একই স্লোগান আপনার ঠাকুমাও দিয়েছিলেন

নির্বাচন ঘোষণা হতেই প্রতিশ্রুতির বন্যা বইতে শুরু করেছে দেশজুড়ে৷ জনগণের জন্য কে কী করবে, তাদের কত কিছু পাইয়ে দেবে– তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে চলেছে ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলি৷ এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে প্রলোভন ছাড়া আর কিছু নয়– যা এই দলগুলি প্রতি নির্বাচনে জনগণের ভোট টানতে রুটিন মাফিক দিয়ে থাকে৷

নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিহাসের ডাস্টবিন থেকে কংগ্রেস আবার তুলে এনেছে গরিবি হঠাও–এর স্লোগান৷ বিজেপি নেতারা বুঝে গেছেন, ‘সবার বিকাশ’ কিংবা সবার জীবনে ‘আচ্ছে দিন’, একশো দিনে মূল্যবৃদ্ধি রোধ কিংবা বছরে দু’কোটি চাকরি বা কালো টাকা উদ্ধার করে সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবারের নির্বাচনে আর কাজ করবে না৷ তাই তাঁরা সরে গেছেন ‘দেশরক্ষা’র স্লোগানে৷ তৃণমূলের মতো সব আঞ্চলিক দলগুলিও ভোট টানতে দেদার প্রতিশ্রুতি বিলোচ্ছে৷

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী বিজেপির মতোই শিক্ষা–স্বাস্থ্য–চাকরি ঢালাও প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি বলেছেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে দেশের ৫ কোটি দরিদ্র পরিবারকে মাসে ৬ হাজার টাকা করে বছরে ৭২ হাজার টাকা দেবেন এবং এই ভাবে ২০৩০–এর মধ্যে দেশ থেকে দারিদ্র একেবারে নির্মূল করে দেবেন৷ দারিদ্র দূরীকরণের এই মহৌষধ নাকি তাঁর নির্দেশে ওস্তাদ সব বিশেষজ্ঞরা ছ’মাস ধরে অনেক মাথা খাটিয়ে আবিষ্কার করেছেন৷ রাহুল বলেছেন, ‘একদিকে অনিল আম্বানির ভারত, অন্য দিকে গরিবের ভারত থাকবে না৷’ তিনি বলেছেন, ‘একুশ শতকে দেশে এত লোক গরিব, সেটা কোনও ভাবেই মানা যায় না৷’

কথাগুলি কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী বলেছেন– এটা না জানলে মনে হবে, কোনও দেবদূত বুঝি মানুষের দুঃখ দেখে তা দূর করতে হঠাৎ মর্ত্যে নেমে এসেছেন৷ কিন্তু গরিবদের কথা রাহুলের কখন মনে পড়ল? ঠিক নির্বাচনের সামনে এসে৷ নির্বাচন এলেই এই সব ভোটবাজ দলগুলির নেতাদের গরিব মানুষের কথা মনে পড়ে৷ গরিবি দূর করার তাড়নায় চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে৷ ভোট চলে গেলে গরিবদের কথা আর মনেও থাকে না৷ কেউ জোর করে চেপে ধরলে বলেন, ‘গরিব? দেশে আর গরিবি আছে নাকি? সে তো আমরা কবেই দূর করে দিয়েছি৷’ যেমন এ রাজ্যে তৃণমূল নেত্রী কিংবা কেন্দ্রে বিজেপি নেতারা বলছেন, তাঁরা প্রায় সব বেকারদেরই কাজ দিয়ে দিয়েছেন৷

রাহুল গান্ধী কি হঠাৎ জানতে পারলেন যে একুশ শতকেও দেশে এত লোক গরিব? তিনি কি এতদিন জানতেন দেশে কোনও গরিব নেই, সবাই তাঁর পরিবারের মতো ধনী? তা হলে তো তিনি দেশ পরিচালনার যোগ্য ব্যক্তিই বটে রাহুল গান্ধীর পরিবারই তো স্বাধীনতার পর থেকে চার দশক প্রায় টানা দেশ শাসন করেছে৷ একুশ শতকে দেশে তবু কেন এত গরিব থাকল, কেন ধনী–গরিবে এমন আকাশ–জমিন ফারাক হল– এই প্রশ্নের জবাব তো তাঁর এবং তাঁর পরিবারেরই দেওয়ার কথা৷ সেই জবাবাদিহি এড়িয়ে নির্বাচনের সামনে হঠাৎ গরিব–দরদি সাজার তাঁর উদ্দেশ্যটা কী? এটা তো চরম ভণ্ডামি দেশের মানুষের সাথে আবার একটা বিরাট প্রতারণা

রাহুল গান্ধী যে প্রতিটি গরিব পরিবারকে মাসে ছ’হাজার টাকা করে দেবেন বলেছেন, তা তিনি কোথা থেকে দেবেন? তাঁর পারিবারিক সম্পদ থেকে তো নয়, দেশের মানুষের অর্জিত সম্পদই তো তাদের ভিক্ষার মতো ছুঁড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন প্রথম কথা, পূর্বতন কংগ্রেস–বিজেপি প্রতিটি সরকারের মতো, তিনিও যদি ক্ষমতায় আসেন, তবে এই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলতে তাঁর মুহূর্ত সময় লাগবে না৷ তাঁর মধ্যে দেশের মানুষ এমন কিছু দেখেনি, যাতে তাঁকে তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে অন্য রকম বলে তাদের মনে হতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, এর জন্য কত টাকা লাগবে, সেই টাকা কোন খাত থেকে আসবে, আদৌ তা বাস্তবসম্মত কি না ইত্যাদি তর্কে না গেলেও, রাহুলবাবু কি মনে করেন, মাসে ছ’হাজার টাকা করে পেলে গরিব পরিবারগুলির গরিবি দূর হয়ে যাবে? সবাই জানে, তা আদৌ দূর হবে না৷ তা হলে তিনি এমন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কেন?

এই ভিক্ষা তো দেশের মানুষ রাহুলবাবুর কাছে, কিংবা কোনও সরকারের কাছে চায়নি৷ অমর্যাদাকর এই ভিক্ষার দান নয়, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে প্রত্যেকে চায় নিজের পরিশ্রমে মর্যাদার সাথে বাঁচতে৷ রাহুলবাবু সত্যিই দারিদ্র দূর করতে চাইলে প্রত্যেকের জন্য মর্যাদাকর কাজের ব্যবস্থা করার কথা বলছেন না কেন? সবার আগে তিনি দেশের মানুষকে বলুন, স্বাধীনতার বাহাত্তর বছরেও বেশির ভাগ মানুষ কেন সেই মর্যাদার জীবন পেল না? কোথায় তা আটকাল? ভারতের মতো একটি দেশে, যেখানে রয়েছে সমস্ত রকমের প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার, সেখানে মানুষ কেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম গরিব থাকে? দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন ক্রমাগত আরও গরিব হয়ে চলেছে তখন মুষ্টিমেয় মানুষের সম্পদের পাহাড় কী করে আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে? কী করে ৯৯ শতাংশ দরিদ্রের বিপরীতে ১ শতাংশ অনিল আম্বানিদের ভারত তৈরি হল? অর্থাৎ গরিবির কারণ কী এবং তার সমাধান তিনি কীভাবে করতে চান তা আগে তিনি দেশের মানুষের সামনে স্পষ্ট করে রাখুন৷ তা কিন্তু তিনি বলছেন না৷ অর্থাৎ গরিবির কারণটিকে তিনি দেশের মানুষের কাছে গোপন করে যাচ্ছেন৷ কেন গোপন করছেন? কারণ তা সামনে এসে গেলে তাঁর বা তাঁর মতো রাজনীতি ব্যবসায়ীদের আর গরিব–দরদি সাজা হয় না৷ মানুষের গরিবির কারণ যে তাদের ভাগ্য বা পূর্বজন্মের পাপের ফল নয়, শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাই প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে জনগণের পরিশ্রমের সমস্ত ফসল লুঠ করে পুঁজিপতিদের ভাণ্ডারে জমা করে গরিবির জন্ম দিয়ে চলেছে, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে গরিবিতে টেনে নামাচ্ছে– এই সত্যটিকেই রাহুলবাবুরা, মোদিবাবুরা, মমতাদেবীরা, সব রাজনীতির ব্যবসায়ীরা জনগণের থেকে আড়াল করতে চান৷ তাঁরা শোষণমূলক এই সমাজব্যবস্থাকে অটুট রেখে, বরং তার সেবা করার দায়িত্ব নিয়ে গরিবদের জন্য শুধু কিছু খয়রাতি করতে চান৷ এর নাম দিয়েছেন তাঁরা দারিদ্র দূরীকরণ আসলে রাহুলবাবুরা সত্যিই দেশের মানুষের গরিবি দূর করতে চান না৷ তাঁরা চান মানুষকে গরিব রেখেই তাদের গরিবি নিয়ে ভোটের রাজনীতি করতে আর ভোটের সময় গরিব দরদি সেজে মানুষকে ভুলিয়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করতে৷ তাঁরা চান গরিব মানুষকে মাঝে মাঝে এমনই কিছু ভিক্ষের খুদ–কুঁড়ো ছুড়ে দিয়ে তাদের ক্ষোভটাকে স্তিমিত করতে৷ তাঁরা যে রাজনীতি করেন, সেই রাজনীতি কখনও গরিবি দূর করতে পারে না৷ অসহায় অসচেতন মানুষকে সুখের আশার কথা শুনিয়ে বাস্তবে তাঁরা পুঁজিবাদী শোষণটাকে আড়াল করতে চান৷ এই আড়াল করাটাই তাঁদের রাজনীতি৷ এই ভাবেই তাঁরা শোষক শ্রেণির বিশ্বস্ত প্রতিনিধি তথা রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে চলেছেন৷

রাহুলবাবু নিশ্চয়ই জানেন, তাঁর ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধী আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালে ঠিক তাঁরই মতো নির্বাচনের আগে গরিবি হঠাও–এর ডাক দিয়ে গরিব মানুষের কাছে ভোট চেয়েছিলেন৷ সরকারের ধামাধরা সংবাদমাধ্যম তখন তাঁকে গরিবের মা–বাপ বলে প্রচার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ কিন্তু গরিবির গায়ে তিনি আঁচড়ও কাটতে পারেননি৷ বরং তাঁর শাসনেও আরও অজস্র মানুষ গরিবির অন্ধকারে তলিয়ে গেছে৷ রাহুল গান্ধী তো তাঁর ঠাকুমা কিংবা তাঁরও বাবা জওহরলালের থেকে আলাদা কোনও নীতির কথা ঘোষণা করেননি৷ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তাঁর শাসনে একজন কালোবাজারিকেও ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাতে পারেননি৷ বরং, কালোবাজারি, মজুতদার, একচেটিয়া পুঁজির মালিকরাই দেশের কোটি কোটি মানুষকে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, অনাহারের ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে চলেছে৷ এই অবস্থার সত্যিই পরিবর্তন চাইলে দাঁড়াতে হবে গরিবির জন্মদাতা এই শোষণমূলক, মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে৷ রাহুলবাবু কংগ্রেসের নেতা হিসাবে তো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন না৷ তাই তাঁদের মুখে গরিবি দূর করার প্রতিশ্রুতি শুধুমাত্র অসহায় অসচেতন মানুষকে ভুলিয়ে ভোটে জিতে মন্ত্রী হওয়ার জন্য, শাসক হওয়ার জন্য৷ এই জন্যই শাসক শ্রেণি কখনও চায় না দেশের সাধারণ মানুষ শিক্ষার সুযোগ পাক, সচেতন হোক৷ জনতার অজ্ঞতাই যে শাসক শ্রেণির আসল শক্তি রাহুল গান্ধী, নরেন্দ্র মোদিদের আচরণ বারবার তা প্রমাণ করছে৷

পুঁজিপতি শ্রেণির আর এক একনিষ্ঠ সেবক বিজেপির নেতারা গত পাঁচ বছরে দেশের মানুষের কাছে ধরা পড়ে গেছেন৷ তাঁদের সব প্রতিশ্রুতিই যে ভুয়ো, তাঁদের শাসনে যে জনগণ নয়, পুঁজিপতিদেরই আচ্ছে দিন এসেছে তা দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে আজ স্পষ্ট৷ তাই জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির সমাধানের কথা বিজেপি নেতারা এবার এড়িয়ে চলছেন৷ তাঁরা এবার দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলছেন, দেশরক্ষার ঠিকেদারি ঘোষণা করছেন৷ পুলওয়ামায় জওয়ানদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় যখন দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলতে থাকল, কেন আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও সরকার জওয়ানদের প্রাণ রক্ষার ব্যবস্থা করল না, এত বিপুল পরিমাণ আরডিএক্স বিস্ফোরক কোথা থেকে এল, তখন মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে পাকিস্তানে জঙ্গি ঘাঁটি ভাঙার গল্প শুরু হল৷ বিজেপি নেতারা বুঝে গেছেন, এই গল্পের রেশও বেশিদিন থাকবে না৷ তাই প্রধানমন্ত্রী উপগ্রহ ধ্বংসের নতুন গল্প ফেঁদেছেন৷ দেশের কোটি কোটি মানুষ বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতার জ্বালায় ছটফট করছে৷ তাদের জীবনে আচ্ছে দিন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় বসেছিল বিজেপি৷ সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করার কথা এড়িয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এখন উপগ্রহ ধ্বংসের গল্প শোনাচ্ছেন৷ কেন তিনি বলতে পারলেন না, গত পাঁচ বছরে আমরা এমন শাসন কায়েম করেছি যাতে মূল্যবৃদ্ধির উপর, বেকারির উপর, অজ্ঞতার উপর, মানুষের দ্বারা মানুষের উপর শোষণের বিরুদ্ধে নিখুঁত আক্রমণ হানতে পেরেছি? বিজেপি নেতারা দেশরক্ষা বলতে কি শুধু দেশের মাটিকে রক্ষা করা বোঝেন? দেশ মানে তো আসলে দেশের মানুষ৷ তাদের মানুষের মতো বাঁচার ব্যবস্থা না করে তাঁরা কোন দেশরক্ষা করতে চান? আসলে তাঁদের পাঁচ বছরের শাসনের চরম জনবিরোধী ভূমিকা ভোলাতেই এই সব আজগুবি গল্প ফাঁদতে হচ্ছে৷

বাস্তবে কী বিজেপি, কী কংগ্রেস– মিথ্যা প্রতিশ্রুতির প্রতারণা ছাড়া দেশের মানুষকে এইসব ভোটবাজ দলগুলির আর কিছু দেওয়ার নেই৷ স্বাধীনতার পর গত বাহাত্তর বছরের ইতিহাস তাই দেশের মানুষের সাথে শাসক দলগুলির প্রতারণার ইতিহাস৷ গণতন্ত্রের নামে এই নির্বাচন আসলে আগামী পাঁচ বছর দেশের সম্পদ কারা লুঠ করবে, সেই কাজে শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে কারা কাজ করবে তারই এক বুর্জোয়া প্রতিযোগিতা৷ এই প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষের কোনও স্বার্থ নেই৷ নির্বাচনের দ্বারা এই শোষণ–লুঠতরাজ বন্ধ হবে না৷ তা বন্ধ করতে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত শক্তির জন্ম দিতে হবে, যা তাদের নিজস্ব দাবিকে সামনে রেখে দেশব্যাপী এক বিরাট গণআন্দোলনের জন্ম দেবে৷ সেই গণআন্দোলনের শক্তিই বদলে দেবে শোষণমূলক এই ব্যবস্থাকে৷ কায়েম করবে জনগণের নিজেদের শাসন৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা)