‘উন্নয়নের’ কোলাহল চাপা দিতে পারছে না একাকীত্বের বেদনা

আমাদের চারপাশে প্রচুর লোক৷ জনসমুদ্রের মধ্যে বাস করছি আমরা৷ আমাদের দেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ জনবহুল দেশগুলোর একটি৷ অথচ একাকীত্বের গভীর অসুখ আমাদের ক্রমশ গ্রাস করছে, ভয়ংকর একাকীত্ব হয়ে দাঁড়াচ্ছে আজকের দিনের এক বিরাট সমস্যা৷ অজস্র জলাশয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়েও একফোঁটা তেষ্টার জল না পাওয়ার মতোই অসহনীয় এই যন্ত্রণা৷

পরিবেশ–পরিস্থিতি–পরিসংখ্যান দেখে এমনটাই বলছেন মনোবিদ এবং চিকিৎসকরা৷ শপিং মল–হাইরাইজ–ফ্লাইওভার, উচ্চকিত কোলাহলে চাপা পড়ে যাওয়া ‘একা’ মানুষের আর্তনাদ মনে করিয়ে দিচ্ছে জীবনানন্দের সেই অনুভব– ‘সকল লোকের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা?’

একাকীত্বের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে বছর আঠেরোর সানা সারাদিন উদ্দেশ্যহীন ভাবে লোকাল ট্রেনে ঘুরে বেড়ায়৷ মুম্বই হোক বা দিল্লী, কোথাও গিয়েই সে শান্তি পায় না৷ শেষপর্যন্ত একলা ঘরের চৌহদ্দিতে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে আটকে ফেলে নিজেকে৷ কেউ কি আমার কথা বুঝবে? কেউ যদি আঘাত দিয়ে কথা বলে? কেউ যদি বিরক্ত হয়, বিরূপ মন্তব্য করে? এসব প্রশ্ন কুরে কুরে খায় আজকের কৈশোর, যৌবনকে৷ অজস্র মানুষের মধ্যে থেকেও তারা পাশের মানুষের সাথে কথা বলতে, বন্ধুত্ব করতে ভয় পায়৷ বাড়ি ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরের কলেজে পড়তে এসেছিল বছর কুড়ির তরুণ৷ সন্ধ্যে হলেই অসহায়তায় দম বন্ধ হয়ে আসত তার, কংক্রিটের খাঁচায় বন্দি মনে হত নিজেকে৷ তীব্র নাগরিক কোলাহলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভয়ংকরভাবে একা বোধ করত ছোট শহর ছেড়ে কর্মসূত্রে মুম্বই আসা অর্পিতাও৷ বছর পঁচিশের এই তরুণী কাজের জায়গাতেও ভরসা করার মতো কোনও বন্ধু খুঁজে পায়নি৷ তার অভিজ্ঞতায়– সবাই সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত, আর বাড়ি ফিরলেই আবার তুমি একা৷ আমরা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি, কিন্তু কাজের সময় পেরিয়ে গেলে কী করব আমরা জানি না৷ এমনকি আমাদের অনেকের কাছেই উইক এন্ড একটা ভয়ংকর জিনিস৷ কারণ সারাটা দিন কীভাবে সময় কাটাবো, কী করব আমরা বুঝতে পারি না৷ এই করুণ কাহিনী শুধু সানা, তরুণ বা অর্পিতার নয়৷ ভারতের একটি নামী মানসিক হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, সারাদিনে যত রোগী সেখানে আসেন তার একটা বড় অংশ একাকীত্বের অসুখে ভুগছেন৷ স্বজন পরিত্যক্ত অসুস্থ বয়স্ক মানুষই শুধু নন, নিঃসঙ্গতার এই অসুখ মারাত্মক ভাবে বাসা বাঁধছে নবীন প্রজন্মের মনেও৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফর্মেশন–এর সমীক্ষা জানাচ্ছে, একাকীত্বের আক্রমণ মধ্যবয়স বা প্রৌঢ়ত্বের তুলনায় বয়ঃসন্ধিতে বেশি৷ আঠেরো বছর বয়সের নাগরিকদের সত্তর শতাংশেরও বেশি একাকীত্বে ভোগেন৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে কাজ করা একটি মার্কিন সংস্থা সিগনা’র ২০১৮ র রিপোর্ট অনুযায়ী, আঠেরো থেকে বাইশ বছর এবং তেইশ থেকে সাঁইত্রিশ বছর বয়ঃসীমায় থাকা মানুষদের ক্ষেত্রে এর প্রকোপ বেশি৷ ভারতবর্ষেও এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে৷ সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অবসাদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, হৃদরোগ, স্নায়ুরোগের মতো অজস্র মানসিক ও শারীরিক ব্যাধি৷ অবস্থা এতটাই ভয়ানক যে, মাঝে মাঝে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হচ্ছেন বড বড নেতামন্ত্রীরা৷ ব্রিটেনে নব্বই লক্ষ একাকীত্বের অবসাদে আক্রান্ত লোকের কথা ভেবে সরকারকে তৈরি করতে হয়েছে ‘একাকীত্ব সংক্রান্ত মন্ত্রক’৷

কী কারণে ঊষর হয়ে উঠছে মানবিক সম্পর্কের জমি? ভালোবাসা–ভরসা–বিশ্বাস-বন্ধুত্ব এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কেন?  মনোবিদরা বলছেন, এই প্রজন্ম স্বাধীনতা চায়, শিক্ষা–চাকরি–বাসস্থান সব বিষয়ে আজ তারা মতামত দিচ্ছে৷ কিন্তু এগুলোকে সামলে চলার জন্য, সুস্থভাবে বাঁচার জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন, সেখানে থেকে যাচ্ছে বিরাট ফাঁক৷ এতটুকু বিরূপ মন্তব্য বা প্রতিকূলতা তাদের দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে, অপ্রিয় বাস্তব থেকে পালিয়ে বাঁচতে তারা ডুবে থাকছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়৷ কোচির এক প্রৌঢ়ার অভিজ্ঞতা– নবীন প্রজন্ম একা থাকতে ভালোবাসে, প্রাইভেসি চায়৷ কিন্তু সবার জীবনে এমন সময় আসে যখন তার অন্য মানুষের সাহায্য প্রয়োজন৷ কয়েকমাস আগে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, সেইসময় কাউকে পাশে পাইনি৷ এমন অসহায় মুহূর্তে কী করব আমরা?

মনে পড়ে যায় সাম্প্রতিক কালের একটি বাংলা ছবির দৃশ্য৷ ছবির নাম ‘শংকর মুদি’৷ নব্বই দশকে কলকাতার পুরনো পাড়া৷ চা দোকানের আড্ডা, মুদি দোকানের মাসকাবারি খাতা৷ রকের আড্ডা, পাড়াতুতো দাদা কাকু মাসি, এর বাডিতে ওর অবাধ আনাগোনা৷ পাডার এক প্রৌঢ় হঠাৎ অসুস্থ হলে রকের ছেলেরা ছুটে যায়, শংকর মুদি হাসপাতালে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসে তাকে৷ শেষ দৃশ্যে বৃষ্টির রাত৷ কয়েক বছরে অনেক পাল্টে গেছে পাড়া৷ এলাকায় ঝাঁ চকচকে শপিং মল হয়েছে, প্রায় উঠে যেতে বসা দোকানে ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে মরেছে শংকর মুদি৷ চায়ের আড্ডা ভেঙে গেছে৷ কাজের খোঁজে শহর ছেড়েছে কোনও অটো ড্রাইভার, বহু বাডিতে বুড়ো মা–বাবাকে ফেলে ‘সফল’ ছেলেরা ঘর বেঁধেছে ফরেনে৷ আবার গুরুতর অসুস্থ সেই ভদ্রলোক৷ জানলা খুলে আর্ত চিৎকার করছে মেয়ে– কেউ এসো, বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷ সাড়া মিলছে না৷ ভাঙা সেলুনের অ্যাসবেস্টসে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া কোনও স্বর বেঁচে নেই বিশ্বায়নের প্রসাদধন্য উন্নয়নে৷ একাকীত্ব, যন্ত্রণা, বিচ্ছিন্নতার মূলে আসল কারণ যে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা, সে প্রশ্নটি তুলে ধরার একটা চেষ্টা ছিল এই ছবিতে৷

আজ যারা এই একাকীত্বের অসুখ থেকে বাঁচতে আর বাঁচাতে চাই, অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণ চাই, তাদেরও বুঝতে হবে এই গোড়ার কথাটি৷ ক্রমবর্ধমান আর্থিক অনিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রের চাপ, নেট দুনিয়ায় সর্বক্ষণ নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার অসুখ, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, যৌথ পরিবার সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়া, সমস্ত সামাজিক–পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে কেরিয়ার গড়ার ইঁদুর দৌড়ে নাম লেখানো– এ সবই জন্ম নিচ্ছে সর্বোচ্চ মুনাফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই সমাজের গর্ভে৷ ধনতান্ত্রিক সমাজ শুধু মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারই কেড়ে নিচ্ছে না, তার মানসিক সুস্থতা, মানবিক সম্পর্কের বন্ধন, মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁডানোর স্বাভাবিক প্রবণতাকেও নষ্ট করে দিতে চাইছে৷ আর এগুলো সে করছে অত্যন্ত সুকৌশলে মানুষকে সমাজবিচ্ছিন্ন করার মধ্যে দিয়ে৷ ঐতিহাসিক কারণেই মানুষ একদিন যূথবদ্ধ হয়ে সমাজ গড়েছিল৷ আজ বিবর্তনের পথে সেই সমাজ যে পণ্যায়িত রূপ নিয়েছে, তা দাঁড়িয়েই আছে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের ওপর মুষ্টিমেয় মালিকের নির্মম শোষণের ওপর৷ এই শোষণ টিকিয়ে রাখতে হলে, সাধারণ মানুষের ঐক্য নষ্ট করতে হলে, নানা ভাবে নানা স্তরে মানুষে মানুষে দূরত্ব, অসহিষ্ণুতা, বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা এবং ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’র নামে চূড়ান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার আবর্তে মানুষকে ডুবিয়ে রাখা ছাড়া তার উপায় নেই৷ তাই আজ সবাইকে নিয়ে, সবাইকে ভালোবেসে এগোনোর পরিবর্তে যে কোনও উপায়ে অন্যকে পিছনে ঠেলে একা এগিয়ে যাওয়া হয়েছে জীবনের মূলমন্ত্র৷ সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য অর্থ উপার্জন নয়, যেন অর্থ উপার্জনের জন্যই জীবনধারণ৷ আজকের শৈশব কৈশোর যেন বেড়েই উঠছে ‘আমি আমার মতো’ নেশায়, তাই ‘আমি’র বাইরের যে জগত, নিজের গণ্ডির বাইরে অন্যের জন্য কিছু করার, ভাবার যে আনন্দ, সৃষ্টিশীল মনন– তা তাদের অধরা থেকে যাচ্ছে৷ বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির উন্নতি সমাজের সার্বিক উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত না হয়ে মানুষকে উদ্দেশ্যহীন রোবটে পরিণত করছে এবং মালিকের পকেট ভরাচ্ছে পুঁজিবাদের নিয়মেই৷ পরিণাম– দিনের পর দিন বেড়ে চলা দুঃসহ একাকীত্ব, অবসাদ, জীবনবিমুখতা৷

ব্যক্তিকে বুঝতে হবে, এ সমাজের মূল দ্বন্দ্ব ব্যক্তিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে না৷ শোষক ও শোষিত শ্রেণির দ্বন্দ্বই মূল৷ একে চিনে শোষিত শ্রেণির স্বার্থে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানোর সংগ্রামে অংশগ্রহণের দ্বারাই একজন ব্যক্তি একাকীত্ব থেকে রেহাই পেতে পারেন৷ এ কথাই বলেছেন এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১১ সংখ্যা)