আর এস এস–এর প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারকে কি দেশের মহান সন্তান বলা যায়

সম্প্রতি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় নাগপুরে আর এস এস–এর এক শিবিরে গিয়ে তাঁর অন্যান্য বক্তব্যের সাথে আর এস এস–এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারকে ‘ভারত মাতার মহান সন্তান’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন৷ প্রণববাবু একজন নামীদামি মানুষ, তিনি গান্ধি পরিবারের অনুগত এবং কংগ্রেসের থিংক ট্যাঙ্ক বলে পরিচিত৷ তাই তাঁর এই বক্তব্য দেশে যথেষ্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে – যে সংগঠনের নাম গান্ধীহত্যার সাথে যুক্ত, যারা কোনও দিন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়নি, যারা দেশ বিভাগের ক্ষেত্রে দ্বি–জাতি তত্ত্বের জন্মদাতা, যাদের আদর্শ পুরুষ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়ক হিটলার–মুসোলিনী, যারা ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন ঘটিয়ে দেশের বুকে অসংখ্য দাঙ্গার সংগঠক, যারা বস্তাপচা পুরনো চিন্তা জনমনে গেঁথে দিয়ে ফ্যাসিবাদের ভিত্তিকে আরও দৃঢ়, আরও পোক্ত করতে  চায়– সেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ‘ভারত মাতার মহান সন্তান’ হন কী করে? তাঁকে কি ‘ভারত মাতার মহান সন্তান’ বলা যায়?

হেডগেওয়ার যখন যৌবনের মধ্যগগনে তখন এ দেশে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বর্ণযুগ৷ অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর বিপ্লবীরা এ দেশকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য সর্বস্বত্যাগ করে সংগ্রাম সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, অশেষ দুঃখবরণ করে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছেন মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সত্যকার মানে কী৷ আর এই সংগ্রামের প্রক্রিয়াতেই সেদিন জন্ম হয়েছিল দেশবন্ধু, লাজপৎ রাই, নেতাজি, ভগৎ সিং–এর মতো দেশের মহান সন্তানদের৷ সেদিন কি হেডগেওয়ার এই মহান দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছিলেন? সেদিন কী ছিল তাঁর ভূমিকা? কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত আরএসএস? এটাই ইতিহাস যে, হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে এবং জাতীয় কংগ্রেস যাতে ব্রিটিশ বিরোধিতার লাইন ত্যাগ করে তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে সে বিষয়ে বারবার উপদেশ দিয়েছে৷ সেই উপদেশ না শোনায় আরএসএস দেশের জাতীয়তাবাদী নেতাদের বিশ্বাসঘাতক পর্যন্ত বলেছে৷ ওদের তখন বক্তব্য ছিল, ‘‘অদ্ভুত, ভারী অদ্ভুত যে, বিশ্বাসঘাতকদের জাতীয় বীররূপে সিংহাসনে বাসানো হয় এবং দেশপ্রেমিকদের উপর কলঙ্ক নিক্ষেপ করা হয়’’৷ অর্থাৎ আর এস এস–এর ভাষ্য অনুযায়ী যাঁদের তখন জাতীয় বীররূপে সিংহাসনে বসানো হয়েছিল সেই দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র, লাজপৎ রাই বা ভগৎ সিং–রা ছিলেন বিশ্বাসঘাতক৷ কারণ তাঁরা মুসলিম বিরোধিতা না করে সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছিলেন ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য৷ এইভাবে জাতীয় নেতাদের চরিত্র হনন করে আর এস এস সেদিন স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল৷

নিজেদের এই কলঙ্কজনক ইতিহাস আর এস এস এখন ভুলিয়ে দিতে চায়৷ দেশপ্রেমিক সাজার উদগ্র আকাঙক্ষায় ওদের মুখে এখন শোনা যায় ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান৷ সত্য–মিথ্যায় মিলিয়ে মিশিয়ে ওরা এখন এমনভাবে প্রচার করে যাতে মনে হয় তৎকালীন আর এস এস নেতারা ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে একেবারে প্রথম সারিতে ছিলেন, দেশের জন্য তাঁদের ত্যাগ অনন্য এই মিথ্যার কারবার, ইতিহাসের বিকৃতি চলছে অনেকদিন ধরে৷ অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারকে তিনি ‘মহান দেশপ্রেমিক’ বলে অভিহিত করে তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিলেন৷ সেই অনুষ্ঠানে বাজপেয়ীজি বলেছিলেন, এই স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে একজন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রতি দেশ এতদিন যে অবজ্ঞা দেখিয়েছে তা সংশোধন করা হল৷ তখনকার আর এস এস প্রধান রাজেন্দ্র সিং–ও সেই অনুষ্ঠানে হেডগেওয়ারকে ‘মহান দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামী’ বলে অভিহিত করেছিলেন৷ পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এখন বলছেন, ‘আমার মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বপন করেছিল আর এস এস’৷ এইভাবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় আরএসএস তার ভাবমূর্তি পুনর্নির্মাণের কাজ চালাচ্ছে৷ প্রণববাবুর বক্তব্য আরএসএস–এর এই উদ্যোগকেই সহায়তা করবে– এতে কোনও সন্দেহ নেই৷

প্রণববাবু যাই বলুন, আসুন আমরা বিচার করে দেখি দেশের জন্য কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের অবদান কী, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামেই বা তিনি কী ভূমিকা পালন করেছেন৷

হেডগেওয়ারের ভূমিকা

স্বাধীনতা সংগ্রামে ওদের অংশগ্রহণের প্রমাণ হিসাবে আর এস এস কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের দু–দু’বার কারাবরণের দৃষ্টান্ত হাজির করে৷ এ কথা সত্য, ডাঃ হেডগেওয়ার ব্রিটিশ কারাগারে দু’বার বন্দি ছিলেন৷ খিলাফত আন্দোলনের এক সভায় (১৯২০–’২১) বক্তৃতা দেওয়ায় প্রথমবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ কিন্তু এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ডাঃ হেডগেওয়ারের মধ্যে যে ধরনের চিন্তার জন্ম হয়েছিল তা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য৷ ডাঃ হেডগেওয়ারের তখনকার মানসিকতার বর্ণনা করে আরএসএস–এর এক প্রকাশনায় বলা হয়, ‘‘১৯২১–এর আন্দোলনের উত্তরপর্ব ডাঃ হেডগেওয়ারের কাছে আঘাতের মতোই এসেছিল৷ ভারতীয় মুসলমানরা প্রমাণ করেছেন, তাঁরা প্রথমে মুসলমান, পরে ভারতীয়৷ মুসলমানদের অন্ধ গোঁড়ামি গোটা দেশের পরিবেশকে ভারী করে দিয়েছিল৷… এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ভারতে হিন্দুরাই জাতি এবং হিন্দুত্বই রাষ্ট্রীয়ত্ব৷ … একমাত্র হিন্দুরাই হিন্দুস্তানকে মুক্ত করতে পারবে, তারাই পারবে হিন্দু সংস্কৃতি রক্ষা করতে৷ … আর এস এস স্থাপনের মধ্যেই এই মহাত্মা মানুষটির যন্ত্রণা ভাষা খুঁজে পায়৷’’

এই বর্ণনা থেকে আমরা কী পেলাম? পেলাম খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করে ডাঃ হেডগেওয়ারের অন্তরে জাতীয়তাবাদী ধ্যান–ধারণার পুষ্টি হয়নি৷ খিলাফত আন্দোলনের দুর্বলতা তাঁর হৃদয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানসিকতারই শক্তি বৃদ্ধি করেছিল৷ তখনই তাঁর মনে জন্ম নিয়েছিল একটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠন জন্ম দেওয়ার বাসনা৷ যার পরিণতিতেই ১৯২৫ সালে জন্ম নিয়েছিল আর এস এস৷ ডাঃ হেডগেওয়ার আরও একবার ব্রিটিশ কারাগারে গিয়েছিলেন৷ আর এস এস প্রকাশিত তাঁর জীবনীগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘‘১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্যের ডাক দিয়েছিলেন৷ ডাঃ হেডগেওয়ার সব জায়গায় খবর পাঠালেন, এই সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করবেন না৷ … এর অর্থ হল সংঘের কোনও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না’’ (সি পি ভিশিকর, ডাঃ কেশব রাও হেডগেওয়ার, নিউ দিল্লি, ১৯৯৪, পৃ : ২০)৷

আর এস এস প্রকাশিত ডাঃ হেডগেওয়ারের জীবনীগ্রন্থে বলা হয়েছে , ‘‘(আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য) যদি কেউ অনুমতি নিতে আসত , তা হলে ডাক্তারজি তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেন, কত দিনের প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছ? সাধারণত উত্তর আসত– ছয় মাসের৷ তখন ডাক্তারজি জিজ্ঞাসা করতেন, ছয় মাসের বদলে যদি দু’বছরের শাস্তি হয়– তা হলে? এই প্রশ্নের উত্তর হত – ভোগ করব৷ কেউ এ রকম মনোভাব দেখালে ডাক্তারজি বলতেন, মনে কর তোমার শাস্তি হয়ে গেছে৷ এই সময়টা সংঘের কাজের জন্য দাও৷ অনেক বুদ্ধিমান তরুণ তাই করত’’ (জীবনচরিত, ডাঃ হেডগেওয়ার, নারায়ণ হরি, পালকর, পৃঃ ২০৬)৷ অর্থাৎ দেখা গেল, আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তরুণদের নিবৃত্ত করারই চেষ্টা করেছিলেন ডাঃ হেডগেওয়ার৷

কিন্তু ডাঃ হেডগেওয়ার নিজে এই আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেছিলেন৷ কিন্তু এই অংশগ্রহণ ও কারাবরণের পিছনে কি তাঁর ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশপ্রেমী মনোভাব কাজ করেছিল, না কি কাজ করেছিল অন্য চিন্তা? আর এস এস প্রকাশিত তাঁর জীবনীগ্রন্থে এ প্রসঙ্গে কী বলা হয়েছে? বলা হয়েছে, ‘‘ডাঃ সাহেবের এই প্রত্যয় ছিল জেলের ভিতর তিনি একদল স্বদেশপ্রেমী, অগ্রগামী, নামজাদা লোক পাবেন৷ তাঁদের সাথে তিনি সংঘ নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন এবং সংঘের কাজে তাঁদের টেনে আনতে পারবেন’’ (সি পি ভিশিকর, ওই, পৃঃ ২০)৷

তাঁর আর একটা জীবনীগ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘‘ডাক্তারজি চিন্তা করে দেখলেন যে এই সময়ে সম্পূর্ণ সমাজের মন্থন হয়ে দেশভক্তিপূর্ণ যথার্থ কর্মকর্তারা কারাগারের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একত্রিত হবেন৷ যদি এই রকম সম্ভাবনাময় তথা দেশভক্তির ভাবনাযুক্ত তরুণ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠতা লাভের সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে সংঘের দিক থেকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে এক এক জনকে খুঁজে বেড়াবার থেকে অধিক লাভজনক কাজ হবে৷’’ (জীবন চরিত, ডাঃ হেডগেওয়ার, নারায়ণ হরি পালকর, প্রথম সংস্করণ, পৃঃ ২০৬)৷

ডাঃ হেডগেওয়ার নিজেও এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘আমরা যারা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি, সকলেই ব্যক্তিগত দায়িত্বে তা করেছি৷ সংঘের চিন্তাধারা ও কার্যপদ্ধতির মধ্যে কোনও রকম পরিবর্তন হয়নি৷ দেশের মধ্যে যত আন্দোলন চলে সংঘের স্বার্থে তাকে কাজে লাগানো আমাদের অবশ্য কর্তব্য৷’’

জীবনী রচয়িতাদের বক্তব্য ও ডাঃ হেডগেওয়ারের নিজের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি অনুগত হয়ে ডাঃ হেডগেওয়ার জেলে যাননি, তিনি জেলে গিয়েছিলেন আর এস এস–এর তরুণ বাহিনী সংগ্রহের জন্য৷ যে সব তরুণেরা দেশপ্রেমের প্রেরণায় অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন ডাঃ হেডগেওয়ার তাঁদের মাথায় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ বপন করারই চেষ্টা করেছিলেন৷ ব্রিটিশ বিরোধিতা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না৷ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যকে ধ্বংস করে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামকে দুর্বল করে দেওয়া৷ ইতিহাসের এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না৷

হিটলারি ফ্যাসিবাদ ও হেডগেওয়ার

আর এস এস যে চিন্তায়, মননে, লক্ষ্যে, উদ্দেশ্যে, সাংগঠনিক কাঠামোয় ফ্যাসিবাদ–নাৎসিবাদ্ ভারতীয় সংস্করণ, এ কথা আজ আর প্রগতিশীল মানুষের অগোচর নেই৷ ওদের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ধারণা হিটলারি মডেলের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত যে, গোলওয়ালকর তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ গ্রন্থে খোলাখুলি বলেছেন, ‘‘জার্মানদের জাতিতত্ত্বের গর্ব আজ মুখ্য আলোচনার বিষয় হয়ে পড়েছে৷ নিজেদের জাতীয় সংস্কৃতিকে কলুষমুক্ত করতে জার্মানি গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে সেমিটিক জাতি ইহুদিদের দেশ থেকে বিতাড়ন করছে৷ জাতিগত গর্ব এখানে তার সর্বোচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত৷ জার্মানি এটাও প্রমাণ করেছে যে, নিজস্ব ভিন্ন শিকড় আছে এমন জাতি বা সংস্কৃতির একসঙ্গে মিশে একটা পূর্ণাঙ্গ সত্তা তৈরি করা অসম্ভব৷ এই শিক্ষা হিন্দুস্তানে আমাদের গ্রহণ করা এবং তার থেকে লাভবান হওয়া প্রয়োজন ’’ (পৃঃ ৩৫)৷

এই ধরনের চিন্তা গোলওয়ালকর পেলেন কোথা থেকে? এই চিন্তা তিনি পেয়েছেন তাঁর পূর্বসূরি মুঞ্জে ও কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের কাছ থেকে৷ মুঞ্জে হলেন সেই ব্যক্তি যিনি হেডগেওয়ারকে নিজের বাড়িতে রেখে প্রতিপালন করেছিলেন এবং ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে পড়বার জন্য কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন৷

১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চের মাঝামাঝি সময়ে মুঞ্জে ইউরোপ সফর করেন৷ ইতালিতে তিনি ছিলেন ১৫ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত৷ ১৯ মার্চ তিনি রোমের মিলিটারি কলেজ, ফ্যাসিস্ট অ্যাকাডেমি অব ফিজিক্যাল এডুকেশন ইত্যাদি পরিদর্শন করেন৷ তাঁর ডায়েরিতে এই সময়ে মুঞ্জে লিখেছেন : ‘‘ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ইতালিতে জনগণের মধ্যে ঐক্যের ধারণার জন্ম দিয়েছে৷ ভারত বিশেষ করে হিন্দু ভারতে এই ধরনের সংগঠন দরকার যাতে হিন্দুদের সামরিক পুনরুত্থান হতে পারে৷ … ডাঃ হেডগেওয়ারের নেতৃত্বাধীন নাগপুরের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এই ধরনের সংগঠন৷ এই সংগঠনের বিস্তারের জন্য আমি সারা জীবন কাজ করে যাব৷’’ ভারতে ফিরে এসে মুঞ্জে কিন্তু এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি৷ মারাঠা পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘বাস্তবে নেতাদের জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিস্ট সংগঠনের অনুকরণ করা উচিত৷ … ইতালি–জার্মানির ফ্যাসিস্ট সংগঠনের দ্বারা আমি খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছি৷’’

এরপর থেকেই ডাঃ হেডগেওয়ারের নেতৃত্বে আর এস এস–এর ভিতরে ফ্যাসিবাদ নিয়ে জোর কদমে আলোচনা শুরু হয় এবং ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলির আদলে আরএসএস–কে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়৷ ১৯৩৪ সালের ৩১ জানুয়ারি ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনির উপর এক আলোচনাসভার আয়োজন করেন কাপ্তে শাস্ত্রী৷ সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন হেডগেওয়ার৷ সমাপ্তি ভাষণ দেন মুঞ্জে (নেহেরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, মুঞ্জে পেপারস, ডায়েরি, ১৯৩২–’৩৬)৷

ফ্যাসিস্ট ইতালি ও জার্মানি ছিল আর এস এস–এর প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হেডগেওয়ারের আদর্শ৷ যখনই তিনি হিন্দু সমাজের সামরিকীকরণের কথা বলেছেন, তখনই তিনি দৃষ্টান্ত হিসাবে ইতালি ও জার্মানির কথা বলেছেন, ওই সব দেশের ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন৷ বোঝাই যায়, এ দেশে ফ্যাসিবাদী ধ্যানধারণা, ফ্যাসিস্ট সংগঠন কৌশলকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ডাঃ হেডগেওয়ারের নেতৃত্বাধীন আর এস এস–এর চেষ্টার অন্ত ছিল না৷

তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি, ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেননি, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক তরুণদের তিনি নিরুৎসাহিত করেছিলেন, তাদের মাথায় তিনি হিন্দু সাম্প্রদায়িক চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷ সাথে সাথে মুসলিম বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে তিনি হিন্দু সমাজের ফ্যাসিবাদীকরণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই কারণে হিটলার–মুসোলিনির অন্ধ স্তাবকে পরিণত হতেও তাঁর বাধেনি৷ তাই ডাঃ হেডগেওয়ার ফ্যাসিবাদী লাইনে হিটলারের অনুকরণে অভ্যন্তরীণ শত্রুর ধারণা আমদানি করেছেন এবং পরাধীন ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই না করে লড়াই করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে৷ তাই তাঁর সৃষ্ট সংগঠন ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন লাগিয়েছে সর্বত্র৷ এ দেশের নবজাগরণের মহান সন্তানেরা মানবতাবাদের যে জয়গান গেয়েছেন, জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের যে চেষ্টা চালিয়েছেন প্রাণপণ, ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার তাঁর বিরোধিতাই করেছেন জীবনভর৷ বিদ্যাসাগর–রবীন্দ্র সিং প্রমুখেরা যে জীবনাদর্শের সন্ধান দিয়েছেন, ডাঃ হেডগেওয়ার তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন৷ সমাজের বুকে ঘৃণা ছড়ানোই যাঁর কাজ, সমাজকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়াই যাঁর জীবনের ব্রত, অন্ধ, তামস, যুক্তিহীন, বিজ্ঞানবিরোধী ধ্যানধারণার প্রচার ও প্রসারের চেষ্টাই যিনি করে গেলেন সারা জীবন, তাঁকে কি ‘ভারত মাতার মহান সন্তান’ হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়

এ সব কথা প্রণববাবুর অজানা নয়৷ কাকে খুশি করতে কী প্রয়োজনে তিনি এই প্রশংসাবাক্য বর্ষণ করেছেন, তা তিনিই বলতে পারবেন৷ কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে যে তিনি ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন এতে কোনও সন্দেহ নেই৷

(৭০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা ২২ জুন, ২০১৮)