একমত নই

গণদাবীর ৮–১৪ ফেব্রুয়ারি’১৯ সংখ্যায় ‘পাশ–ফেল’ তুলে দিয়ে শিক্ষার কী হাল হয়েছে’ প্রতিবেদনটি প্রকাশের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি৷

অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন এডুকেশন ’১৮–এর বিস্তারিত আলোচনা করে শিক্ষার কী বেহাল অবস্থা হয়েছে তা স্পষ্ট করে দেখানো খুবই চিত্তাকর্ষক হয়েছে৷ তবুও শিক্ষার বেহাল অবস্থার জন্য পাশ–ফেল নিয়মের অবলুপ্তিই দায়ী এবং এই নিয়ম পুনর্বহাল করলে শিক্ষার বেহাল অবস্থা দূর হবে, আপনাদের এই মতের সাথে আমি একমত নই৷ আমি আরও মনে করি পাশ–ফেল চালু করলে বাস্তবে অন্য সমস্যার সৃষ্টি হবে এবং শিক্ষার অবনতি ঘটবে৷ আমার ধারণার পিছনে যে চিন্তা আছে সেটা আপনাদের বিবেচনার জন্য জানাচ্ছি৷

এই ধারণা বোধ করি অযৌক্তিক নয় যে, দু’টি কারণে একটি শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না হতে পারে৷ প্রথমটি, শিক্ষার্থীটি অলস এবং সে পড়াশুনায় যথেষ্ট মনোযোগ না দিলে৷ অপরটি হল যদি সে মেধাহীন হয়৷

কোনও বিষয় শেখার মধ্যে দুটো দিক আছে– এক, মুখস্থ করা এবং মনে রাখা, আর অপরটি শিক্ষণীয় বিষয়ের পিছনে যে যুক্তির পরম্পরা ও চিন্তাভাবনা আছে সেগুলি উপলব্ধি করা এবং ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন করা৷ একই শ্রেণিতে দু’বছর আটকে রেখে আশা করা যায় মুখস্ত করার বিষয়গুলিতে– যেমন নামতা মুখস্ত করা– কিছুটা উন্নতি করা যাবে৷ কিন্তু খুব সহজ অঙ্কও, যেমন যোগ–বিয়োগ, গুণ–ভাগ, শুধু বইতে যা লেখা আছে তা পড়ে কয়েকটি মেধাবী শিক্ষার্থী ছাড়া, অন্যদের সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বোঝার আশা দুরাশা৷

এখানে শিক্ষক–শিক্ষিকাদের একটি ভূমিকা আছে– শিক্ষার্থীদের মনে যত প্রশ্ন উঠবে সেগুলি জেনে নিয়ে তাদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর বুঝিয়ে দেওয়া এবং তারা যা শিখল তা মনে রাখতে ও ব্যবহার করতে পারছে কি না তা যাচাই করে যতক্ষণ না নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ বোঝাবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া৷

অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমীক্ষায় দেখা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির ৭০ শতাংশ পড়ুয়া প্রথম শ্রেণির সহজ অঙ্ক করতে পারে না৷ পাশ–ফেল নিয়ম চালু হলে, এই ৭০ শতাংশ পড়ুয়াদের মধ্যে, ধরা যাক, ৩৫ শতাংশ (বা ২০ থেকে ৫০ যে কোনও সংখ্যা) প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবার পরীক্ষায় ফেল করত৷ দু’টি কারণে এ রকম হতে পারে৷ প্রথম সম্ভাব্য কারণটি, ভর্তির শ্রেণিতে অর্থাৎ প্রথম শ্রেণিতে প্রস্তুতিহীন, অনুপযুক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা৷ অপরটি, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মান শিক্ষাদানের ন্যূনতম শর্তও পালন করে না৷

প্রথম সম্ভাব্য কারণটির একটি সহজ সমাধান হল ভর্তি হওয়ার পরীক্ষা আরও কঠিন করে প্রস্তুতিহীন, অনুপযুক্ত আবেদনকারীদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া বন্ধ করা৷ এই সমাধান পাশ–ফেল নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ৷ অবশ্য তখন তাদের যোগ্য হওয়ার জন্য মন্টেসারি–কিন্ডারগার্ডেন–প্রাইভেট টিউশন–এর উপরই নির্ভর করতে হবে যার ফলশ্রুতি বোধ করি সর্বসাধারণের শিক্ষার অবাঞ্ছিত বেসরকারিকরণ৷

পাশ–ফেল নিয়ম আরও একটি সমস্যা সৃষ্টি করবে– সেটি হল অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আরও এক বছর একই শ্রেণিতে থাকার জন্য স্থানাভাবে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগের হ্রাস৷ এর ফলে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা ৩০ শতাংশ বা তার বেশি, কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে৷ এই পরিস্থিতিতে নতুন শিক্ষায়তন স্থাপন করে শ্রেণি সংখ্যা না বাড়াতে পারলে শিক্ষার মানে অবনতি অনিবার্য৷

শিক্ষার মানের উন্নতি করার প্রধানতম শর্ত শিক্ষক–শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানো৷ বর্তমানে আমাদের দেশে এই অনুপাত বোধ করি ৫০ থেকে ১০০ বা তার বেশি, যেখানে উন্নত দেশে ওটি সাধারণত ২৫, ৩০–এর বেশি কখনও নয়৷ শিক্ষার মানের উন্নতির জন্য যে একান্ত প্রয়োজনীয় পদ্ধতির কথা আগে বলেছি তার পুনরুক্তি করছি– ‘তাদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর বুঝিয়ে দেওয়া এবং তারা যা শিখল তা মনে রাখতে ও ব্যবহার করতে পারছে কি না তা যাচাই করা যতক্ষণ না নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ বোঝাবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া’৷ এটি তখনই করা সম্ভব, যখন শিক্ষক–শিক্ষিকাদের একটি শ্রেণিতে এক সাথে ৩০–এর বেশি শিক্ষার্থীদের দিকে নজর না দিতে হয়৷ এর জন্য দরকার নতুন শিক্ষালয় গড়ে শ্রেণির সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় আরও অন্তত বাড়িয়ে তিন গুণ করা৷

এই সহজ সত্যটি সম্বন্ধে সারা দেশ– সরকার, রাজনৈতিক দল এবং প্রায় সকলে নীরব৷ এর প্রধান কারণ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় শিক্ষা বা স্বাস্থ্য কোনওটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় না৷ ২০১৯–২০২০ সালের বাজেট বরাদ্দে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ৩.৩৭ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ২.২৮ শতাংশ৷ এটি অপ্রতুল, কিন্তু প্রতিরক্ষার জন্য ১০.৯৭ শতাংশ বরাদ্দ কামনোর প্রস্তাবনা দেশদ্রোহিতা৷ এই অত্যাবশ্যক বিষয়ে যাদের আমরা মিডিয়া বলি তাদের আর রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা খুবই হতাশাজনক৷ তারা কেউই জন্মনিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের উন্নতির মতো অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে সোচ্চার হন না বা আন্দোলন করেন না– যাহা আমার সারকুলেশন বাড়াইবে না, জনসাধারণের মধ্যে আত্মপ্রচারের সুযোগ সৃষ্টি করিবে না বা ভোটের ঢল নামাইবে না, তাহা লইয়া আমি কী করিব?

রবীন্দ্রনারায়ণ কুণ্ডু

কলকাতা–৯

গণদাবীর নিবেদন

এমন একটি সুচিন্তিত চিঠির জন্য রবীন্দ্রনারায়ণ কুণ্ডুকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই৷ শিক্ষার দুরবস্থা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ স্পষ্ট ভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে৷ তিনি যথার্থই বলেছেন, পাশ–ফেল চালু হলেই শিক্ষার সার্বিক বেহাল দশা শুধরে যাবে, একথা সঙ্গত নয়৷ তাই, আমরাও কখনও তেমন কথা বলিনি৷ আমরা বরাবরই বলে আসছি, পাশ–ফেল তুলে দেওয়াটা সরকারের কোনও ইতিবাচক শিক্ষা–পরিকল্পনা নয়, বরং একটা গভীর ষড়যন্ত্র৷ সরকার যদি সত্যিই শিক্ষার উন্নতি চাইত, তাহলে সর্বাগ্রে স্কুলের পরিকাঠামো ঠিক করত৷ অর্থাৎ পর্যাপ্ত শিক্ষক–সহ অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজনের আয়োজন করত৷ সে–সব কিছুই না করে কেবল পাশ–ফেল তুলে দিয়ে সরকার আদতে একের পর এক অশিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাইছে, মূলত সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কাজের বিরোধিতা যাতে কেউ করতে না পারে৷

দ্বিতীয়ত, নীতিগত ভাবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজেরও নির্দিষ্ট সময় অন্তর মূল্যায়ন বা পরীক্ষা প্রয়োজন৷ একধাপ হওয়ারপর পরের ধাপে যাওয়ার আগে দেখে নিতেই হয় আগেরটা ঠিক আছে কি না৷ নাহলে পরের কাজটা পণ্ড হতে পারে৷ সমস্ত কাজের ক্ষেত্রেই এই বিজ্ঞান কাজ করে৷ শিশুর শিক্ষা একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি৷ একেকটি বছর ধরে ঠিক করা হয় তার শিক্ষাসূচি৷ গোটা একটা বছরে সে কতটা কী শিখল, তা পরখ না করে পরের শিক্ষাবর্ষে পাঠিয়ে দেওয়া শুধু তার সর্বনাশ করা নয়, শিক্ষা ব্যবস্থার দীনতাকে অস্বীকার করা৷

প্রসঙ্গত, পাশ–ফেল প্রথা চাই বলে, কাউকে ফেল করানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়৷ আমরা চাই সবাই যথার্থ শিক্ষা পাক৷ কেউ ফেল করলে কেন ফেল করছে সেটা নিয়ে ভাবনা–চিন্তা জরুরি৷ সেজন্য দারিদ্র দূর করতে হবে, পর্যাপ্ত শিক্ষক দিতে হবে৷ সেসব না করে একটা শিশুকে প্রায় কিছুই না শিখিয়ে শুধু পাশ করিয়ে দেওয়া মানে কার্যত তার হাত–পা ভেঙে সারা জীবনের মতো পঙ্গু করে দেওয়া৷ এ সম্পর্কে আরও বিস্তৃত আলোচনা আমরা একাধিক লেখায় করেছি৷ বহু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সেগুলি র সাথে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেছেন৷ এ সত্ত্বেও আমরা সমস্ত চিন্তাশীল ব্যক্তিকেই সেগুলি সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি৷

পরিশেষে, রবীন্দ্রনারায়ণবাবু পুনরায় ধন্যবাদ জানাই খোলা মনে তাঁর অভিমত দেওয়ার জন্য৷ ভবিষ্যতেও তাঁর পত্রের প্রত্যাশা রইল৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা)