এই নাকি রাজধানী সাজানোর সময়! এ সরকার কাদের জন্য?

উদাহরণটা অতি-ব্যবহারে হয়ত ধার হারিয়েছে। কিন্তু এমন অসংবেদনশীলতা, দেশের মানুষের দুর্দশার প্রতি এতখানি নির্মম উদাসীনতার সামনে দাঁড়িয়ে রোমসম্রাট নিরোর সেই অতি প্রচলিত কাহিনি মনে পড়বেই– একদা রোম যখন আগুনে পুড়ছিল, সম্রাট নিরো মনের আনন্দে প্রাসাদের ছাদে বসে বেহালা বাজাচ্ছিলেন।

এমনই ঘটতে দেখা গেল এবার ভারতে। গোটা দেশ যখন অতিমারির আক্রমণে বিধ্বস্ত, ঠিক সেই সময় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মহা উৎসাহে গ্রহণ করল বিপুলায়তন এক পরিকল্পনা, যার নাম ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’। কী হবে এতে? নতুন দিল্লির ঠিক মাঝখানে তৈরি হবে ঝকঝকে এক নতুন রাজধানী। সেখানে থাকবে নতুন সংসদ ভবন। তাকে ঘিরে দশটি প্রশাসনিক ভবন। থাকবে প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতির বিলাসবহুল ও বিশালাকার বাসভবন। প্রধানমন্ত্রীর আশা, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে ২০২২ সালে দ্বারোদঘাটন হবে এই নতুন প্রাসাদগুলির। প্রাথমিক ভাবে এর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। ওয়াকিবহালরা জানাচ্ছেন, মোট খরচের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটিও ছাড়াতে পারে। এখানে বলে রাখা ভাল, এই ভয়ঙ্কর অতিমারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই সরকারই বরাদ্দ করেছে মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা!

নতুন সংসদ ভবন গড়ার বরাত ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছে টাটা কোম্পানি। বরাদ্দ হয়েছে ৯২২ কোটি টাকা। ঠিক এই সময়ে দেশের অর্থনীতির চেহারাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। গত কয়েক বছর ধরেই বেহাল দশা চলছিল ভারতীয় অর্থনীতির। তার ওপর করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়ে গেছে। বেহাল দশা কর্মসংস্থানেরও। লকডাউনে অসংখ্য সংস্থা, ছোট দোকানপাট, ব্যবসাপত্র বন্ধ হয়ে কাজ গিয়েছে বহু মানুষের। এখন আনলক পর্বে চলছে ব্যাপক ছাঁটাইয়ের পালা। শুধু বেসরকারি ক্ষেত্র নয়, খোদ সরকারি দপ্তরগুলিতেও কর্মীসংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিজস্ব নিয়মের গেরোয় পড়ে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে করোনা অতিমারি। দু’বেলা দু’মুঠো জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠছে দেশের অধিকাংশ মানুষের। অসুখে পড়লে সরকারি হাসপাতালে বেড নেই, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। করোনা মোকাবিলায় কি কেন্দ্র, কি রাজ্য– কোনও সরকারই এমনকি অস্থায়ী হাসপাতালও তৈরি করেনি।

এই যখন অবস্থা, ঠিক তখনই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার হাতে নিল সেন্ট্রাল ভিস্টার মতো প্রকল্প। একে সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অসংবেদনশীলতা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! একটি হিসাব বলছে, এই টাকায় অনায়াসে তৈরি করা যেত দিল্লির এআইআইএমএস-এর মতো উঁচু মানের ১৫টি হাসপাতাল। একটু খাবারের জন্য হন্যে হওয়া দেশের মানুষকে বিনা পয়সায় আরও দীর্ঘদিন ধরে খাবার জোগানো যেত। প্রতিটি মানুষের হাতে তুলে দেওয়া যেত কিছু কিছু করে অর্থ, যাতে কেনাকাটা করে তাঁরা অর্থনীতিকে সচল রাখতে পারেন। জাতীয় শিক্ষানীতিতে ঢাক পিটিয়ে বলা হয়েছে সমস্ত শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনতে ঢেলে সাজানো হবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে। এই টাকায় কার্যকরী ভাবে তা করা যেত, বেহাল স্কুলগুলিরও হাল ফেরানো যেত। করা যেত আরও বহু কিছু, শুধু যদি কেন্দ্রীয় সরকারের মাথায় দেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের দুরবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণাটুকু থাকত। তা যে নেই, সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা যে শুধুই দেশের আসল মালিক পুঁজিপতিদের মুনাফার থলির আকার ঠিক রাখার ব্যবস্থা করতেই নিবেদিতপ্রাণ, এই সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

বিজেপি সরকারের এক সংসদীয় মন্ত্রী আবার সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পের যৌক্তিকতা বোঝাতে গিয়ে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের দোহাই দিয়ে বলেছেন, তাঁরাই বলে থাকেন, টাকা খরচ করলে অর্থনীতি সচল থাকবে। সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে সেটাই করা হচ্ছে। তাঁর কাছে প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞরা কি এই পথে টাকা খরচের পরামর্শ দিচ্ছেন? এভাবে এই বিপুল টাকা খরচের দ্বারা অর্থনীতির কী বিশেষ উপকার হবে? এখন তো প্রয়োজন ছিল, স্থায়ী উৎপাদনের ব্যবস্থা করা। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সমাজকল্যাণমূলক খাতে বেশি করে টাকা সরবরাহ করা। যাতে কর্মসংস্থানের হার কিছুটা বাড়ে, মানুষের হাতে টাকা আসে। পাশাপাশি জীবনধারণ নিশ্চিত হয় খাদ্যহীন মানুষের। তা না করে এই দুর্যোগের কালে রাজধানী শহরকে জাঁকালো রূপ দিতে পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন তাঁরা! এ তো অনাহারী মানুষের চোখের সামনে বসে থালা ভরা সুস্বাদু পোলাও-কালিয়া খাওয়ার মতোই চূড়ান্ত রুচিহীন গর্হিত একটা কাজ!

লকডাউনে প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিরাট সংখ্যক মানুষ, যাদের একটা অংশ আজ অনাহারের মুখে দাঁড়িয়ে, তাদের পাশে দাঁড়ানো, সেই মানুষগুলির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া– এমন আচরণই তো প্রত্যাশিত একটা গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে। যাদের ভোটে সরকারে বসেছে, তাদের প্রতি এটা তো তাদের নূ্যনতম দায়বদ্ধতা। অথচ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সেদিকটা থেকে সম্পূর্ণ চোখ ফিরিয়ে বিপুল টাকা খরচ করে নিজেদের প্রিয়পাত্র পুঁজিমালিকদেরই আরও খানিকটা সুবিধা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করল। এই আচরণ ভুলবে না দেশের মানুষ। ক্ষমা করবে না পুঁজিপতিদের নির্লজ্জ দালাল এই সরকারের নিষ্ঠুর কার্যকলাপ।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ৭ সংখ্যা_২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০)