‘আসল শক্তি জনগণের মধ্যেই নিহিত’ – নন্দীগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন Ramsey Clark

অল ইন্ডিয়া অ্যান্টি ইম্পিরিয়ালিস্ট ফোরামের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ২৭-২৯ নভেম্বর কলকাতায় যে মিছিল ও দু’দিন ব্যাপী সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল, তাতে উপস্থিত ছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা, আমেরিকার ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন সেন্টারে’র প্রেসিডেন্ট ও প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল Ramsey Clark । নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখতে ২৯ নভেম্বর তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে মহাজাতি সদনে উপস্থিত হয়ে নন্দীগ্রামে জনসাধারণের সংগ্রামের তাৎপর্য সম্পর্কে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য তিনি পেশ করেন। বক্তব্যটি গণদাবীর ৬০ বর্ষ ১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। Ramsey Clark এর জীবনাবসানে তাঁর এই বক্তব্যটি পুনরায় প্রকাশ করা হল।

নন্দীগ্রাম এক হৃদয়মথিত করা অভিজ্ঞতা, এক প্রেরণাদায়ক অভিজ্ঞতাও বটে। আজ গোটা পৃথিবীর মানুষ যে সংকটের সম্মুখীন, নন্দীগ্রামের ঘটনা তারই এক খণ্ডচিত্র। নিজের চোখে না দেখলে, শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণ পড়ে এর সম্যক উপলব্ধি সম্ভব নয়। দেড় হাজার বছর ধরে পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া জমিতে বাস করে আসছে যে জনসাধারণ– আজ তাদের নিজেদের সরকারই তাদের হত্যা করেছে, আহত করেছে, ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। নন্দীগ্রামের একটা অংশে ১১৯টি বাড়ি পোড়ানো হয়েছে। আমরা বহু ভস্মীভূত বাড়ি দেখেছি; যাঁরা এই সব ঘরে বাস করতেন, কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি; এঁদের সম্পত্তি লুঠপাট করা হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ, অনেকেই আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। একটি ছোট ছেলে, তার কপালে গুলি লেগেছিল, আমি বুলেটের সেই ক্ষত দেখেছি। ছেলেটি উঠে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু কথা বলতে পারে কি না, আমি বুঝতে পারিনি। এই ছোট ছেলেটি মারাত্মকভাবে আহত অসংখ্য মানুষের মধ্যে একজন মাত্র। মৃতের সংখ্যা যা বলা হচ্ছে, স্পষ্টতই তার চেয়ে অনেক বেশি। একটা ছোট জায়গাতেই ১০০ জন মারা গেছে বলে এলাকার মানুষ নিশ্চিত ভাবে জানিয়েছেন।

কেন এই সরকার সাধারণ মানুষের ওপর এই অত্যাচার চালাচ্ছে? এ জিনিস তারা করছে, যাতে ধনী ও শক্তিশালী বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদীরা এদেশে এসে শুধু ভারতীয়দের নয়, গোটা বিশ্বের মানুষকে শোষণ করতে পারে। যে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপন করার আশায় তারা পরিকল্পনা তৈরি করছে, সেখানে আপনারা রাসায়নিক কারখানা দেখতে পাবেন, হয়ত ‘ডাও কেমিকেল’-এর দেখাও পেতে পারেন। ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনার পরেও ডাও কেমিকেল এদেশে ফিরে আসছে– একথা কি কল্পনাও করা যায়! অথচ, পরিবেশ দূষিত করে সর্বত্র জীবন বিপন্ন করে তুলতে এবং সম্পদ শোষণ করার লক্ষ্যে এ জিনিসেরই পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমাদের বলা হয়েছে, সেখানে যুদ্ধ-সরঞ্জাম তৈরির কারখানা গড়ারও পরিকল্পনা আছে। এই যুদ্ধাস্ত্র ইরাকিদের হত্যা করার জন্যই কি তৈরি হবে? কোন দেশের মানুষের ওপর আক্রমণ চালানো হবে এইসব অস্ত্র দিয়ে?

সাম্রাজ্যবাদের জয়যাত্রা রুখতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের মধ্য দিয়ে কীভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটে, তা নন্দীগ্রামের ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। সেখানকার মানুষ ঘরবাড়ি-স্বজন সহ সর্বস্ব হারিয়ে আজ সর্বস্বান্ত। তাদের এই দুর্দশা করা হল যাতে পুঁজি এসে সমস্ত পরিবেশকে বিষিয়ে তুলতে পারে এবং মুষ্টিমেয় মানুষ ধনসম্পদ কুক্ষিগত করে গোটা মানবসমাজের অধিকাংশকে ক্রমেই আরও দরিদ্র করে তুলতে পারে।

নন্দীগ্রামের মানুষ কী অবিশ্বাস্য সাহসিকতার সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়েছে– সে-কথা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এই মুহূর্তে নিজেদের জীবনের মর্মান্তিক পরিণতির বিনিময়ে এক মহাশক্তিকে তারা স্পর্ধাভরে প্রতিরোধ করেছে। কিন্তু তারা বলছে, আমাদের সাহায্য ছাড়া একাজ তারা সফল করতে পারবে না। আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে না পৌঁছতে পারলে এবং একে অপরকে সাহায্য করতে না পারলে আমরাও এ জিনিস প্রতিরোধ করতে পারব না। মার্কিন যুক্তরাষ্টে্র যখন নাগরিক অধিকার অর্জনের আন্দোলন হয়েছিল, নিপীড়িত আফ্রো-মার্কিন জনসাধারণ তখন দাবি তুলেছিল – ‘জনগণের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে’। প্রমাণ হয়ে গেছে, সে কথা ভুল ছিল। বস্তুত জনগণই শক্তির উৎস – এই স্বতঃসিদ্ধকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রশ্ন হল, নিজেদের এই শক্তিকে প্রয়োগ করার মানসিক জোর এবং বুদ্ধিমত্তা জনসাধারণের আছে কি না। জনগণকে কে অগ্রাহ্য করতে পারে! ইরানের শাহকে সেদেশের জনসাধারণই অহিংস উপায়ে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এই শাহ অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। ১৯৭২-৭৬ সালের মধ্যে শাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার জন্য ২৬০০ কোটি ডলার খরচ করেছিল; ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর থেকেও বেশি সংখ্যক যুদ্ধট্যাঙ্কের মালিক ছিল সে। এতসব কিছু থাকা সত্ত্বেও তাকে একদিন সরে যেতে হয়েছিল, কারণ সমস্ত মানুষকে সে হত্যা করতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল সেদিন রাজপথ দখল করেছিল। তারা কলকারখানা, বাজার সমস্ত কিছু বন্ধ করে দিয়েছিল, স্কুল-কলেজ-অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে তারা দলে দলে বেরিয়ে এসেছিল। গোটা দেশকে তারা স্তব্ধ করে দিয়েছিল এবং শাসকদের প্লেনে চড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। আমাদের চ্যালেঞ্জ হল, সকলকে সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করা।

আমার মনে হয়, বহু বিষয়কে একত্র করে নন্দীগ্রাম যে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছে, তা সচরাচর দেখা যাবে না। নন্দীগ্রামের সংগ্রাম এমন একটি কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, যারা নিজের সমৃদ্ধির জন্য মানুষ ও দেশকে ধ্বংস করে, তাদের সর্বস্বান্ত করে। আমরা সর্বত্র নন্দীগ্রামের মানুষের বিজয় পতাকা বহন করে নিয়ে যাব। এ শুধু তাদের সাহায্য করার জন্য নয়; সাম্রাজ্যবাদের থাবা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যই একাজ আমাদের করতে হবে। কারণ, বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্যবাদ যে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে, অতীতে তা কখনও দেখা যায়নি।

ঠিক এই কারণেই, এদেশে যেসব ভাল মানুষেরা ‘অল ইণ্ডিয়া অ্যান্টি ইম্পিরিয়ালিস্ট ফোরাম’ গড়ে তুলেছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার ঋণ অনেক। আমি সর্বদা ‘অল ইন্ডিয়া’ কথাটি বলতেই ভালবাসি এবং আশা করি, সাম্রাজ্য-বাদের বিরোধিতায় সারা ভারতের মানুষই একজোট হবে। আমি আরও আশা করি, এই সম্মেলনের শেষে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মশক্তি, অঙ্গীকার এবং কার্যকলাপের ঐক্য গড়ে তোলার পথ খুঁজে পাব। এই পথ ধরেই আমরা জয়ী হব।