‘আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম’

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) কর্মীরা বাড়ি বাড়ি প্রচার করছিলেন নদীয়ার চাকদা স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়৷ দলের নাম শুনেই ‘আসুন আসুন’ বলে বাড়ির ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলেন এক মহিলা৷ পরিচয় করালেন প্রবীণ এক মানুষের সঙ্গে– ওঁর বাবা৷ সাগ্রহে তিনি বললেন, আপনাদের জন্যই তো কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি আমি দীর্ঘদিন সিপিএম করেছি৷ দল যে এভাবে বিজেপিকে ভোট করাবে এ স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি৷ ভুল নেতৃত্বের জন্যই দলের আজ এই পরিণতি৷ আপনাদের অনেক দিন ধরেই দেখছি৷ আপনারাই পারবেন বামপন্থাকে সঠিক দিশা দিতে৷ কমরেড প্রভাস ঘোষের ‘জনস্বার্থে  নির্বাচনকে কোন  দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে’ বইটি নিলেন, চাঁদা দিলেন এবং আবার আসার জন্য বারবার অনুরোধ করলেন৷ ওই এলাকায় সিপিএম–বিজেপির এক হওয়ার কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে৷ যাঁরা মনেপ্রাণে বামপন্থী তাঁরা নেতৃত্বের এই অবাম আত্মঘাতী  নীতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না৷

তেমনই একজন প্রাক্তন শিক্ষক কর্মীদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে বললেন, আপনারা কি জানেন কত মানুষ আপনাদের ভালবাসে? কত মানুষ আপনাদের পিছনে আছে? বললেন, সারা জীবন বামপন্থী রাজনীতি করে এসে এক চরম সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমর্থন করার কথা ভাবতেও পারছি না৷ চাঁদা দিয়ে বললেন, আমার মতো অনেকেই আছেন, তাঁদের সাথে যোগাযোগ করুন৷ আমি যতজনকে পারব বলব৷ দলের কর্মীরা যখন ওই এলাকায় প্রার্থীর চিহ্ন টর্চের ছবি দেওয়া পোস্টার মারছেন, তখন তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ৷ বললেন, আপনারা এবার কী চিহ্ন পান সেটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম৷

বামপন্থী তো আপনারাই’

আসামের বরপেটা কেন্দ্র৷ সিপিএম সেখানে প্রার্থী দেয়নি৷ সেখানে তাদের দলের নেতারা একাধিক জনসভা করে বলেছেন, এই কেন্দ্রে কোনও বামপন্থী প্রার্থী নেই, তাই সব ভোট কংগ্রেসকে দিতে হবে৷ এমনই একটি জনসভার কিছুক্ষণ বাদেই সেখানে পৌঁছে গেছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)  প্রার্থী হুসনেজাহা বেগমের (ইনা হুসেন) প্রচার মিছিল৷ এলাকার সিপিএম কর্মী–সমর্থকরা অবাক– নেতারা তাহলে ডাহা একটি মিথ্যা বলে গেলেন? পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন তাঁদের অনেকেই৷ আপনারা ভোটে আছেন, তাও বলল এখানে কোনও বামপন্থী প্রার্থী নেই৷ বলে গেল কংগ্রেসকে ভোট দিতে এই নির্দেশ মানা যায় না৷ আমরা আপনাদেরই ভোট দেব৷ বামপন্থী তো আপনারাই৷ ভোটের পরেও বেশ কিছু সিপিএম সমর্থক স্থানীয় এসইউসিআই (সি) কর্মীদের বলে গেছেন, ভোটটা আপনাদেরই দিয়েছি৷ এবারে নেতাদের ধরব, কেন মিথ্যা বলল তার জবাব চাইব৷

শিলচরে সিপিএম জেলা সম্পাদক নিজে একাধিক জনসভা করে প্রচার করেছেন, এসইউসিআই (সি)–কে  নয়, ভোট দিন কংগ্রেসকে৷ ধিক্কারে ফেটে পড়েছেন বহু সিপিএম সমর্থক সৎ মানুষ৷ প্রকাশ্যে বলে গেছেন তাঁরা, ‘কোনও দিন ভাবিনি যে, নিজেরা প্রার্থী না দিয়ে সিপিএম এভাবে কংগ্রেসের প্রচারকে পরিণত হবে’ তাই শিলচর কেন্দ্র জুড়ে সিপিএম সমর্থকদের মুখে মুখে ছড়িয়েছে,  ‘কংগ্রেসকে ভোট দিতে পারব না, বামপন্থার মর্যাদা রাখল এসইউসিআই, ভোটটা ওরাই পাবে’৷

ভেবেছিলাম বিজেপিকে ভোট দেব, বইটা পড়ে সম্বিত ফিরল’

দলের এক কর্মীর কাছে হঠাৎ তাঁর ছাত্রীর ফোন৷ ‘স্যার খুব ব্যস্ত? মা আপনার সাথে কথা বলবেন৷’

‘স্যার বইটা পড়েছি৷ নতুন অনেক কিছু জানলাম৷ খুব ভাল লাগল৷ আপনাদের পার্টির এত ভাল ভাল কাজ–কর্ম সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না৷ অন্য দলগুলির উপর বিরক্ত হয়ে এবার ভেবেছিলাম বিজেপিকে ভোট দেব৷ কিন্তু আর তো বিজেপিকে ভোট দিতে পারব না৷’ কর্মীটি প্রশ্ন করলেন, ‘কেন দিদি?’ তিনি বললেন, ‘বইটা পড়ে বিজেপির রাজনীতিটাও ধরতে পারলাম৷ আপনাদের দলের চিহ্ণ কী জানাবেন৷’ রাতেই ফোন করে চিহ্নটা জানিয়ে দিলেন তিনি৷ ছাত্রীর বাড়ি রানাঘাট লোকসভায়৷ কলকাতায় আসে পড়তে৷ ছাত্রীকে বইটি দিয়ে কর্মীটি বলেছিলেন, ‘তুমি পড়ে মাকেও পড়তে দেবে৷ পড়ে সিন্ধান্ত নিতে বলবে৷’ বই পড়ার পর তিনি গণআন্দোলনের পক্ষে থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷

ভোটের পরে আসুন, আলোচনায় বসব’

ভোটে প্রচারের সময় হাওড়ার একটি জায়গায় দশ–বারো জন যুবকের একটি গ্রুপ দলের এক সংগঠককে বললেন, ‘আমরা দীর্ঘ দিনের বামপন্থী৷ কিন্তু দল যা করছে তা কিছুতেই মানতে পারছি না৷ এবার ভোটে কোনও কাজ করিনি৷ দলের এমন দুরবস্থা, কেন কাজ করছি না সেটাও কেউ খোঁজ নিতে আসেনি৷ আপনাদের লড়াই আন্দোলন আমরা সমর্থন করি৷ প্রভাসবাবুর বইটি পড়েছি৷ ভালো লেগেছে৷ ভোটের পরে আসুন আলোচনায় বসব৷ আমরা এখানে কাজ করতে চাই৷’

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা)