একটু নুনের ব্যবস্থা হোক

চাঁদ যেমন তার জ্যোৎস্না মুক্তভাবে বিলিয়ে দেয় প্রাসাদবাসী এবং তার আশেপাশে থাকা ঝুপডিবাসীদেরও, যেন সবার প্রতি তার সমান স্নেহ, ঠিক তেমনই যদি হত প্রতিটি রাষ্ট্রের নিয়মনীতি– সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার কিন্তু আফশোস, বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র্রে তেমনটি হয় না, হয় না এই উপমহাদেশেও৷ দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ‘মানবিক অধিকার বঞ্চিত মানুষ’ হয়ে থাকার বেদনা যখন মনে উথলে ওঠে, তখন সত্যিই মনে হয় এই দেশ আমার জন্য নয়, এই দেশ বাবু–মস্তানদের জন্য৷ আসলে দুর্বলদের প্রতি সবলদের এক ধরনের স্বত্বাধিকার প্রভুত্ব, শ্রেণি বৈষম্যের সৃষ্টি করে৷

কিছুদিন আগে সবাই যখন শারদীয়ার আনন্দে আত্মহারা, মহরমের উৎসবের প্রস্তুতিতে মাতোয়ারা তখনই কলকাতার বুকে চলতে থাকে এক পৈশাচিক যজ্ঞ, বস্তি ও হকার উচ্ছেদ৷ কান্নার রোল, খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য হাহাকার পড়ে যায় সল্টলেক জুড়ে৷ ঢাকের আওয়াজে, মহরমের উৎসবে সাধারণ মানুষের কানে সেই আর্তনাদ পৌঁছয়নি৷ অনূর্ধ্ব সতেরো বিশ্বকাপের জোয়ারে ভেসে গেল দরিদ্র শ্রেণির মানুষগুলোর বাস্তু অধিকার৷ প্রতিদিন গাড়ি গাড়ি পুলিশ আসছে আর বস্তির মানুষদের বুকের উপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে যাচ্ছে৷ রান্না করা খাবারের পাত্রগুলি ফুটবল শটে ছুঁড়ে ফেলছে৷ যুবভারতী স্টেডিয়ামে খেলা শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগেই স্টেডিয়ামের বাইরে খেলা শুরু হয়ে গেছে৷ বস্তি, হকার, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের মাথাগুলোকে ফুটবল করে পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠেছে শাসক দল৷

কেন এই উচ্ছেদ হল? উত্তর খুবই সহজ৷ যুবভারতীতে ফুটবল খেলা হবে৷ সেখানে দেশ–বিদেশের হেভিওয়েট লোকদের আনাগোনা হবে, বিশ্ববাসীদের সাজিয়ে গুছিয়ে দেখাতে হবে আমার বাংলা তথা ভারত স্বচ্ছ৷ সেই উপলক্ষে সমগ্র সল্টলেক থেকে বুভুক্ষু, খেটে খাওয়া, জঞ্জালরূপী মানুষগুলিকে উচ্ছেদ করা চাই৷ কোনও দোকান বা স্টল থাকবে না, থাকবে না ছেঁড়া পোশাক পরিহিত অভুক্ত, অস্থিপঞ্জর দৃশ্যায়িত শুকনো মানুষগুলি৷ পরিবর্তে থাকবে নানা প্রজাতির ফুল ও রঙিন আলোর ঝলকানি৷ বিশ্ববাসী দেখবে লন্ডনের রূপে সাজানো নকল বিশ্ববাংলাকে৷ ভাববে এখানে দারিদ্রের ছিটেফোটাও নেই৷ এই শুনে বাবুদের বুক ফুলে উঠবে আনন্দে, মুখে ফুটবে আত্মপ্রসাদের হাসি৷

কিন্তু বিশ্বাস করুন, গোটা সল্টলেক জুড়ে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষের বাস৷ সবাই দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থিত খেটে খাওয়া দিন মজুর৷ অনেকে আবার যুবভারতীর জন্মের আগে থেকে বসবাস করে আসছে৷ রয়েছে তাদের স্থায়ী বসবাসের ঠিকানা আধার কার্ড, প্যানকার্ড, ভোটার কার্ড৷ তা সত্ত্বেও তাদের উচ্ছেদ করা হল৷ বন্ধ করা হয়েছিল পানীয় জলের ব্যবস্থা, বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল বিদ্যুৎ পরিষেবা৷ এমন মানবতাবিরোধী অত্যাচার দেখেও নীরব এক শ্রেণির মানুষ৷ পাঁচবারের বিশ্বকাপজয়ী পেলে, সক্রেটিস, রোনাল্ডো, কাফু, রোনাল্ডিনহো, রবের্তো কার্লোস, নেইমারদের দেশ ব্রাজিলের মানুষরাও সেদেশে এমন অনৈতিকভাবে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করার জন্য তাঁদের সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন৷ তাঁরা বুঝিয়েছিলেন ফুটবল মানুষরাই খেলে, এই মানুষদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ ফুটবলার হয়৷ তাই মানুষের দাম ফুটবলের থেকে অনেক অনেক বেশি৷ এই সব হতদরিদ্র লোকগুলোর পেটে লাথি মেরে বিশ্বকাপের আসর বসানোর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই৷ সরকারের কাছে অনুরোধ করব যাতে করে তাদের থাকার বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়৷ দাঁড়ানোর মতো আশ্রয় যেন পায়৷ জয় গোস্বামীর কথায় ‘আমরা তো অল্পে খুশি, কি হবে দুঃখ করে’, তাই আমাদের দুঃখ থাকবে না যদি সরকার বস্তিবাসীদের জন্য শুকনো ভাতে একটু ‘নুন’–এর ব্যবস্থা করে৷

মেহেদি হাসান মোল্লা, গোসাবা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা