উন্নয়নের ফাঁপা বুলিতে ভুলবেন না

নির্বাচন ঘোষণা হতে না হতেই শাসক দলগুলির নেতারা সব নানা পসরা নিয়ে ময়দানে হাজির। কেউ পরিবর্তনের কথা বলছেন তো কেউ উন্নয়নের। নানা নাম তাঁদের। পতাকার রঙ আলাদা, দলের নাম আলাদা। কিন্তু সবার মুখে শুধুই উন্নয়নের কথা। নির্বাচন এই প্রথম নয়। এর আগে অনেক নির্বাচন হয়েছে। তাতে এই দলগুলিই তো জিতেছে। এরাই তো সব কখনও না কখনও কোথাও না কোথাও সরকারে থেকেছে, এখনও আছে। এরা যদি ‘উন্নয়নের’ এত বড় কাণ্ডারি, তবে জনজীবনের হাল এতদিনেও পাল্টায়নি কেন? কেন তবে তাদের জীবনে দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে? তা হলে যে উন্নয়নের কথা এই সব শাসক দলের নেতারা সর্বক্ষণ আউড়ে চলেছেন তা কার উন্নয়ন? আর পরিবর্তন বলতে কি এই সব নেতারা মানুষের জীবনের দুরবস্থার পরিবর্তন বোঝাচ্ছেন? তবে সে পরিবর্তন স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরেও হল না কেন? আসলে এঁরা যে পরিবর্তনের কথা বলছেন তা কেবল সরকারের পরিবর্তন। তার সাথে জনগণের দুরবস্থার পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে কি?

উন্নয়ন কাকে বলে

উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়? উন্নয়ন মানে দেশের মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা এবং সকলের জন্য উন্নত জীবনধারণের উপযুক্ত রোজগারের সুব্যবস্থা। দেশের উন্নয়ন মানে তো দেশের মানুষের উন্নয়ন! অর্থনীতির বিকাশ মানে তো দেশের মানুষের আর্থিক ক্ষমতার বিকাশ! এই সব দলগুলির রাজত্বে কি তাই হচ্ছে? উন্নয়ন হচ্ছে মানে তো দেশের কর্মক্ষম সব মানুষের কাজের ব্যবস্থা হওয়া। উন্নয়নের মানে তো জিনিসপত্রের দাম এমন হওয়া যাতে সব মানুষ তা কিনতে পারে। উন্নয়ন মানে তো যখন তখন ছাঁটাই বন্ধ হওয়া, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত হওয়া। উন্নয়ন মানে নারীর মর্যাদা এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হওয়া, প্রতিটি শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশের ব্যবস্থা হওয়া, বিনা খরচে প্রতিটি ছেলেমেয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া। উন্নয়ন মানে তো রোগের চিকিৎসা প্রত্যেকের আয়ত্তের মধ্যে আসা। উন্নয়ন মানে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া। উন্নয়ন মানে প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার থাকা, দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করা। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি মানুষের আর্থিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশে কোনও বাধা না থাকা। বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেস সিপিএম প্রভৃতি দলগুলির নেতারা যে উন্নয়নের বুলি বরাবরের মতো আবারও মানুষের সামনে আওড়াচ্ছেন, তা কি এই উন্নয়ন? তা হলে তাদের সরকারের শাসনে এই উন্নয়ন তো হওয়ার কথা। দেশের কোথাও তা হয়েছে কি?

বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএমের মুখে উন্নয়ন আর পরিবর্তনের বুলি

সবার মনে আছে, এ রাজ্যে মানুষ যখন সিপিএমের দীর্ঘ অপশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম সহ রাজ্যজুড়ে কৃষক আন্দোলন-গণআন্দোলন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে তখন পরিবর্তনের স্লোগান তুলে ক্ষমতায় বসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। যদিও সিপিএম শাসনের প্রথম দু’দশক তৃণমূলের অস্তিত্বই ছিল না। সিপিএম পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সরকার চালাতে গিয়ে একের পর এক যে সব জনবিরোধী নীতি নিয়েছে তার বিরুদ্ধে লাগাতার গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে একমাত্র এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি, জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি, বাসের ভাড়াবৃদ্ধি, প্রাথমিক স্তর থেকে পাশ-ফেল তুলে দেওয়া, শিক্ষা-স্বাস্থে্যর বেসরকারিকরণ প্রভৃতি প্রতিটি বিষয় নিয়েই প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করেছে এই দল। মূল্যবৃদ্ধি-ভাড়াবৃদ্ধি আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ১৯৮৩ এবং ১৯৯০ সালে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন কমরেড হাবুল রজক, শোভারাম মোদক এবং কমরেড মাধাই হালদার। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও শতাধিক কর্মী। শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগণায় সিপিএম মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন দেড়শোর বেশি এসইউসিআই(সি) দলের নেতা-কর্মী। মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন কয়েক শত। ইংরেজি তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে ‘৯৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অভূতপূর্ব বাংলা বনধ হয়েছে। যার ফল হিসাবে ইংরেজি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল সিপিএম সরকার। পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সরকার চালাতে চালাতে একসময়ে তারা টাটা-সালিমের মতো কর্পোরেট পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষায় হাজার হাজার একর উর্বর কৃষিজমি তাদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন গড়ে তোলে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। দু’জায়গাতেই গড়ে ওঠে গণকমিটি। কমিটির নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে। পরে সেই আন্দোলনে যোগ দেয় তৃণমূল কংগ্রেস। সিপিএমের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রবল গণবিক্ষোভ যাতে সঠিক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ না হয় তার জন্য বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম শুধুমাত্র তৃণমূলকেই প্রচার দিতে থাকে। তৃণমূল নেত্রীকে ‘অগ্নিকন্যা’ উপাধিতে ভূষিত করে। অথচ তৃণমূল নেত্রী যদি সিঙ্গুর থেকে আন্দোলনকে ধর্মতলার অনশন মঞ্চে তুলে না নিয়ে যেতেন তবে সিঙ্গুরে সিপিএম সরকার কৃষকদের জমি দখল করতে পারত না। নন্দীগ্রামে তৃণমূল নেত্রীর কোনও ভূমিকাই ছিল না। স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্ব মেনে আন্দোলন চালানোয় সরকার শেষ পর্যন্ত পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলন ভাঙতে সিপিএম শুধু পুলিশ ও দলের গুন্ডাবাহিনী দিয়ে গণহত্যাই চালায়নি, গণধর্ষণ চালিয়েছিল। একটা সরকারের নেতৃত্বে সংগঠিতভাবে গণধর্ষণ এর আগে হয়নি। সেই পরিস্থিতিতে জনগণের দাবি মেনে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) ডাক দেয় ‘সিপিএম সরকারকে পরাস্ত করুন’। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সিপিএমকে মার্কসবাদী হিসাবে দেখিয়ে তৃণমূল ও বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম মার্কসবাদ ও কমিউনিজম বিরোধী যে প্রচার চালাতে পারত তাতে লাগাম পরানো। তৃণমূল সরকার গঠন করার পর আমন্ত্রণ জানালেও এস ইউ সি আই-সি তাতে যোগ দেয়নি। এস ইউ সি আই-সি জানিয়ে দেয়, এই সরকার সোনার বাংলা গড়বে না। সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি কিছুটা দূর করতে পারে, গণআন্দোলনকে পুলিশি সন্ত্রাস থেকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী নই। বাস্তবেও জনজীবনে পরিবর্তন আনার পরিবর্তে এই সরকার প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে ৩৪ বছর ধরে সিপিএম সরকারের শাসন যে কালা ইতিহাস রেখে গেছে সেই পথেই চলছে। চুরি-দুর্নীতি-তোলাবাজি-স্বজনপোষণ, জনগণের পরিবর্তে পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখা, পুলিশ-প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার, সন্ত্রাস তৈরি করে অন্যদের ভোটে দাঁড়াতে না দেওয়া প্রভৃতি সবই একই রকম চলছে। ফলে এই সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষের ক্ষোভও ক্রমাগত বাড়ছে।

এস ইউ সি আই (সি) এই সরকারের জনবিরোধী নানা পদক্ষেপ এবং চুরি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ২০১৫ সালে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচারে দলের দুই কর্মীর চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়াও দলের নেতৃত্বে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল, পুরস্বাস্থ্যকর্মী সহ নানা স্কিম ওয়ার্কাররা আন্দোলন করে বহু দাবি আদায় করেছে। বিদ্যুতের মাশুল কমানো ও ছোট কৃষককে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন চলছে। ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠন নানা দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।

বিজেপির পরিবর্তনের ডাক নিছকই সরকার পরিবর্তনের জন্য

রাজ্যের জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে এ বার মাঠে নেমে পড়েছে বিজেপি। তাদের চটকদার স্লোগান– ‘আসল পরিবর্তন’। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের এই পরিবর্তন মানে শুধুই সরকারের পরিবর্তন। বিজেপি এখন এ দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণির সবচেয়ে বিশ্বস্ত দল। ২০১৪ সালে কেন্দে্র ক্ষমতায় বসার পর থেকে পুঁজিপতিদের স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে একের পর এক নীতি ও পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে বিজেপি। বিজেপির পুঁজিবাদী নীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আজ আকাশ ছুঁয়েছে। তেল-গ্যাস-কেরোসিন থেকে ভরতুকি তুলে নেওয়ায় এসবের দাম বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের জীবন ক্রমাগত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আম্বানি-আদানি সহ একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা এগুলি থেকে যথেচ্ছ মুনাফা করে চলেছে এবং বিজেপি সরকার তারই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। করোনা মহামারির সময়ে যখন লক্ষ শ্রমিক হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটছে, কাজ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ঘরে ফিরছে তখন দেশের একচেটিয়া পুঁজির মালিকেরা ৩৫ শতাংশ মুনাফা বাড়িয়েছে। এই সরকার লকডাউনে কাজ হারানো মানুষের জন্য যখন বরাদ্দ রেশনটুকু বন্ধ করে দিল, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আর একটি সংসদ ভবনের শিলান্যাস করলেন। বিজেপির পরিবর্তনে এগুলি পরিবর্তনের কোনও উল্লেখ নেই।

বিজেপি সরকার যে নতুন কৃষি নীতি নিয়ে এসেছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য গোটা কৃষিব্যবস্থাটিকে আম্বানি-আদানিদের মতো কৃষিপণ্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া। কৃষকদের সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেওয়া। ধীরে ধীরে জমি কেড়ে নিয়ে তাদের কোম্পানির মজুরে পরিণত করে দেওয়া। রাজধানী দিল্লির প্রান্তে সারা দেশের কৃষকরা এই নীতির প্রতিবাদে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। দিল্লির প্রবল ঠাণ্ডা এবং অন্যান্য কারণে ইতিমধ্যেই প্রায় ২৬০ জন কৃষক শহিদ হয়েছেন। চরম অগণতান্ত্রিক বিজেপি সরকার মামুলি কিছু বৈঠক ছাড়া কৃষকদের দাবির প্রতি কোনও মর্যাদাই দেখায়নি।

নতুন শিক্ষানীতিতে পুরোপুরি বেসরকারিকরণ করে শিক্ষাকে ব্যবসার পণ্যে পরিণত করেছে এই সরকার। এই নীতি কার্যকর হলে সাধারণ পরিবারের সন্তানরা শিক্ষার সুযোগ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হবে। এই নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা তীব্র প্রতিবাদ করেছেন এবং এই আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।

বিজেপি সরকার চরম অগণতান্ত্রিক ভাবে মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকেই কেড়ে নিচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে দেগে দিয়ে প্রতিবাদীদের জেলে পুরছে। ভারতের দীর্ঘ দিনের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে ধ্বংস করে সংখ্যালঘু বিদ্বেষকে প্রকাশ্যে মদত দিচ্ছে।

বিজেপি এ দেশে নবজাগরণের চিন্তাকে অস্বীকার করে মানুষকে প্রাচীন যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা, যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসারের পরিবর্তে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে বাড়িয়ে তুলতে চায়। মানুষের মধ্যে ধর্মান্ধতা জাগিয়ে তুলতে পারলে পুঁজিবাদের বিশ্বস্ত ম্যানেজার হিসেবে পুঁজিবাদের সঙ্কটকে জনগণের চোখ থেকে আড়াল করতে পারবে তারা। কেন দারিদ্র? কেন অনাহার-অর্ধাহার? চাকরি নেই কেন? শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ নেই কেন? অদৃষ্ট, কপাল। ঈশ্বরকে ডাকো, পরের জন্মে সব পাবে। মানুষকে এ কথা বোঝাতে পারলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যা থেকেই মানুষের জীবনের সব সঙ্কটের জন্ম, তাকে শোষিত মানুষের বিক্ষোভ-বিদ্রোহের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। সেই কাজটিই এ দেশে বিজেপি করে চলেছে। জার্মানিতে একদিন হিটলার ঠিক এই কাজটিই করেছিল।

বিজেপি গোটা স্বদেশি আন্দোলনেরই বিরোধী। দেশের মানুষ যখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জীবন পণ করে লড়াই করেছে, আন্দোলন করে জেলে গেছে, অত্যাচার সহ্য করেছে, ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছে, তখন বিজেপির পূর্বসূরিরা ব্রিটিশের পরিবর্তে মুসলমানদেরই দেশের প্রধান শত্রু হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে এবং ব্রিটিশকে সব দিক থেকে সহযোগিতা করেছে। তারা এমনও বলেছে, যারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা আসলে প্রতিক্রিয়াশীল।

বিজেপি মুখে হিন্দুত্বের কথা বললেও বাস্তবে ধর্মীয় নেতাদেরও মানে না। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের কোনও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছিল না। রামকৃষ্ণ মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়েছেন, চার্চে গিয়েছেন। বিবেকানন্দ বলেছেন, একই সঙ্গে আমি মুসলমান, আমার স্ত্রী খ্রিস্টান, ছেলে বৌদ্ধ হতে পারে। বিবেকানন্দ গোহত্যা নিবারণী সমিতির সদস্যদের আগে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে বাঁচানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। অথচ বিজেপি গোরক্ষার নামে মুসলিমদের খুন করছে। ধর্মের নামে উস্কানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাচ্ছে।

ফলে বিজেপিকে সমর্থন করা মানে গোটা নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকেই অস্বীকার করা। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজিদের অস্বীকার করা। কারণ এঁদের চিন্তা ও নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী বিজেপির নীতি ও চিন্তা।

সিপিএমের অ-বাম ভূমিকা

বিজেপির ফ্যাসিস্ট নীতির বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এসইউসিআই-কমিউনিস্টের সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটকে চিঠি দেন। তার ভিত্তিতে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ভাবে ৬টি বামপন্থী দলের জোট গড়ে ওঠে। জোটের পক্ষ থেকে আমরা দেশজোড়া জঙ্গি বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। কিন্তু সিপিএম ডেপুটেশন, অবস্থানের বাইরে আর কোনও আন্দোলনে আসতে চায় না। অন্য দিকে কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে। আমরা এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্বস্ত দল কংগ্রেসের সাথে এই ঘনিষ্ঠতার বিরোধিতা করি। হঠাৎই দেখা যায়, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার প্রশ্নে তাঁরা এসইউসিআই(সি)-কে বাদ দিয়ে বিবৃতি দিল।

পশ্চিমবাংলা এবং ত্রিপুরায় ক্ষমতা হারানোর পর সংসদীয় রাজনীতিতে সিপিএমের অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেয়। এরপরই যে কোনও ভাবে হোক এমএলএ-এমপি বাড়ানোর তাগিদে তারা কংগ্রেসের সাথে জোট ঘোষণা করে। এস ইউ সি আই-সির সঙ্গে জোটে থাকলে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে যাওয়া যেত না। তাই তারা কোনও রকম রীতি-নীতি-শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করেই ছ’পার্টির জোট ভেঙে দেয়।

সাম্প্রদায়িক জোট

ভোট রাজনীতি সিপিএমকে আজ এত নিচে নামিয়েছে যে, বামপন্থার কোনও তোয়াক্কা না করে কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম মৌলবাদী আব্বাস সিদ্দিকির নতুন গড়ে ওঠা দলের সঙ্গেও জোট গড়ে তুলতে এতটুকু বাধল না। সিপিএম এ রাজ্যে ৩৪ বছরের শাসনে গণআন্দোলনের রাস্তা শুধু ত্যাগ করেছিল তাই নয়, গণআন্দোলনকে পুঁজিবাদী কায়দাতেই দমন করেছিল। ফলে গণআন্দোলনের পথে মানুষের আস্থা অর্জন করে মানুষের সমর্থন আদায়ের ক্ষমতা তারা হারিয়েছে। তাই শুধুমাত্র সংখ্যালঘু ভোটের লোভে তারা এমন একটি ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির সাথে সামিল হয়ে গেল। আশার কথা, দলের নিচের তলায় যাঁদের মধ্যে এখনও কিছুটা বামপন্থার চর্চা রয়েছে, তাঁরা এই নীতিহীন জোটের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করছে। শিক্ষিত যুক্তিবাদী মানুষ মাত্রেই এই জোটের তীব্র নিন্দা করছেন। এই অবস্থায় দলের নেতারা জোটের পক্ষে সাফাই গাইতে প্রতিদিন গণশক্তিতে লম্বা লম্বা নিবন্ধ লিখে জোটের যৌক্তিকতা ব্যাখা করছেন। মার্কস-লেনিনের লেখার এখান ওখান থেকে উদ্ধৃতি তুলে এনে প্রমাণ করতে চাইছেন তাঁদের এই আচরণ মার্কসবাদসম্মত। এই ভাবে বারে বারেই তাঁরা তাঁদের নীতিহীন আচরণের দ্বারা মার্কবাদকে কলঙ্কিত করেছেন এবং মানুষের চোখে তাকে হেয় করেছেন।

অন্য দিকে এই সাম্প্রদায়িক জোটের দ্বারা তাঁরা সংখ্যালঘু মৌলবাদকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিচ্ছেন, যার ফলে পাল্টা হিন্দু মৌলবাদও শক্তিশালী হবে। এর মূল্য শুধু তাঁদের দলকেই দিতে হবে না, এ রাজ্যের মানুষকেও দিতে হবে কড়ায়-গণ্ডায়। এর ফলে সিপিএমের যুক্তিহীন, গোঁড়া কর্মী-সমর্থক অংশটি পার্টি-নেতৃত্বের সিদ্ধান্তকে বিনা তর্কে, বিনা বিচারে মেনে নিয়ে তার পক্ষে যুক্তি করতে থাকবে। পাশাপাশি তাদের সমর্থকদের একটি অংশও এর দ্বারা প্রভাবিত হবে। অথচ এ রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষেরা তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলিকে কখনওই বিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁদের গোষ্ঠীর সমস্যা হিসাবে দেখেননি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের সমস্যা হিসাবেই দেখেছেন এবং তার সমাধানও গণতান্ত্রিক পথে, গণআন্দোলনের পথেই করার চেষ্টা করেছেন। সেই অবস্থান থেকে সিপিএম নেতারা ভোটরাজনীতির সংঙ্কীর্ণ স্বার্থে তাঁদের একটি অংশকে হলেও সরিয়ে আনলেন। এর দ্বারা রাজ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সিংহদরজা তাঁরা খুলে দিলেন।

কংগ্রেস মুখে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও কখনওই এই নীতি অনুসরণ কর়েনি। তার ফল হিসাবে কংগ্রেস স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুধু মুসলমানদেরই সরিয়ে দেয়নি, নেতৃত্বের মধ্যে উচ্চবর্ণের মানসিকতা থাকায় তা নিম্নবর্ণের মানুষদের সমাজের মূল ধারার সাথে যুক্ত হতে দেয়নি। এরই ফল দেশবিভাগ। স্বাধীন ভারতেও কংগ্রেস সঙ্কীর্ণ ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির স্বার্থে বিহারের ভাগলপুরে দাঙ্গা ঘটিয়েছে, এ কারণেই আসামের নেলিতে সংখ্যালঘু গণহত্যা হয়েছে, দিল্লিতে শিখ গণহত্যা হয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী সঙ্কীর্ণ ভোট রাজনীতির স্বার্থে হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের লোভে রামমন্দিরের তালা খুলে দিয়েছিলেন। সেই রামমন্দির রাজনীতিকে পুঁজি করেই বিজেপির আজকের এই রমরমা। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রাম এবং গণআন্দোলন গড়ে তুলতে বামপন্থী ঐক্য গড়ে তোলার পরিবর্তে কংগ্রেসকেই লড়াইয়ের সাথী করেছে সিপিএম। এর থেকেই স্পষ্ট বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে কেমন লড়াই তাঁরা লড়তে চান।

বিজেপির বিরুদ্ধে সিপিএমের লড়াইটা কতখানি মেকি তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় তাদের ‘আগে রাম পরে বাম’ স্লোগানে। অর্থাৎ বিজেপিকে সমর্থন করে আগে তৃণমূলকে হারাও, তারপর বিজেপিকে হারিয়ে সিপিএম ক্ষমতায় ফিরবে। এই নীতিতেই গত লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের সমর্থনে বিজেপি রাজ্যে ১৮টি আসনে জয়ী হয়। শুধু দলে দলে কর্মী-সমর্থকরাই নয়, নেতারাও সব গিয়ে বিজেপিতে ভিড়তে থাকেন। সিপিএমের সমর্থন এক ধাক্কায় তলানিতে এসে ঠেকে। সেই সিপিএম এখন ভোট বাড়াতে মুসলিম মৌলবাদের সমর্থন নিচ্ছে।

বাস্তবে নামের পাশে মার্কসবাদী থাকলেও এই দলটিতে যথার্থ মার্কসবাদের চর্চা কোনও দিনই হয়নি। যতদিন তারা বিরোধী অবস্থানে ছিল ততদিন গণআন্দোলনের মধ্যে কিছুটা থাকলেও এ রাজ্যে ‘৭৭ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর গণআন্দোলনকে পুরোপুরি ত্যাগ করে অন্য পাঁচটি শাসক দলের মতোই একটি সংসদীয় শাসক দলে পরিণত হয়ে যায় সিপিএম। সমাজ পরিবর্তন, গণআন্দোলনের পরিবর্তে এমএলএ, এমপি, ক্ষমতা, গদিতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। সরকারি গদি দখলই হয়ে যায় গোটা দলের একমাত্র লক্ষ্য। যে করে হোক, প্রয়োজনে নীতিহীন পথেও ভোটে জিতে ক্ষমতা দখল করাই হয়ে যায় একমাত্র লক্ষ্য। বিহারে আরজেডি, তামিলনাড়ূতে ডিএমকে এবং নানা রাজ্যে জাতপাতবাদী দলগুলির সাথে জোট গড়ে তুলতে তাদের অসুবিধা হয়নি। আজও তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সাম্প্রদায়িক কংগ্রেস কিংবা আইএসএফের সঙ্গে জোট গড়ে তোলা একই উদ্দেশ্যে। এর সঙ্গে জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই, বামপন্থার কোনও সম্পর্ক নেই।

শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের স্বার্থে

গণআন্দোলনের নেতৃত্বে একা এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)

এই অবস্থায় এসইউসিআই-কমিউনিস্ট একাই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনগুলি সংগঠিত করে চলেছে। এই গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই এ রাজ্যের নির্বাচনে একাই ১৯৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। একটি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টির কাছে নির্বাচনও একটি গণআন্দোলন। শ্রেণি সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এই দল নির্বাচনে অংশ নেয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শিক্ষা অনুযায়ী এসইউসিআই-কমিউনিস্ট জানে, পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় সমাজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি ও শোষিত সর্বহারা শ্রেণি। ফলে দুই শ্রেণির একই দল হতে পারে না। দল মানেই শ্রেণি দল। হয় পুঁজিপতি শ্রেণির দল, না হয় শোষিত শ্রেণির দল। অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে আমাদের দেশের ভোটবাজ দলগুলি সবই শাসক শ্রেণির দল– তা তার পতাকার রঙ তেরঙা, লাল বা গেরুয়া যা-ই হোক না কেন। তা হলে শোষিত শ্রেণির দল কোনটি?

পুঁজিপতি শ্রেণির দল অনেকগুলি থাকলেও শোষিত শ্রেণির দল একটিই– ভারতের বুকে তা একমাত্র এসইউসিআই-কমিউনিস্ট। শোষিত শ্রেণির দল বলেই সে জানে পুঁজিবাদী এই শাসন কাঠামোকে টিকিয়ে রেখে নির্বাচনের দ্বারা শুধুমাত্র সরকার পাল্টে শোষিত মানুষের দুরবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। তা হলে এসইউসিআই-কমিউনিস্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কেন? করে তার কারণ, মার্কসবাদ লেনিনবাদের এই মূল্যবান শিক্ষাটি সম্পর্কে কমিউনিস্টরা সচেতন হলেও জনগণের, শ্রমিক শ্রেণির পার্লামেন্ট তথা নির্বাচন সম্পর্কে এখনও মোহমুক্তি ঘটেনি। লেনিন বলেছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পাঁচ বছর অন্তর বুর্জোয়ারা যে নির্বাচন করে তার উদ্দেশ্য, বুর্জোয়া শ্রেণির গোলাম হিসাবে, ম্যানেজার হিসাবে কারা কাজ করবে তা নির্ধারণ করা। এ সত্তে্বও কেন বিপ্লবীরা নির্বাচনে নামে? এর উদ্দেশ্য জনগণের সঙ্গে থেকে জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করা, পার্লামেন্টোরি তথা নির্বাচনী মোহ থেকে মুক্ত করা, বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করা। এই উদ্দেশ্য নিয়েই বিপ্লবীরা নির্বাচনে অংশ নেয়।

নির্বাচনে বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি

মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ বলেছেন, নির্বাচন হল একটা বুর্জোয়া রাজনীতি। জনগণের রাজনৈতিক চেতনা না থাকলে, শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম এবং সংগঠন না থাকলে, গণআন্দোলন না থাকলে, জনগণের সচেতন সংঘবদ্ধ শক্তি না থাকলে বড় বড় শিল্পপতিরা, প্রতিক্রিয়াশীলরা, বিপুল টাকা ঢেলে এবং সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে নির্বাচনের পক্ষে যে হাওয়া তোলে, যে আবহাওয়া তৈরি করে, জনগণ উলুখাগড়ার মতো সেই দিকে ভেসে যায়। তিনি বলছেন, যতদিন বিপ্লব না হয়, জনগণ ইলেকশন চাক বা না চাক, পছন্দ করুক আর নাই করুক, ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, জনগণকে নির্বাচনে টেনে আনা হয়। জনতাও এসে যায়। তিনি বলছেন, বিপ্লব মানে হল, যখন জনতা বুঝে ফেলেছে, নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা নেই, যখন সকলে এই চেতনার ভিত্তিতে সংগঠিত হয়ে গেছে এবং সচেতন ভাবে সংগঠিত হয়ে নির্বাচন বয়কট করছে। এই বয়কটটাও নেগেটিভলি নয়, পজিটিভলি। অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থান করার জায়গায় সে চলে গেছে, যখন সে বলে, না নির্বাচন নয় এবং সংগঠিত ভাবে ক্ষমতা দখলের জায়গায় চলে যায় তখনই নির্বাচন অকার্যকরী হয়ে যায়। না হলে নির্বাচনে জনতা বারবার ফেঁসে যায়, আর জনতার সঙ্গে থাকার জন্যই বিপ্লবীদের নির্বাচনে যেতে হয়।

নির্বাচনে বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি

নির্বাচনে বিপ্লবীদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে? সেটা কি বুর্জোয়া দলগুলোর মতোই? যে করে হোক যত বেশি সিট দখল করা? কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা হল, জনগণকে একটা বিপ্লবী গণসংগ্রামের (মাস-রেভোলিউশনারি) লাইনের ভিত্তিতে নির্বাচনে লড়াই করতে শেখানোটাই বিপ্লবীদের কাজ। তিনি বলছেন, এটা করতে গিয়ে যদি সবচেয়ে বেশি সিট পাই পাব, যদি একটাও সিট না পাই না পাব। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্যটা কখনওই যে-কোনও প্রকারে কতকগুলি সিট দখল করা নয়। বুর্জোয়া দলগুলি যে ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে, যে ভাবে সিট দখল করে বিপ্লবীরা সেভাবে নির্বাচনে লড়াই করতে পারে না। এতে বিপ্লবী থাকা যায় না। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডও এগোয় না। এর দ্বারা বুর্জোয়া রাজনীতির ভণ্ডামিটাকেও উন্মোচিত করা যায় না। এ কথাটা মুখে বলা আর কাজে করাটা এক জিনিস নয়। কারা এটা শুধু মুখে বলছে, আর কারা এটা কার্যকরী করছে সেটা জনগণকে বুঝিয়ে সচেতন করাই বিপ্লবীদের কাজ। এসইউসিআই-কমিউনিস্ট এই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

জনগণের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে গণআন্দোলনের একমাত্র শক্তি যে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) এ বিষয়টি এ রাজ্যের মানুষের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু তাঁরা বলেন, তোমরা ভাল, কিন্তু নির্বাচনে জিতবে না। তা হলে কে জিতবে? নিশ্চয় যারা মন্দ। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ, যে হাজারটা সমস্যায় জর্জরিত, তার সেই সমস্যাগুলো নিয়ে লড়াই করছে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)। তা হলে সব জেনেও একটা মন্দ দলকে মানুষ ভোট দেবে কেন, তাদের জেতাবে কেন? প্রতিবার মানুষ ভোট দেয়, আর জেতে এই সব মন্দ, দুর্নীতিগ্রস্ত, নীতিহীন, মালিকদের গোলাম দলগুলো। জনগণ জেতে কি? বুর্জোয়াদের টাকার থলি এবং তাদের পরিচালিত মিডিয়া হাওয়া তুলে দেয় কে জিতবে, কে সরকার গড়বে? কিন্তু তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কীসের মাথাব্যথা? দেশে কি এইটাই সমস্যা যে, দেশে কোনও সরকার নেই? সরকার তো আছেই। একটা সরকার যায়, আর একটা সরকার আসে। সব সরকারই যে নীতি নেয়, যে আইন নিয়ে আসে সব সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তারা ক্ষমতায় বসে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়, নিত্য-নতুন কর বসায়, সরকারি সম্পত্তি বেচে দেয়। তা হলে সেই সরকারে কে বসছে তা নিয়ে জনসাধারণের আগ্রহ থাকার কারণ কিছু আছে কি? আসল কথা হল, জনজীবনের সমস্যা কী, আর তা নিয়ে কে লড়াই করছে? সেই শক্তি কি একমাত্র এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) নয়? দেশের শ্রমিক-কৃষক-গরিব-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের যথার্থ বন্ধু আর কে আছে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) ছাড়া? নির্বাচনের মঞ্চে দাঁড়িয়েও এই দল পুঁজিবাদী রাজনীতির আসল রূপটাকে যে ভাবে তুলে ধরছে, তা কি আর কেউ সে ভাবে ধরছে? না, ধরছে না। ধরতে পারে না। কারণ তারা নিজেরাই অপরাধী।

আজ আরও একটি মর্মান্তিক বিষয়কে কেউ এড়িয়ে যেতে পারেন না যে, প্রতিটি পরিবারে ছেলে-মেয়েরা কী ভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অল্প বয়সেই যৌন-বিকৃতির শিকার হয়ে যাচ্ছে। মদ-ড্রাগে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এদের বাঁচানোর কথা কি কেউ ভাবছে? পুঁজিবাদী দলগুলি দেশের ছাত্র-যুবকদের নৈতিক চরিত্রকে ধসিয়ে দিচ্ছে, তাদের অসৎ করে তুলছে, তাদের নষ্ট করছে। টাকার বিনিময়ে তাদের ভোটের কাজে লাগাচ্ছে। ফলে তারা ঠিক-বেঠিক, ভাল-মন্দ বিচার করতে শিখছে না, তারা এই সব দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতাদের গোলাম হিসাবে কাজ করছে। এর বিরুদ্ধে কে লড়াই করছে? একমাত্র এসইউসিআই-কমিউনিস্ট। ছাত্র-যুবদের মধ্যে মূল্যবোধ-নীতিবোধ গড়ে তুলতে নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের মনীষীদের জীবন-সংগ্রামকে ছাত্র-যুবদের মধ্যে তুলে ধরছে একমাত্র এসইউসিআই (সি)। এসইউসিআই (সি)-কে সমর্থন মানে যেমন গণআন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি, তেমনই দেশের ছাত্র-যুবদের নৈতিক অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষার সংগ্রামের শক্তিবৃদ্ধি। ফলে এই সব ভোটবাজ দলগুলির মিথ্যা ফাঁপা বুলিতে না ভুলে জনগণের জীবনের সংগ্রামের সাথীকে চিনে নিতে হবে।

(গণদাবী-৭৩ বর্ষ ২৫ সংখ্যা_১২ মার্চ , ২০২১)