম একজন ব্যক্তি আন্দোলনের নেতা হিসাবে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ এই নিয়ে আমরা প্রকাশ্যে সিপিএমের সমালোচনা করি৷ আমরা চেয়েছিলাম, এ হেন একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মহান লেনিনের শিক্ষার ভিত্তিতে প্রকাশ্যে সুস্থ তর্কবিতর্ক হোক এবং সত্য সামনে আসুক৷ কিন্তু আমাদের সমালোচনায় আপত্তি জানিয়ে সিপিএম বলেছিল, যুক্ত আন্দোলনে  প্রকাশ্যে সমালোচনা চলবে না৷ সেই থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনগুলিতে তারা আমাদের দলের সঙ্গে ঐক্য চায় না৷

আজ এস ইউ সি আই (সি) বাম–গণতান্ত্রিক দলগুলির কাছে আহ্বান জানাচ্ছে, একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির শোষণ এবং কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় দলের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ যুক্ত আন্দোলন গড়ে তোলার৷ এই সময় যে কোনও মূল্যে সংসদে কিছু আসন বাগিয়ে নেওয়ার জন্য বিজেপির ফ্যাসিবাদী নীতির হাত থেকে বাঁচার ধুয়ো তুলে সিপিএম–সিপিআই কংগ্রেসের সঙ্গে রফা করতে ব্যস্ত৷

অথচ বিজেপির বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রাম গড়ে তুলতে এবং বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলায় তাদের এতটুকু আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না৷ নির্বাচনে সুবিধা পাওয়াই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য৷ এ কথা বলে কমরেড রাধাকৃষ্ণ তাঁর বক্তব্য শেষ করেন৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩২ সংখ্যা)