উন্নয়ন শুধু সরকারি বিজ্ঞাপনে, বাস্তবে প্রকল্প রূপায়ণ অথৈ জলে

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরে একের পর এক সরকারি প্রকল্পের ঘোষণা করেছিল মোদি সরকার৷ অধিকাংশই পূর্বের কংগ্রেস সরকারের প্রকল্পগুলির নাম বদলে নতুন নামকরণ৷ বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ করে দেওয়া হয়েছিল প্রকল্পগুলির প্রচারে৷ রূপায়িত হয়েছে কটি?

কোনও বেসরকারি রিপোর্ট নয়, খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট বলছে, প্রকল্পগুলির অধিকাংশেরই অর্থ বরাদ্দ নামমাত্র, বরাদ্দ অর্থেরও অতি সামান্যই খরচ হয়েছে৷ কমিটির চেয়ারম্যান পিনাকি মিশ্র বলেছেন, ‘প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কোনও পরিকল্পনাই করা হয়নি৷ প্রকল্পের খরচের বিষয়টিও আগে ভাবা হয়নি৷’

সরকার ঘোষণা করেছিল, ২০২২ সালের মধ্যে সমস্ত গৃহহীন লোক ঘর পাবেন৷ চার বছর অতিক্রান্ত৷ প্রকল্পের হাল কী?

প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা দরিদ্রদের জন্য আবাসন প্রকল্প– এতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি৷ শহরে ৪০.৬ লক্ষ বাড়ি তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল৷ তার ৯২ শতাংশ কাজই এখনও হয়নি৷ গ্রামীণ এলাকায় ৯৫.৪ লাখ বাড়ি তৈরির কথা ছিল, তার ৭০ শতাংশ কাজ এখনও বাকি৷ স্বাভাবিকভাবেই বরাদ্দ ১৫০ কোটি ডলারের মধ্যে খরচ হয়েছে ৩২ কোটিরও কম৷

প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে ১০টি সমাজকল্যাণ মূলক প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন৷ এর মধ্যেই ছিল প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা সহ স্মার্ট সিটি মিশন, ওয়ান র্যাঙ্ক ওয়ান পেনশন স্কিম, স্কিল ইন্ডিয়া, অটল পেনশন যোজনা, দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রাম জ্যোতি যোজনা, ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রোগ্রাম, প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনা, প্রধানমন্ত্রী জীবন জ্যোতি বিমা যোজনা, অটল মিশন ফর রিজুভেনেশন অ্যান্ড আরবান ট্রান্সফরমেশন ইত্যাদি প্রকল্প৷ সব গালভরা নাম৷ এর মধ্যে স্মার্ট সিটি প্রকল্পে তড়িঘড়ি ৯৮টি শহর চিহ্ণিত হয়ে গেল, বরাদ্দ ঘোষণা করা হল ৯ হাজার কোটি টাকা৷ চার বছরে খরচ হয়েছে সাকুল্যে মাত্র ১৬৮ কোটি টাকা৷ দীনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনায় শহরের দরিদ্রদের দক্ষতার প্রশিক্ষণের জন্য ২৩.৩ কোটি ডলার বরাদ্দ হয়েছিল, খরচ হয়েছে ১৩ কোটি ডলার৷ এই যে খরচের হিসাব দেখানো হয়, তার কতটুকু কাজে লাগে আর কতটাই বা শাসক দলের নেতা–মন্ত্রী–কন্ট্রাক্টর পকেটে যায়, তা জনগণ দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জানেন৷

স্বচ্ছ ভারত অভিযান, জনধন যোজনা, বেটি বাঁচাও–বেটি পড়াও–এর মতো ঘোষিত প্রকল্পগুলিও মুখ ধুবড়ে পড়েছে৷ পরিষ্কার রাস্তাঘাট ও শৌচাগার নির্মাণের জন্য স্বচ্ছ ভারত অভিযানে বরাদ্দ হয়েছিল ৮৯.৯ কোটি ডলার, খরচ হয়েছে ৩৪.১ কোটি ডলার৷ উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, যা নাকি সমাজেরপ্রান্তিক  মানুষের জন্য, সেই প্রকল্প নিয়ে চলছে সরকারের চূড়ান্ত অপদার্থতা ও দুর্নীতি৷ এই প্রকল্পের ছিটেফোঁটা সুবিধাটুকুও কে পাবে, তা ঠিক হয় কারা শাসক দলের আস্থাভাজন তা দিয়ে৷

যদি সমাজের দরিদ্র মানুষের জীবনমানের কিছুমাত্র উন্নয়ন দেখা যেত, তাহলে বোঝা যেত এই প্রকল্পগুলি সত্যই মানুষের উপকারে লাগছে৷ কিন্তু চিত্রটা ঠিক উল্টো৷ দরিদ্র মানুষের সংখ্যার গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী৷ অথচ বিপুল অর্থব্যয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হচ্ছে মানুষের ‘উন্নয়ন’–এর কাল্পনিক চিত্রকে৷ ক্ষমতায় বসার এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ২০১৪–১৫ সালে মোদি সরকার শুধু বিজ্ঞাপনেই খরচ করেছে ৮৬৪ কোটি টাকার বেশি৷ উন্নয়নে সরকার কতটা আন্তরিক, তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি? কাজের কাজ কিছু হোক না হোক, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তরজা চলছে, কে কত বেশি গরিবদরদি তা নিয়ে৷

একটা সরকারের কাজ কী, এই মৌলিক প্রশ্নটাই গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ দেশের সমস্ত নাগরিকের জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের অধিকার সুনিশ্চিত করা একটা সরকারের দায়িত্ব৷ এগুলি সরকারের দয়ার দান নয়, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা৷ কিন্তু তা তো দিচ্ছে না কোনও সরকারই, উপরন্তু দয়া–দাক্ষিণ্যের নাম করে ছিটেফোঁটা কিছু বরাদ্দ করে, এমনকী তার বাস্তবায়ন না করেও নাম কেনার চেষ্টা করছে৷

সরকার যদি সত্যিকারের কাজের কাজ কিছু করত, তাহলে মানুষের মন জয়ে প্রচারের ঝড় তুলতে হত না৷ পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী ধুরন্ধর এই সরকারি দলগুলি জানে ভোটে জিততে শ্রমিক–খেটে খাওয়া মানুষের সমর্থনও চাই৷ তাই চলছে প্রচারের ঢাকে আওয়াজ তোলার প্রতিযোগিতা৷

 

70 Year 34 Issue13 April, 2018