এই আনন্দোল্লাস হতাশা-যন্ত্রণা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা

বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল মাঝরাতে। বোমা, নাকি ভূমিকম্প? না না, এ তো বাজি ফাটছে একটার পর একটা! সঙ্গে কান-ফাটানো চিৎকার। না, আর্তনাদ নয়, বহু জনের উন্মত্ত উল্লাস। একটু ধাতস্থ হয়ে ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে সমস্তটা পরিষ্কার হল। এইমাত্র ঠিক বারোটার ঘর পার করল ঘড়ির কাঁটা। শেষ হয়ে গেল পুরনো বছর। জীবননাট্যের মঞ্চে প্রবেশ করল নতুন বছরের প্রথম দিন। তাকে বরণ করে নিতেই পাড়ার ক্লাবের সামনে এই ভয়ঙ্কর শোরগোল।

৩১ ডিসেম্বর রাত জুড়ে এমন অভিজ্ঞতার শরিক হতে হয়েছে অনেককেই। মাঝরাত থেকে প্রায় ভোর পর্যন্ত বর্ষবরণের উৎকট উল্লাসের মাশুল গুনতে হয়েছে নাগরিকদের। রাত জুড়ে দু-চোখের পাতা এক করতে পারেননি বহু প্রবীণ ও অসুস্থ মানুষ। শিশুরা ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠেছে। কিন্তু সেদিন কোনও কিছুর পরোয়া করার মতো মানসিকতা ছিল না উল্লাসে মত্ত তরুণ-তরুণীদের।

শুধু কি পাড়ার মধ্যে বেপরোয়া হৈ-হুল্লোড়! উৎসব উদযাপনে রাস্তায় নেমে পড়া তরুণ-তরুণীরা সেদিন যেন সমস্ত সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা, স্বাভাবিক ভব্যতা বোধ– সমস্ত কিছুকে উড়িয়ে দেওয়ার নেশায় মেতে উঠেছিল।

বর্ষবরণের রাতে বিকট শব্দের বাজির দাপটে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। রাত ১২টায় শুরু হয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে চলেছে বাজি ফাটানো। সঙ্গে কোথাও উচ্চগ্রামে মাইক, কোথাও বা ডিজে। তার সঙ্গে সহ্য করতে হয়েছে সাইলেন্সার না লাগানো বাইকের কানফাটানো আওয়াজ।

উল্লাসের উন্মত্ততায় এমনকি প্রাণেরও তোয়াক্কা করেনি তারা– নিজেদের শুধু নয়, পথচারীদেরও। শহরের রাস্তায় রাস্তায় হেলমেট না পরে তাণ্ডব চালিয়েছে বাইক-সওয়ারিরা। পরিণাম হয়েছে মারাত্মক। বিদায়ী বছরের শেষ রাত থেকে নতুন বছরের প্রথম রাত– এই ২৪ ঘন্টায় শুধু কলকাতা শহরে পুলিশের খাতাতেই লেখা হয়েছে ১৬৫টি দুর্ঘটনার খতিয়ান। হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে আরও কতজন– কেউ জানে না। খবরে দেখা যাচ্ছে, ওই ২৪ ঘন্টায় কলকাতায় শুধু পিজি হাসপাতালের ট্রমা কেয়ারে ভর্তি হয়েছেন ৪০ জন দুর্ঘটনাগ্রস্ত, যাদের ৮০ শতাংশ বাইকচালক কিংবা তার আরোহী। ট্রাফিক আইন ভাঙার জন্য শুধু কলকাতা শহরে ৩১ ডিসেম্বর ৬৬৪ জনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।

বর্ষবরণের রাত যেন ভেসে গিয়েছিল মদের জোয়ারে। ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতার মদের দোকানগুলিতে ছিল রেকর্ড ভাঙা ভিড়। সন্ধে্য থেকেই রাস্তায় ঘাটে টলমলে পায়ে হাঁটতে থাকা মত্ত মানুষের দেখা মিলেছে। রাত যত বেড়েছে, বেড়েছে মদের দাপট। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট ছিল এ দিনের উৎসবের কেন্দ্রস্থল। সেখানে বিপুল ভিড়ের মধ্যে মত্ত তরুণ-তরুণীদের সামাল দিতে ঘাম ছুটেছে পুলিশের। মদ খেয়ে বেসামাল তরুণ-তরুণীকে চ্যাংদোলা করে থানায় তুলে নিয়ে যেতে হয়েছে। ঝগড়া ও তা থেকে মারপিটে জড়িয়ে পড়া মাতালদের কাছে পৌঁছে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের দম ছুটে গিয়েছে। মত্ত অবস্থায় তীব্র গতিতে বাইক চালাতে গিয়ে গ্রেফতারও হয়েছে প্রায় দুশো জন। কলকাতা শুধু নয়, দিল্লি সহ দেশের বড় শহরগুলিতেও সেদিন দেখা গিয়েছে প্রায় একই ছবি।

শুধু বর্ষবরণের রাত নয়, ইদানীং যে কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানকে ঘিরেই যুব প্রজন্মের বাঁধনহারা উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। বিশ্বসংসারের কোনও কিছুর প্রতি যেন তাদের ভ্র+ক্ষেপ নেই– আছে শুধু নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চাওয়া উৎকট হুল্লোড়বাজি।

কিন্তু এই উন্মত্ত উল্লাস কিসের প্রকাশ? প্রাণের গভীরে থাকা বিপুল আনন্দই কি এর় উৎস! প্রশ্ন জাগে। তাই যদি হবে, তাহলে নানা উৎসব সমারোহে পথে পথে জনস্রাতে ভেসে থাকা সুসজ্জিত, মেক-আপ-রঙিন নারী-পুরুষের অধিকাংশের মুখেই কেন দেখতে পাওয়া যায় না আনন্দের সেই উজ্জ্বল উদ্ভাস? আনন্দের বন্যা যদি এতই প্রবল, তবে কেন রাস্তায় ঘাটে ট্রেনে বাসে তারুণ্য আজ এত অসহিষুiর! কেন মুখোমুখি কথাবার্তায় কিংবা মোবাইলে প্রকাশ্যেই আজ এত গালিগালাজের প্রবাহ? মদ্যপান আজ প্রতিটি উৎসব-অনুষ্ঠানের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে কেন? আনন্দে মাততে কেন আজ কৃত্রিম উত্তেজক অবশ্যপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে? বর্ষবরণের রাতের ওই উদ্দামতা যদি আনন্দপ্রবাহই হবে, তাহলে রাত ফুরাতেই সেই আনন্দ কোথায় অদৃশ্য হল! সত্যিকারের আনন্দ তো মানুষকে শান্ত ও ধৈর্যশীল করে, তাকে সহিষুiর হতে, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখায়! অথচ উল্লাসের এই ফোয়ারার পাশেই এখন ভিড় জমাচ্ছে গাঢ় অন্ধকার।

এই অন্ধকার আসলে হতাশার, অনিশ্চয়তার। এই অন্ধকার স্বার্থহীন প্রকৃত ভালবাসার অভাবের। দেশের তরুণ সমাজকে আজ ভয়ঙ্কর এক অনিশ্চিত জীবনসমুদ্রে পাড়ি দিতে হচ্ছে। দেদার অর্থ না থাকলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত। কোনও রকমে ডিগ্রি জোগাড় করলেও কাজ জোগাড় করা যাবে কি না জানা নেই। বহু কষ্টে চাকরির পরীক্ষায় পাশ করলেও ঘুরপথে সেই চাকরি মুঠোয় পুরছে অন্য কেউ। বেকার জীবনের গ্লানি, সংসারের আর্থিক দায়িত্ব বহনের অক্ষমতা তরুণ সমাজকে অসহনীয় যন্ত্রণার জীবনে ঠেলে দিচ্ছে, ধসিয়ে দিচ্ছে ভিতর থেকে। গোটা দেশ ছেয়ে গেছে চুরি-দুর্নীতিতে। মূলধারার রাজনীতি ক্ষমতার লালসায় মত্ত। আদর্শ নেই, নীতি নেই, নেই অনুসরণযোগ্য কোনও নেতা-নেত্রী। পরিবারিক পরিবেশে, ঘনিষ্ঠ পরিজনদের সঙ্গে, এমনকি মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের মধ্যেও যেন আজ বিস্তর ফাঁক। বন্ধুর প্রতি বিপুল ভালবাসার টান নেই, প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নেই নূ্যনতম বিশ্বস্ততা, দায়বদ্ধতা। সর্বত্রই শুধু স্বার্থ আর লেনদেনের হিসেব। কালের নিয়মে মরতে-বসা মুনাফাসর্বস্ব এই পুঁজিবাদী সমাজ এমন হিসেব কষতেই প্রণোদিত করছে মানুষকে, করে তুলছে তুমুল স্বার্থপর। কিন্তু মানবিক সম্পর্ক তো আর স্বার্থসিদ্ধির হিসেব-নিকেশের বিষয় নয়! সমাজ জুড়ে তাই এই বিপুল শূন্যতা।

এই শূন্যতা মূল্যবোধহীনতার। এই শূন্যতা ছিন্নমূল যাপনের ফসল। পুরনো দিনের ধর্মীয় মূল্যবোধ আজ নিঃশেষিত। তা আজ আর মানুষকে শান্তি-সুস্থিতি, গভীর আনন্দের সন্ধান দিতে পারে না। আবার, যে পুঁজিবাদী সমাজে আমরা বাস করি, তা পচা-গলা শবদেহের আকার নেওয়ায় এই সমাজের সর্বোন্নত আদর্শ যে মানবতাবাদী মূল্যবোধ, তা-ও আজ অদৃশ্য। বাস্তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে হঠিয়ে এ দেশে যখন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যস্থা কায়েম হয়, দুনিয়া জুড়ে তখনই পুঁজিবাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে, ভাঙতে বসেছে তার মানবতাবাদী আদর্শের উন্নত কাঠামো। ফলে স্বাধীন ভারতীয় সমাজে মানবতাবাদের উন্নত আদর্শ সর্বত্র সঞ্চারিত হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও দেশ স্বাধীন করার লক্ষে্য এ দেশে আপসহীন ধারায় যে সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তা সেই যুগে উন্নত মূল্যবোধের জন্ম দিতে পেরেছিল। সেই মূল্যবোধে বলীয়ান পরাধীন ভারতের তরুণ প্রজন্ম বেপরোয়া সাহসে প্রাণ বাজি রেখে একের পর এক দুর্বার সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে।

হ্যাঁ, প্রাণের বাজি ধরতে পরাধীন দেশের তরুণরাও দ্বিধা করেনি। কিন্তু তার সঙ্গে আজকের তরুণ প্রজন্মের বেপরোয়া মত্ততার তফাৎ আছে। স্বাধীনতার স্বপ্নে মাতোয়ারা যুবশক্তির সামনে ছিল অত্যাচারী শাসকের কবল থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার মহান লক্ষ্য। কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্ম লক্ষ্যহীন। তারা ছিন্নমূল। আকুল হয়ে জীবনের মানে খুঁজে চলেছে তারা। স্বার্থসর্বস্ব এই সমাজের হিসেবি, কুটিল পঙ্কিলতা তাদের যন্ত্রণাতুর করে তুলেছে। বাইরের চেহারা যতই উজ্জ্বল করে রাখার চেষ্টা হোক না কেন, ভিতরে ভিতরে তারা স্বার্থশূন্য প্রকৃত ভালবাসার কাঙাল হয়ে রয়েছে। যে কোনও সুযোগে উদ্দাম উল্লাসের মত্ততায় সেই ভালবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণাকেই বোধহয় ডুবিয়ে দিতে চায় তারা। সাইলেন্সারহীন বাইকের বীভৎস আওয়াজে ঢাকতে চায় নিজেদের বুক-ফাটা আর্তনাদ। প্রাণের পরোয়া না করে নিয়মভাঙা উদ্দাম গতির মধ্যে খুঁজে নিতে চায় বেঁচে থাকার আনন্দ। কিন্তু খানিক পরেই আবার ফেরে বিষাদ।

ক্ষণিকের এই উন্মত্ততা, আনন্দহীন উদযাপনের এই কৃত্রিম উল্লাস আসলে তাদের যন্ত্রণা ঢাকারই ব্যর্থ প্রয়াস, পচা-গলা এই সমাজের পাথর-কঠিন বুকে নিষ্ফল মাথা কোটা।