আমেরিকায় বন্দুকবাজি

ফ্লোরিডার স্কুলে বছর উনিশের আততায়ী বন্দুকবাজের গুলিচালনায় ১৭ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হওয়াটা বাস্তবে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না৷

কেন না শুধু গত ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়, তার আগে ২০১২–তে কানেকটিকাটের স্যান্ডি হক এলিমেন্টারি স্কুলে আততায়ীর গুলিতে ২৮ জন মারা যাওয়ার ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১,৬০৬টি গণহত্যার কারণ বন্দুকবাজের বন্দুকের গুলি৷ মারা গেছেন প্রায় ১,৮৩০৷ আহত প্রায় ৭,০০০৷ গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ নামক সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরে ছ–সাতটি এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা আমেরিকার নাগরিক জীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে৷ কখনও স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে, কখনও শপিং মল–নাইট ক্লাবে–ডিটোরিয়ামে–কনসার্ট হলে, কখনও গির্জায় আততায়ীর গুলিতে প্রতি বছর এ ভাবে মানুষের অসহায় মৃত্যু হচ্ছে৷ গত ৮ মার্চ আলাবামার বার্মিংহামের একটি স্কুলে গুলি চালনায় মারা গেল এক ছাত্রী৷ কিন্তু কেন একের পর এক এই হত্যার উন্মত্ততা?

এ কি কোনও জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কাজ? না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই আক্রমণকারীরা স্কুল–কলেজের ছাত্র নয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন মধ্যবয়সী মানুষ৷ এদের কেউ বর্ণ বিদ্বেষী, কেউ নারী বিদ্বেষী, কেউ অন্য ধর্মের মানুষ দেখলেই ক্ষিপ্ত হন৷ সহ নাগরিকদের প্রতি কেন এমন হত্যার মনোভাব? এই মনোভাবের উৎস কী? মানুষের প্রতিটি সৎ ও সুন্দর মনোভাবের মতো এমন একটি বীভৎস তথা অসুন্দর মনোভাবের উৎসও অবশ্যই দেশের আর্থ–সামাজিক পরিবেশ৷ পুঁজিবাদী সমাজ তার বিকাশের সর্বোচ্চ স্তর অতিক্রম করে আজ বার্ধক্যে পৌঁছেছে, সে আজ মুমূর্ষু৷ একই সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল৷ এই সমাজে তাই প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সমাজ বিচ্ছিন্নতা৷ ব্যক্তিস্বার্থ–লোভ–হিংসা সঞ্জাত নৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে সর্বস্তরে৷ সংকট গ্রাস করছে মনন জগতকেও৷ এই সমাজে ব্যক্তিগত আবেগ–অনুভূতিও লাভের নিরিখে বিচার করা হয়৷ স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ্যা এই সমাজে বেকারি–কর্মহীনতার সাথে জন্ম নিচ্ছে হতাশা৷ হতাশা জন্ম দিচ্ছে মানসিক বিপর্যয়ের৷

পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি হিসেবে পরিচিত আমেরিকা বিশ্বের দেশে দেশে হানাদারি, রক্তপাত, কোটি কোটি ডলারের যুদ্ধ ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত৷ আধুনিক দূর নিয়ন্ত্রিত ব্যালিস্টিক মিসাইল ও অন্যান্য মারণাস্ত্রের জোরে ভিয়েতনাম, জাপান থেকে ইরাক–ইরান–সিরিয়া–আফগানিস্তান-লিবিয়া সহ একের পর এক দেশে সে গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে হয় পুতুল সামরিক সরকার নয় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে রাখে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ভিয়েতনাম যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর ‘Rambo Culture, ‘কাউ বয়’ ইত্যাদির আমদানি করে আমেরিকা৷ যা আসলে বন্দুক–সংস্কৃতি তথা হত্যার সংস্কৃতি ছাড়া কিছু নয়৷ শাসক শ্রেণি তাদের মুনাফার স্বার্থে মার্কিন যুব সমাজের মধ্যে এই সংস্কৃতিই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে, যেখানে মানবতা নয় বন্দুকের জোর, পেশিশক্তিই উপজীব্য৷ তারা তৈরি করেছে এমন আরও অসংখ্য হলিউডি ফিল্ম ও কমিকস চরিত্র৷ যে সংস্কৃতির বীজ সারা বিশ্বে আমেরিকা ছড়িয়েছে, সে বিষ এখন খোদ আমেরিকার সমাজজীবনকে গ্রাস করছে৷ পুঁজিবাদী সংকটের গর্ভে জন্ম হচ্ছে এমন অসংখ্য মানসিক বিকারগ্রস্ত ঘাতকের৷

আশার কথা আমেরিকার তরুণ ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে সরব হচ্ছেন৷ ফ্লোরিডার ঘটনাই যাতে সর্বশেষ ‘মাস শ্যুটিং’–এর ঘটনা হয় সেজন্য একজোট হয়ে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন তাঁরা৷ জোরালো হচ্ছে বন্দুক নিয়ন্ত্রণের দাবি৷ পাশাপাশি শুধু বন্দুক নিয়ন্ত্রণ নয়, এ লড়াই সার্থক হবে না যদি হত্যাকারীর মানসিক বিকারগ্রস্ততার মূলে যে মুর্মূষু পুঁজিবাদ– তাকে উচ্ছেদ করার সংগ্রামটিকে জোরদার করা না যায়৷

সাগর সাঁতরা, কলকাতা