Breaking News

উন্নয়নই বটে!

শহরের অসংখ্য এলাকার ফুটপাথে বহু মানুষ পেতে রয়েছেন প্রায়–সংসার৷ শ্যামবাজার রাজাবাজার শিয়ালদা বড়বাজার চাঁদনি ধর্মতলা পার্কস্ট্রিট থেকে শুরু করে পার্ক সার্কাস গড়িয়াহাট হাজরা রাসবিহারী টালিগঞ্জ যে–দিকেই চোখ যায় ফুটপাথে সে এক ভিন্ন পৃথিবী৷ সংসার যাঁদের পড়ে আছে গ্রাম–গঞ্জের প্রত্যন্ত প্রান্তে, জীবিকার তাড়নায় তাঁদেরও একটা অংশকে দিনের পর দিন রাতের রাজধানীর ফুটপাথে শুয়েই কাটাতে হয়, পরিবারটাকে বাঁচাতে৷ কলকাতা শহরে রাত দশটা–এগারোটার পর থেকেই দোকানপাটের আলো নিভে যেতে শুরু করে৷ তারপর বন্ধ হয় ঝাঁপ৷ হাজার হাজার ভাঙাচোরা চেহারার মানুষ সেই বন্ধ ঝাঁপগুলোর সামনের ফুটপাথে জড়ো হন একে একে৷ আনাচকানাচ খুঁজে ক্লান্ত বিষণ্ণ শরীরটাকে কয়েক ঘন্টার জন্য তাঁদের রেখে দিতে হয় চটের ওপর, বিজ্ঞাপনের ছেঁড়া ফ্লেক্সের ওপর, কাউকে বা সরাসরি ধুলোঝাড়া মাটির ওপরই৷ ব্যাস কয়েকটা ঘন্টার ব্যাপার৷ তারপর সূর্যের আলো ফোটবার বহু আগেই তাঁদের উঠে পড়তে হয়৷ সভ্যতাকে সচল রাখতে সেখান থেকে তাঁদের সরে যেতে হয়৷

কলকাতা পুরসভার প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, রাজধানীর ফুটপাথে স্থায়ী এবং অস্থায়ী মোট কত লোক আছে সেই সংখ্যাটা জানাও৷ পুরসভা সংখ্যা গুনতে গিয়ে জানতে পারল, ফুটপাতবাসীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে৷ কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে এবং অনুপ্রেরণায় ঘটে চলা লাগাতার ‘উন্নয়ন যজ্ঞে’র পরও ফুটপাতবাসীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে কীভাবে? 

বছর পঞ্চাশের দিনেশ মাইতি (নাম পরিবর্তিত) ঝড়তিপড়তি আপেল ন্যাসপাতি ইত্যাদি কম পয়সায় কিনে মেছুয়ার মুখে বসে বেচেন৷ বাড়ি বারাসতের দেগঙ্গায়৷ কথা বলে জানা যায়, কর্মস্থলে থেকে যাওয়া ছাড়া তাঁর উপায় নেই৷ দেগঙ্গা থেকে রোজ যেতে আসতে যে শক্তি সময় এবং খরচ লাগে, তাঁর পক্ষে সেটা টানতে পারা সম্ভব নয়৷ গ্রামে পরিবার আছে, আর আছে প্রবল দারিদ্র৷ মেছুয়ায় ফলমূল বেচে তিওয়ারি ব্রাদার্সের কাছের ফুটপাথে গিয়ে পরিচিত লোকদের সাথে ঘুমান তিনি৷ তাঁর কথা থেকে বিস্ময়কর সব তথ্য উঠে আসে৷ কী ভাবে এবং কেমন করে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার শয়ে শয়ে নারী–পুরুষ এইসব এলাকায় ফুটপাথের এক কোণে, কানা গলির মুখে পড়ে আছেন কোনও রকমে পরিবারটাকে মরতে দেবেন না বলে৷

রাজাবাজারের বাপ–নেওটা এমানুল (নাম পরিবর্তিত) একটু বড় হওয়ার পর থেকেই রাতে বাবার সাথে ফুটপাথে শোয়৷ ওকে কোনও দিন প্রশ্ন করে জানতে হয়নি, ওর আব্বু কেন ফুটপাথে শোয়৷ বস্তির ছয়–বাই–ছয়ের ঘরে চৌকির তলায় রান্না করে আম্মি৷ নানি শুয়ে থাকে সেই চৌকিরই ওপর৷ রাতে আম্মি নানি আর অবিবাহিত বুয়া ঘরে শোয় ঠাসাঠাসি করে৷ আব্বু যায় ফুটপাথে৷ এমানুল তাঁর পাশে শুয়ে ঘুম না আসা পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে৷

শিয়ালদার মাঝবয়সী বংশী সর্দার (নাম পরিবর্তিত) ও তাঁর পরিবার গত তিন বছর ধরে কোলে মার্কেটের কাছে ফুটপাথের স্থায়ী বাসিন্দা৷ ক্যানিংয়ের গ্রামে চালাঘরটা বন্যায় ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল৷ প্রাণ বাঁচাতে তিন ছেলেমেয়ে আর মা বৌ নিয়ে উঠেছিল গিয়ে ক্যানিং স্টেশনে৷ প্রায় ভিখারি হয়ে যা হোক খড়কুটো আঁকড়ে ধরার তাগিদে বিনা টিকিটে শিয়ালদা৷ এতগুলো পেট বাঁচাতে ভিক্ষা করতে হয়েছে দিনের পর দিন৷ তারপর বিভিন্ন খাবারের দোকানে হোটেলে জল বয়ে এনে দেওয়া শুরু৷ খাটুনির সামান্য রোজগারে মাটির হাঁড়িতে কাঠের জ্বালে ফুটপাথের কোণে বসে ভাত–তরকারি৷

দিনেশ এমানুল বংশীদের ‘প্রতিবেশী’র সংখ্যা যে ক্রমশ বাড়ছে পুরসভার ‘গবেষক’গণ তা সমীক্ষা করে জানতে পেরেছেন –এবার? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, কিছু শব্দ আর পদ্ধতি অদলবদল করে, এবারও তা–ই হবে যা গত সাত দশক ধরে চলে আসছে৷ অর্থাৎ, ভোটের আগে কিছু দান–খয়রাতি হবে, সস্তা প্লাস্টিক বা মশারি বিতরণের মস্ত সভা হবে রাজ্যের ‘উন্নয়নের প্রধান কাণ্ডারী’  এমনকী আস্ত একটা প্রকল্পও হয়ত প্রবর্তন করে দিতে পারেন– ফুটপাথশ্রী৷ কিন্তু কেন হাজার হাজার মানুষের এই দুর্দশা, তার মূল কারণ খোঁজার কাজটা অত্যন্ত সচেতন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হবে৷

(৭০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৩ জুলাই, ২০১৮)