এই বিপন্নতা শুধু কৈশোরের নয়, সমাজেরও

70 Year 29 Issue 9 March 2018

 

‘বিপন্ন কৈশোর’–এই সংবেদনশীল বিষয়টি নিয়ে ইফতিকার আলির চিন্তাসমৃদ্ধ আলোচনার জন্য (৭০ বর্ষ, ২৮ সংখ্যা) ধন্যবাদ এবং স্পর্শকাতর এই বিষয় নিয়ে আরও ভাবনার আদান–প্রদান বর্তমান সমাজ জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে যথার্থভাবেই জরুরি মনে করায় গণদাবী সম্পাদকমণ্ডলীকে ধন্যবাদ৷

আমাদের শিশু–কিশোররা সমাজ পরিবেশের মধ্য দিয়েই বড় হয়ে ওঠে৷ আমরা পিতামাতারা, আত্মীয়স্বজন (যাদের তারা কাছে পায়), পাড়াপড়শী, স্কুলের শিক্ষক–শিক্ষিকা— এরাই এদের পরিবেশের সচেতন ভূমিকা পালন করে থাকি৷ কিন্তু আদৌ আমরা সচেতন ভূমিকা পালন করতে পারি কি? মনে হয় সমাজ অভ্যন্তরে যে বিচিত্র সম্পর্কগুলির মধ্যে আমরা অবস্থান করি, যা আমাদের সমাজ পরিবেশকে স্নেহ–ভালোবাসা, স্নিগ্ধতা ও মাধুর্যে সুন্দর করে তোলে, আজ এই সম্পর্কগুলিতে যেন ভাঙন দেখা দিয়েছে৷ যে সামাজিক মূল্যবোধকে আধার করে এই সম্পর্কগুলি বিকশিত হত, আজ যেন তাতে চূড়ান্ত অবক্ষয়৷ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যেও দানা বেঁধে উঠছে অবিশ্বাস ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব৷ একসময়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলি পর মুহূর্তেই ঠুনকো কাঁচের মতো ভেঙে যেতে থাকে৷ আর তাতে যে বিষ ঝরে পড়ে, তা বিষাক্ত করে তোলে সমাজ পরিবেশকেই৷ আর আমাদের শিশু–কিশোররা বড় হয়ে ওঠে এই বিষাক্ত পরিবেশেই৷ তাদের বিপন্নতা আসলে আমাদেরই বিপন্নতা৷ আমরা এটা বুঝি, তাই আগলে রাখতে চাই৷ আমাদের অতি সতর্কতা শিশুর পরিসরকে সঙ্কীর্ণ করে তোলে— বাড়িতে, স্কুলে সর্বত্র৷ তার বোধশক্তির স্বাভাবিক বিকাশটা ব্যাহত হয়৷ যা তাকে শেখানো হয়, তা তার বোধকে পুষ্ট করে না৷ আজ থেকে সত্তর–পঁচাত্তর বছর আগে চার্লি চ্যাপলিন তাঁর ‘মর্ডান টাইমস’ নির্বাক চলচ্চিত্রে এক বিপন্ন সমাজের ছবি দেখিয়েছিলেন, যেখানে যন্ত্রের বেল্টের গতির সাথে মানুষের জীবনকে বেঁধেফেলা হয়েছে৷ আর এই গতিতে চাপা পড়ে থাকছে তার হূদয়বৃত্তি৷ আধুনিক সমাজের সাথে তাল মেলাতে আমাদের হূদয়বৃত্তিগুলির থেকেও বড় হয়ে উঠেছে অনুশাসনের বেড়ি৷

তাতে কৈশোরকে এই বিপন্নতা থেকে বাঁচানো সম্ভব কি? আনা লুইস স্ট্রং–এর ‘দুরন্ত নদী’ উপন্যাসে রাশিয়ার পুরোনো সমাজের বখাটে কিশোরদের একটি দল, যারা নানা অসামাজিক কাজ করে বেড়াতো, তাদের নায়ক স্তেপানকে সেখানকার সমাজ সংগঠকরা এক দায়িত্বশীল সংগঠকে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন – এটা উপন্যাসে সুন্দর করে দেখানো হয়েছিল৷ এটা যে শুধু উপন্যাসেই ঘটেছিল, তা নয়৷ পরে দেখা গেছে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় ‘বিপন্ন’ পথশিশুদের যথাযথভাবে লালন পালন করার মধ্য দিয়ে তাদের তাঁরা সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছিলেন৷ তাই প্রশ্ন জাগে কৈশোরের এই বিপন্নতা কি আসলে আমাদের সমাজেরই বিপন্নতা?

সূর্য গুপ্ত, কলকাতা