আলু চাষিদের সাথে সরকারি প্রতারণা চলছেই

বিষের শিশি হাতে নিয়ে রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ দেখালেন পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের আলু চাষিরা৷ ফসলের দাম না পাওয়া ও দুর্যোগের কারণে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মেদিনীপুর–চন্দ্রকোনা রাজ্য সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা৷ হুগলির চাষিরাও বিক্ষোভে সামিল৷

দেশজুড়ে চাষিরা যে চূড়ান্ত সংকটের সম্মুখীন তা কারও অজানা নয়৷ ফসলের দাম না পেয়ে ঋণগ্রস্ত চাষিদের আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার খবর প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে৷

চলতি বছরে এ রাজ্যে আলুচাষিরা ইতিমধ্যেই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন ভাল ফলন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে৷ এ বছর যে আলুর ফলন ভাল হবে তা জানাই ছিল৷ গত বছর এ রাজ্যে আলুর ফলন হয়েছিল ১ কোটি মেট্রিক টন, যা এ বছর বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৭০ লক্ষ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা৷

রাজ্য সরকার মোট উৎপাদিত আলুর ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ১০ লক্ষ মেট্রিক টন আলু চাষিদের কাছ থেকে কিনবে বলে জানিয়েছে৷ কুইন্টাল প্রতি ৫৫০ টাকা অর্থাৎ ৫.৫০ টাকা কেজি দরে চাষিরা সরকারকে আলু বিক্রি করতে পারবে৷ বাকি ১ কোটি ৬০ লক্ষ মেট্রিক টন আলুর ভবিষ্যৎ কী? আলু নিয়ে ফি–বছরের ন্যায় চাষিকে গ্রামীণ ফড়ে, আড়তদারদের শরণাপন্ন হতে হবে যেখানে কেজি প্রতি ১–২ টাকার বেশি দাম চাষির পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়৷ আবার একজন চাষি সরাসরি সরকারের কাছে সর্বাধিক ২৫ কুইন্টাল আলু বিক্রি করতে পারবে৷ কোন কোন চাষির কাছ থেকে আলু কেনা হবে তা তার নাম আলু চাষি হিসাবে নথিভূক্ত রয়েছে কি না, তা দেখে বিডিও ঠিক করবেন৷ অভিজ্ঞতা বলে, এই তালিকা তৈরির ক্ষেত্রেও চলবে ব্যাপক দলবাজি, দুর্নীতি৷ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত বা ঋণগ্রস্ত চাষি সরকারি মূল্যে আলু বিক্রি করার সুযোগ পাবেন না৷ যাঁরাও সুযোগ পাবেন, তাঁদের শুধু নাম থাকলে হবে না– বিডিও–তে গিয়ে আগে জমির কাগজ, সচিত্র পরিচয়পত্র, কিষান ক্রেডিট কার্ড দেখিয়ে সরকারি চিরকুট সংগ্রহ করতে হবে৷ এই চিরকুট নিয়ে জমি থেকে আলু তুলে ৮ মার্চ থেকে ২২ মার্চের মধ্যে আলু নিয়ে হিমঘরে পৌঁছতে পারলে, তবেই সর্বোচ্চ ২৫ কুইন্টাল আলু বিক্রি করে ১৩, ৭৫০ টাকা পাওয়ার যোগ্যতা চাষি অর্জন করতে পারবেন৷ বোঝাই যাচ্ছে এই নিয়মে ভাগচাষি বা প্রান্তিক চাষিদের কোনও সুবিধা হবে না৷ অথচ এ রাজ্যে যে লক্ষ লক্ষ ভাগচাষি বা প্রান্তিক চাষিরা রয়েছেন, যাদের কাছে সরকারি ঋণের সুযোগ সহজে পৌঁছয় না৷ যাঁদের বেশি দামে সার–বীজ বা সেচের ব্যবস্থা করতে হয়, যাঁরা গ্রামীণ মহাজন–সুদখোরদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করতে বাধ্য হন, যাঁরা সর্বাধিক সমস্যার মধ্যে পড়েন, তাঁদের সরাসরি আলু বিক্রি করার সুযোগ নেই৷ আবার যে চাষিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে সরকার ৫.৫০ টাকা কেজি দরে আলু কিনছে তাঁরাও সর্বোচ্চ ১৩,৭৫০ টাকার বেশি সরকারের কাছ থেকে পাবেন না৷ বাকি আলু আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে হবে জলের দরেই৷ যার মধ্য দিয়ে চাষের খরচও ওঠা সম্ভব নয়৷

সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীকে বেশি করে আলু খাওয়ার নিদান দিয়েছেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর এই আহ্বান কি অভাবগ্রস্ত  চাষিকে বাজার ধরাতে পারবে? চাষিকে কি বাঁচানো যাবে? না, টোটকা, হেকিমি করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ আসলে দেশের কৃষি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়টি কেন্দ্রের বা এ রাজ্যের তৃণমূল সরকার এড়িয়ে যেতে চাইছে৷ যা করলে চাষি বাঁচবে, সেই পদক্ষেপ না করে কেন্দ্র–রাজ্য উভয় সরকারই ভোটের দিকে তাকিয়ে কৃষি বাজেট তৈরি করেছে৷ ফুটো পাত্রে জল ঢালার মতো, ফোঁপরা বরাদ্দ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে চলছে রাজনৈতিক তরজা৷ যখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, চাষির রোজগার দ্বিগুণ করবই, তখন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনগুণ করেই দিয়েছি৷ অথচ আমরা জানি, চাষির পাশে দাঁড়াতে রাজ্য যত রকম বরাদ্দ করেছে, (আগাম অনুদান, পেনশন, চাষির মৃত্যুতে অনুদান, ফসল বিমার  প্রিমিয়াম এবং কৃষি দফতরের প্রশাসনিক খরচ) সব মিলে দাঁড়ায় মোট কৃষি বাজেটের তিন ভাগের দুই ভাগ৷ এক ভাগ থাকে চাষির রোজগার বাড়ানোর জন্য৷

সরকার প্রচার করছে, ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান চাষের খরচ কমাবে এবং রোজগার বাড়াবে৷ কিন্তু রোজগার বাড়ার বিষয়টি তো নির্ভর করে চাষির সব ফসল  ঠিকমতো উঠল কি না বা চাষি সব ফসলের ঠিকমতো দাম পেল কি না তার উপরে৷ দুটোই তো অনিশ্চিত– প্রাকৃতিক দুর্যোগে  ফসল নষ্টও হতে পারে বা সব ফসল সহায়ক মূল্যে বিক্রি নাও হতে পারে৷ চাষিকে বাজার ধরাতে গেলে প্রয়োজন  চাষির সমস্ত ফসল সরকারের পক্ষ থেকে লাভজনক দামে কিনে নেওয়া এবং পুনরায় ন্যায্য দামে জনগণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া, অর্থাৎ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা৷ এই দাবি বহুবার এসইউসিআই(সি) দলের পক্ষ থেকে উত্থাপিত করা হলেও কোনও সরকারই তাতে কর্ণপাত করেনি৷

বর্তমানে বাজেটে পরিকাঠামো তৈরিতে কোনও বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি৷ ভাল চাষের জন্য লাগে ভাল বীজ ও ভাল মাটি৷ নতুন বীজ তৈরি করা ও তার উপযুক্ত বন্টন ব্যবস্থা তৈরি করা, যাতে সকল চাষি পরীক্ষিত ও শোধিত বীজ পায় এবং মাটির পরীক্ষা ও চাষিকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রভৃতির জন্য যে বরাদ্দ দরকার ছিল তা বাজেটে নেই৷ কৃষি দফতরের অসংখ্য পদ শূন্য, যেখানে নতুন কোনও নিয়োগও হচ্ছে না, – এই প্রশ্নেও সরকার উদাসীন৷

এ রাজ্যে একসময় ব্লকে ব্লকে কিষান মান্ডি, রাজ্য জুড়ে প্রচুর গুদাম ঘর তৈরি, বেশি চাহিদার ফসল ফলানোর ট্রেনিং দেওয়া প্রভৃতির যে ঘোষণা হয়েছিল তা প্রায় অপূরিতই থেকে গেছে৷ এক সময়ে মোদি সরকার, ‘রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা’ ঘোষণা করেছিল, শোধিত মাটি, উন্নত বীজ, খামার, ক্ষুদ্র সেচ ইত্যাদি পরিকাঠামোর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বলেছিল এতে গরিব চাষির রোজগার বাড়বে৷

ক্রমে করপোরেট পুঁজির ত্রাণে বিজেপি সরকারের তাগিদ যত বৃদ্ধি পেয়েছে তত কমেছে কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ৷ এর মধ্যেও যতটুকু অনুদান পাওয়া যায় তা নিয়েই কেন্দ্র–রাজ্য তরজা৷ রাজ্যের চাষিরা চূড়ান্ত প্রতারণা ও বঞ্চনার শিকার৷ কৃষির উন্নয়ন ও উপযুক্ত কৃষি পরিকাঠামো গড়ে তোলার কোনও পদক্ষেপ সরকারগুলির নেই৷ চাষিও ভুলতে বসেছে তার অধিকারের বিষয়টি৷ চাষি যদি ফসলের ন্যায্য দাম না পায়, চাষির রোজগার যদি না বাড়ে, শুধু বছরে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে বা মাত্র ১০ লক্ষ মেট্রিক টন আলু কিনে বা ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্প চালু করে চাষিকে সংকট থেকে বাঁচানো যাবে না৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩২ সংখ্যা)