এক বছরে ৫১ হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ

মাত্র এক বছরের মধ্যে গোটা দেশে ৫১ হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এ হিসাব শুধুমাত্র ২০১৮-২০১৯ এর। অতিমারি পরবর্তী পরিসংখ্যান যুক্ত হলে গত দু’ বছরে সরকারি স্কুলশিক্ষার ছবিটা যে আরও ভয়াবহ হয়ে ধরা দেবে, তা উঠে এসেছে বহু সমীক্ষায়।

এই বিপুল সংখ্যক সরকারি স্কুল উঠে গেল কেন? খতিয়ে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে সরকারি নীতিই সরকারি স্কুল উঠে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ১৯৮৬ সালে কংগ্রেসের রাজীব গান্ধী প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের রাস্তা প্রশস্ত করে। এরপর বিজেপি শিক্ষাকে পুরোপুরি বেচাকেনার পণ্যে পরিণত করছে। ২০০৯-এ বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে কেন্দ্র এনেছিল শিক্ষার অধিকার আইন। আজ সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশাই বলে দেয়, এই আইন আদতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার ব্লু-প্রিন্ট। শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতের বিষয়টাই দেখা যাক। এই আইন অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরে প্রতি ৩০ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক এবং উচ্চ-প্রাথমিক স্তরে প্রতি ৩৫ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক থাকার কথা। এখন, কোনও প্রাথমিক স্কুলে যদি পাঁচটি শ্রেণি মিলিয়ে মোট ছাত্রসংখ্যা হয় ৬৯, আইন মেনে বড়জোর দু’জন শিক্ষক তারা পেতে পারেন। দুজনেই সামলাবেন পাঁচটি ক্লাস। একইভাবে উচ্চ-প্রাথমিক স্তরেও শিক্ষক সংখ্যা ঠিক হবে ওই ছাত্রসংখ্যার নিরিখেই, প্রয়োজন ভিত্তিতে নয়। যেখানে প্রতিটি বিষয়ের জন্য একজন হিসাবে অন্তত পাঁচজন শিক্ষকের দরকার হয়, সেখানে যদি ছাত্রসংখ্যার অনুপাতে মাত্র তিনজন শিক্ষক বরাদ্দ হয়, তা নিয়েই খুশি থাকতে হবে ওই স্কুলকে।

যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং পরিসংখ্যান বলছে, আইন অনুযায়ী এই ন্যূনতম সংখ্যক শিক্ষকও নেই বেশিরভাগ রাজ্যে। শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে পশ্চিমবঙ্গ সহ বহু রাজ্যের সরকারি স্কুল। ২০১৭-য় নীতি আয়োগ প্রয়োজনে একাধিক স্কুল মিলিয়ে দেওয়ার অনুমোদন দেয়। সেই মোতাবেক উত্তরপ্রদেশ সরকার ২৬ হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ করেছে। মধ্যপ্রদেশে ২২ হাজার, ওড়িশায় ৫ হাজার, দু’একটি রাজ্য বাদে সর্বত্রই কিছু না কিছু সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে।

এ সব নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা অভিভাবকদের ওপর দোষ চাপিয়ে বলেন, মা-বাবারা সন্তানদের সরকারি স্কুলে পাঠায় না, ফলে বাধ্য হয়ে দু-তিনটে স্কুল মিলিয়ে দিতে হচ্ছে। অথচ, অভিভাবকেরা কেন সন্তানদের সরকারি স্কুলে পাঠান না, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও সাধ্যাতিরিক্ত খরচ করে সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পাঠাতে চায় কেন, এই প্রশ্নগুলো তাঁরা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। সাধারণ মানুষ দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জানেন, বেশিরভাগ সরকারি স্কুলেই লেখাপড়ার ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই। সিলেবাস এবং পাঠ্যপুস্তক নিম্নমানের। এই অবস্থায় সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে, চাকরি পাওয়ার ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো শিক্ষাটুকু দেবার আশায় অভিভাবকরা সন্তানকে কষ্ট করে হলেও বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করতে চান। এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সরকারের সৌজন্যেই। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের কথায়, সরকারি স্কুল খোলা বা বন্ধ রাখা রাজ্য সরকারের বিষয়, কারণ শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত। আর রাজ্য সরকার বলছে, কেন্দ্রের নীতি মেনেই আমাদের স্কুল বন্ধ করতে হচ্ছে। শিক্ষাখাতে অর্থবরাদ্দ কমিয়ে, বছরের পর বছর শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রেখে, অল্প সংখ্যক শিক্ষকের ওপর বিপুল সিলেবাসের বোঝা চাপিয়ে, শিক্ষকদের উপর শিক্ষা বহির্ভূত সরকারি নানা দায়িত্ব চাপিয়ে সরকারি স্কুলের পড়াশুনার পরিবেশকে নষ্ট করে দেওয়ার প্রধান হোতাই সরকার। তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ সালে সরকারি স্কুল ৫ শতাংশ কমলেও, খুলেছে ১১ হাজারেরও বেশি বেসরকারি স্কুল।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্নের সাথে জড়িয়ে ছিল যে সার্বজনীন, বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শিক্ষার স্বপ্ন, তাকে দু’ পায়ে মাড়িয়ে স্বাধীন ভারতের একের পর এক সরকার দেশের মানুষের শিক্ষার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে। উদ্দেশ্য, সম্পূর্ণ শিক্ষাক্ষেত্রকে বেসরকারি মালিকদের মুনাফা লোটার জন্য তুলে দেওয়া। যে কোনও মৌলিক অধিকারের মতোই শিক্ষার সুযোগও জনগণকে লড়ে আদায় করতে হবে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি বাঁচাতে হয়, ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই একমাত্র পথ।