আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে মোদি–শাহদের মিথ্যাচার

দেশজোড়া আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে মোদি–শাহরা মিথ্যাচারের রাস্তা নিয়েছেন

সংশোধিত নাগরিক আইন এবং এনআরসি–র বিরুদ্ধে দেশজোড়া প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে কতখানি বেসামাল হয়ে পড়েছে বিজেপি সরকার, ২২ ডিসেম্বর দিল্লির রামলীলা ময়দানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য থেকেই তা স্পষ্ট৷

আন্দোলন যখন সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, কোনও ভাবেই তাকে আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না তখন প্রধানমন্ত্রী কোনও রকম নীতি–নৈতিকতা, এমনকি চক্ষুলজ্জারও পরোয়া না করে একটি নির্জলা মিথ্যা বললেন– এনআরসি নিয়ে সরকারের মধ্যে কোনও কথাই হয়নি৷ উল্টে দাবি করেছেন, প্রতিবাদীরা মিথ্যা বলছে৷

প্রতিবাদীদের কথা পরে হবে৷ দেখা যাক নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা কী বলেছেন৷ গত প্রায় বছরখানেক ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, দলের কার্যনিবাহী সভাপতি জে পি নাড্ডা সহ বহু নেতা–মন্ত্রীই বলে আসছেন দেশজুড়ে তাঁরা এনআরসি করবেনই৷ সদ্য সমাপ্ত রাজ্যসভার অধিবেশনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘কোনও সংশয় রাখবেন না, এনআরসি গোটা দেশেই হবে৷ দেশের সব রাজ্যে অসমের ধাঁচে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি হবেই এবং তা হবে ২০২৪ সালের ভোটের আগেই৷’’ তা হলে কে মিথ্যা কথা বললেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে নাকি তাঁর দলের সভাপতি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?  প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যি কথা বলেন, তবে রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে৷ তা হলে প্রধানমন্ত্রীর তো উচিত তাঁর সরকারের মন্ত্রীরা মিথ্যা কথা বলেছেন এটা স্বীকার করা এবং সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচারের জন্য অমিত শাহকে শাস্তি দেওয়া৷ নাকি এটাই আসলে তাঁদের কৌশল৷ আর এই বিভ্রান্তির আড়ালে যত দুষ্কর্ম চালিয়ে যাওয়া আন্দোলনের ব্যাপকতাকে লঘু করে দেখাতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পোশাক দিয়ে প্রতিবাদীদের ধর্ম চিনুন৷ প্রধানমন্ত্রী যতই এই আন্দোলনকে ‘মুসলমানদের আন্দোলন’ বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করুন, বাস্তবে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে দেশজুড়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে মানুষ৷ সরকার যতই প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে নির্মম পুলিশি অত্যাচার নামিয়ে আনছে, প্রতিবাদ ততই এক শহর থেকে আর এক শহরে, এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে৷ বুদ্ধিজীবীরা রাস্তায় নামছেন৷ ছাত্ররা কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়্ ছেড়ে বেরিয়ে এসে মিছিলে সামিল হচ্ছে, রাস্তা অবরোধ করছে, পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছে৷ শুধু উত্তরপ্রদেশেই পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জন প্রতিবাদীর৷ কর্ণাটকে ২ জন, আসামে মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের৷ বাস্তবে এমন দেশজোড়া আন্দোলন দেশ দেখেনি বহুদিন৷ সাতের দশকের গোড়ায় কংগ্রেসের দুর্নীতি এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে এক বিরাট আন্দোলন ফেটে পড়েছিল৷ কিন্তু তা এবারের মতো এমন দেশজোড়া চেহারা নেয়নি৷ দিশাহারা হয়ে পড়ছেন নরেন্দ্র মোদি–মিত শাহরা, বিজেপি নেতারা৷ দিশাহারা হয়েই তাঁরা মিথ্যা বলছেন, সত্য–মিথ্যায় মিশিয়ে বলছেন, ক্রমাগত কথা বদলাচ্ছেন৷ শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, অন্য মন্ত্রীদেরও এই মিথ্যাচারে সামিল করেছে দল৷ যেমন অর্থমন্ত্রী সীতারামন বলেছেন, যে এনআরসি শুরুই হয়নি, তার সাথে যেভাবে নাগরিকত্ব আইনকে (সিএএ) যুক্ত করা হচ্ছে তাতে তিনি বিস্মিত৷ আর একজন প্রবীণ মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদও একই কথা বলেছেন৷ তাঁরা বলছেন, সিএএ–র সাথে তো মুসলিমদের কোনও সম্পর্ক নেই, তবে তারা কেন প্রতিবাদ করছে? কখনও বলছেন, সিএএ নাগরিকত্ব কাড়ার আইন নয়, নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন৷

এইসব মন্ত্রীরা এমন ভাব করছেন যেন তাঁরা সত্যিই এই দুই আইনের মধ্যে সংযোগ বোঝেন না৷ বাস্তবে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তাঁরা তাঁদের দলের সভাপতি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেরই বিরোধিতা করছেন৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এ ব্যাপারে কখনওই ভুল বোঝার কোনও অপেক্ষা রাখেননি৷ গত ১ মে পশ্চিমবাংলার বনগাঁর এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা প্রথমে পাস করাব নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, তারপরেই হবে এনআরসি৷’’ ২৩ এপ্রিল দলেরই একটি ইউটিউব চ্যানেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘প্রথমে নিয়ে আসা হবে ক্যাব৷ এর মধ্য দিয়ে শরণার্থীরা সবাই নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন৷ তারপর নিয়ে আসা হবে এনআরসি৷ ফলে শরণার্থীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই৷ উদ্বিগ্ন হবে অনুপ্রবেশকারীরা৷ এই দুইয়ের ক্রমটা বুঝুন৷’’ এ রাজ্যে রায়গঞ্জের একটি সভায় ১১ এপ্রিল তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা সারা দেশে এনআরসি চালু করব৷ আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ছাড়া বাকি প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্ণিত করে বহিষ্কার করব৷’’

এত স্পষ্ট করে বলা সত্ত্বেও বিজেপির যে নেতা–মন্ত্রীরা এখন উল্টো কথা বলছেন, তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য যে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করা, এ নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ থাকতে পারে কি?

বিজেপি–এজিপির দাবি আসামে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এনআরসি শুরু হয়েছিল৷ সেদিন বিজেপি নেতারা আসামের হিন্দুদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, এনআরসিতে তাদের কোনও ভয় নেই৷ শুধুমাত্র মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরাই এর দ্বারা নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়বে এবং সেই সংখ্যাটা কমপক্ষে ৫০–৬০ লক্ষ৷ বাস্তবে দেখা গেল, বাদ পড়া ১৯ লক্ষ মানুষের মাত্র ২ লক্ষ ৮০ হাজার মুসলমান, বাকিরা বেশির ভাগই হিন্দু বাঙালি এবং আসামের জনজাতি–আদিবাসী৷ এই ঘটনায় হিন্দুরা, জনজাতি–আদিবাসীরা বিজেপি–বিরোধী ক্ষোভে ফুঁসে উঠল৷ বেকায়দায় পড়ে গেলেন বিজেপি নেতারা৷ ভোটব্যাঙ্ক বাঁচানোর তাগিদে বিজেপি নেতারা দাবি তুললেন, আসামের এই এনআরসি বাতিল করতে হবে৷ বাদ পড়া হিন্দুদের ক্ষোভ সামাল দিতে দিল্লির নেতারা তড়িঘড়ি নিয়ে এলেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন৷ বললেন, বাদ পড়া হিন্দুরা সবাই এই আইনে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন৷ এর পরেও কি কারও বুঝতে অসুবিধা হবে দুই আইনের সংযোগ কোথায়? যাঁরা এই কয়েক মাস আগে নিজেদের যথার্থ ভারতীয় নাগরিক হিসাবে নানা রকম তথ্য সরকারি দপ্তরে জমা দিয়েছেন, তাঁরা এখন আবার কেন নিজেদের শরণার্থী বলে দাবি করবেন? এভাবেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্যাঁচে ফেলে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির খেলায় মেতেছেন বিজেপি নেতারা৷

বিজেপি নেতাদের আর এক লক্ষ্য পশ্চিমবাংলার গদি৷ ’২১ সালেই বিধানসভা নির্বাচন৷ কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে নানা কারণে বিজেপির পক্ষে যে সমর্থন ছিল, বিজেপি নেতারাও বুঝেছেন, কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতার ফলে এই সমর্থনে ভাল রকম ভাটার টান ধরেছে৷ তা হলে উপায় কী? উপায় বিজেপির অত্যন্ত পুরনো এবং পরিচিত অস্ত্রটিরই প্রয়োগ– ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করা৷ তার জন্য দ্রুত সংশোধন করা হল নাগরিকত্ব আইন৷ উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করা৷

আসামে লাখে লাখে হিন্দুদের নাগরিকত্ব চলে যাওয়ার ঘটনা এ রাজ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল আশঙ্কা তৈরি করেছে৷ বাস্তবে আসামে এনআরসির নামে মানুষের ব্যাপক হয়রানি, আর্থিক বোঝা এবং সাম্প্রদায়িক লক্ষ্যে তার পরিচালনা সারা দেশে এনআরসির সত্যিকারের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়েই জনমনে শুধু প্রশ্নই তুলে দেয়নি, তাদের আতঙ্কিতও করে তুলেছে৷ এই রকম অবস্থায় পড়েই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বিজেপি নেতারা বলতে শুরু করেছেন, এনআরসি আর সিএএ–র মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই৷

বিজেপি নেতারা মানুষকে যা–ই বোঝান, বাস্তবে এই আইন কি সত্যিই দেশভাগের শিকার ছিন্নমূল মানুষদের সবাইকে এবং তাঁদের সন্তানসন্ততি ও পরবর্তী প্রজন্মকে তাঁদের আকাঙ্খিত নাগরিকত্ব দিতে সক্ষম? অমিত শাহরা ঘোষণা করেছিলেন, ওই আইনে তিন প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অ–মুসলিমদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেবে সরকার৷ কিন্তু এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানাচ্ছে, সব শরণার্থী নাগরিকত্ব পাবেন না৷ প্রতিটি শরণার্থীকে অনলাইনে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাতে হবে৷ কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে৷ বলা হয়েছে, যাঁরা ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে পালিয়ে এসেছেন, তাঁদেরই এই সংশোধিত আইনে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে৷ শরণার্থীর আবেদনের সত্যতা বিচার করে দেখবে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং বা ‘র’ (আবাপ– ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯)৷ স্বাভাবিক ভাবেই সকলেই নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন, বিজেপি নেতাদের এই দাবি যে আদৌ সত্য নয়, এটা মানুষের কাছে ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷

প্রশ্ন উঠছে, দেশের ১৩০ কোটি মানুষকে মোদি–শাহর খাম–খেয়ালে নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিতে হবে কেন? এতদিন যারা ভোট দিয়ে দেশের সরকার গঠন করেছেন তারা কি দেশের নাগরিক নন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, না৷ ভোটারদের নাগরিক হিসাবে গণ্য করা যাবে না৷ তাঁর বক্তব্য, ‘পকেটে ভোটার কার্ড বা আধার যাই থাকুক তা প্রমাণ করবে না আপনি আমি এ দেশের নাগরিক’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮–১২–২০১৯)৷ কিন্তু অমিত শাহর এই বক্তব্য তো দেশের প্রচলিত আইনেরই পরিপন্থী৷ কারণ, দি রিপ্রেজেন্টেশন অফ দি পিপল অ্যাক্ট ১৯৫০–এর ১৬নং ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, ‘‘এ পারসন শ্যাল বি ডিসকোয়ালিফায়েড ফর রেজিস্ট্রেশন ইন অ্যান ইলেক্টোরাল রোল ইফ হি ইস নট এ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া৷’’ অর্থাৎ একজন ব্যক্তি ভারতের নাগরিক না হলে তার নাম ভোটার লিস্টে উঠবে না৷ এর অর্থ হল, ভোটার লিস্টে নাম তখনই থাকতে পারে যখন একজন ব্যক্তিকে ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য করা হবে৷ তাই ভোটার কার্ড নিঃসন্দেহে একজন ব্যক্তির নাগরিকত্বের প্রমাণ– দেশের প্রচলিত আইন তাই বলছে৷ নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহরা একে গায়ের জোরে অস্বীকার করতে পারেন না৷

এখন তর্কের খাতিরে যদি অমিত শাহর বক্তব্যকে সঠিক বলে ধরা হয় তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে? যারা ভোটার তারা নাগরিক নন, এই যদি মনে করা হয় তবে তো বলতে হবে অনাগরিকদের ভোটে সরকার তৈরি হয়েছে৷ দেশের সব সরকারই অনাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত সরকার৷ এমনকী প্রধানমন্ত্রী মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা ভারতের পার্লামেন্ট সবই তো অনাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত৷ তা হলে অনাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত একটা সরকারই তো বেআইনি৷ সেই সরকার দেশের নাগরিকত্ব নির্ধারণের আইন তৈরি করছে কীভাবে? তাদের কি সেই অধিকার আছে? আসলে মুসলিম বিদ্বেষে জারিত মন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে স্বৈরাচারী মদমত্ততায় সমগ্র বিষয়টাকে দেখতে গিয়ে মোদি–শাহ জুটি সাধারণ বিচারবোধ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন৷

একের পর এক স্ববিরোধী কথা বলছেন বিজেপি সভাপতি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ৷ বলছেন, নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে কোনও কাগজপত্র লাগবে না৷ ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তান থেকে এলেই হিন্দু, শিখ ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী মানুষরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন৷ অমিত শাহ এ কথা বললেও তাঁর স্বরাষ্ট্র দপ্তর অন্য কথা বলছে৷ বলেছে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের ছ’টি অমুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠীর শরণার্থী আপনা আপনি ভারতের নাগরিকত্ব পাবে না৷ একজন শরণার্থীকে অনলাইনে দরখাস্ত করতে হবে এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বিচার বিবেচনা করে দেখবেন যে তিনি রেজিস্ট্রেশন বা ন্যাচারালাইজেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত শর্তাবলি পূরণ করেছেন কি না৷ (দ্য হিন্দু, ১৭–১২–২০১৯) এই প্রয়োজনীয় শর্তাবলি কী? এই আইনের ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে, যে শরণার্থী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন তাঁকে ভারতের নাগরিকত্ব আইনের ৫নং ধারায় যেসব শর্ত আছে তা পূরণ করতে হবে অথবা ন্যাচারালাইজেশন প্রক্রিয়ার থার্ড সিডিউলে যেসব শর্ত আছে তা পূরণ করতে হবে৷ ৫নং ধারা অনুযায়ী, একজন শরণার্থীকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত৷ আর তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রমাণ করার জন্য প্রমাণ করতে হবে তিনি বা তার পিতা–মাতার একজনের জন্ম অবিভক্ত ভারতে৷ এই শর্ত কয়জন শরণার্থী পূরণ করতে পারবেন? এটা কি শরণার্থীদের প্রতি কোনও মানবিক আচরণ?

আর ন্যাচারালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় কী শর্ত দেওয়া আছে? সেখানে বলা আছে, যিনি শরণার্থী হিসাবে ন্যাচারালাইজেশন প্রক্রিয়ায় আবেদন করবেন তাঁকে বলতে হবে, ‘যদি তাঁর নাগরিকত্বের আবেদন গৃহীত হয়, তবে তিনি বর্তমানে যে দেশের নাগরিক সেই দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করবেন৷’ অর্থাৎ শুরুতেই তাঁকে বলতে হবে যে তিনি বিদেশি এবং তাঁকে তা আদালতে হলফনামা দিয়েই বলতে হবে, মুখে বললে চলবে না বা শুধু লিখে দিলেই হবে না৷ এইভাবে ঘোষণা করার পর তাঁকে দু’জন ভারতীয় নাগরিক জোগাড় করতে হবে যাঁরা তাঁর চরিত্রের শংসাপত্র দেবেন এবং তাঁকে একটা স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে এই মর্মে শংসাপত্র জোগাড় করতে হবে যে, যে কোনও একটা প্রধান ভারতীয় ভাষা তিনি লিখতে বা পড়তে পারেন৷ পড়তে এবং লিখতে পারার মতো সুযোগ থেকে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা আজও আমাদের দেশে বিস্তর৷ এই মানুষগুলির কী হবে? তা ছাড়া, এইসব কাগজপত্র জোগাড় করে সরকারি দপ্তরে জমা দেওয়ার পরেই কি তাঁর নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট মিলবে?

না, মিলবে না৷ কারণ তাঁর দরখাস্ত প্রথমে জমা পড়বে জেলা শাসকের দপ্তরে৷ তিনি যদি মনে করেন যে আবেদনকারী চরিত্রবান এবং ভারতের নাগরিক হওয়ার যোগ্য তা হলে তিনি সেই দরখাস্ত রাজ্য সরকারের কাছে পাঠাবেন৷ তারপর সেখানে হবে আর একপ্রস্থ তদন্ত৷ এই তদন্তে যদি আবেদনকারী উতরে যেতে পারেন তবে তাঁর আবেদন যাবে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় দফতরে৷ সেখানে আরেক প্রস্থ তদন্ত হবে৷ সেখানেও যদি তিনি পাশ করতে পারেন তবেই তাঁর ভাগ্যে শিকে ছিড়বে৷ তিনি নাগরিকত্ব পাবেন৷

বুঝতে অসুবিধা হয় না, প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ এবং জটিল৷ কতদিনে এই প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা আইনে নেই৷ আসামের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ৩ কোটি মানুষের এনআরসি প্রক্রিয়া সরকার ৫ বছরেও শেষ করতে পারেনি৷ এখানে কোটি কোটি মানুষের আবেদন এই দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া সরকার রাতারাতি শেষ করে দেবে এই চিন্তা বাতুলতা৷ ফলে একজন শরণার্থীর আবেদন নিষ্পন্ন করে তার হাতে নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট যতদিন সরকার তুলে দিতে না পারবেন ততদিন তাকে নাগরিক অধিকারহীন হয়েই থাকতে হবে৷ আবার এই প্রক্রিয়ায় আপনি নাগরিকত্ব পাবেনই তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই৷ তদন্তের যে–কোনও পর্যায়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে আবেদনকারী নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য নন, তবে তাঁর কিছু করার থাকবে না৷ তিনি নাগরিকত্ব পাবেন না৷ বাদবাকি জীবনটা তাকে অনাগরিক হয়েই থাকতে হবে৷ তাই, এই সমগ্র পর্যায়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার জন্য নানা স্তরের সরকারি কর্তাদের মন জুগিয়ে শরণার্থীদের চলতে হবে৷

বিজেপির হিসাব হল কোটি কোটি মানুষ আবেদন করার পর তা ঝাড়াই বাছাই করতে করতেই তো কয়েক বছর কেটে যাবে এবং ততদিন পর্যন্ত যারা আবেদন করবে তারা একেবারে বিজেপির পকেটে চলে যাবে, বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক পুষ্ট করবে৷ বিশেষ করে ওদের লক্ষ্য হল পশ্চিমবঙ্গ৷ ওরা মনে করছে, এর ফলে পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজন বিজেপিকে ধন্য ধন্য করবে এবং আগামী নির্বাচনে ভোট দিয়ে তাদের একেবারে পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বসিয়ে দেবে৷ কিন্তু বিজেপি’র এই পরিকল্পনা সফল হবে না৷ কারণ, পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজন নিজেদের বিদেশি বলে ঘোষণা করবেন না, নিজেদের বিজেপি ও সরকারি কর্মকর্তাদের করুণার পাত্রে পরিণত করবেন না৷ পশ্চিমবাংলার সাধারণ মানুষ, ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলনের জোয়ার সেটাই প্রমাণ করে৷ ফলে এই রাজ্যের সাধারণ মানুষ যাঁরা দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে বসবাস করছেন, ভোটার কার্ড সহ অন্যান্য নাগরিক অধিকার ভোগ করছেন তাঁদের কাছে বিজেপির ষড়যন্ত্র ক্রমাগত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে৷ স্বভাবতই বিজেপির পরিকল্পনা মতো তাঁরা যে নতুন আইন অনুযায়ী আবেদন করবেন না, এতে কোনও সন্দেহ নেই৷ এবং এইভাবেই তাঁরা বিজেপির ঘৃণ্য চক্রান্তকে প্রতিহত করবেন৷

দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ বিজেপি সরকারের এই স্বৈরাচারী কার্যকলাপের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছে৷ কিন্তু বিজেপি একটি সংগঠিত দল এবং অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিকই উগ্র হিন্দুত্বের আবেগ উস্কে দিয়ে তারা এই ষড়যন্ত্র কার্যকর করতে নেমেছে৷ ফলে এর মোকাবিলা শুধু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হতে পারে না৷ এর জন্য প্রতিবাদীদেরও অত্যন্ত সংগঠিত এবং সুশৃঙ্খল হতে হবে৷ আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী করে গড়ে তুলতে এলাকায় এলাকায় ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের কমিটি গড়ে তুলতে হবে৷ এই আন্দোলনকে স্বাভাবিকভাবেই ভোটবাজ দলগুলি ভোটরাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইবে৷ প্রতিবাদী মানুষকে সচেতন থাকতে হবে যাতে তাঁরা তার শিকার না হন৷ কমিটির নেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এই আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে৷ সেই লক্ষ্যেই আন্দোলনগুলিতে সচেতন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২০ সংখ্যা)