অর্থনীতি বেহাল, সরকার ব্যস্ত দায় এড়াতে

প্রবাদ আছে, ঝড় এলে উটপাখি তার বিরাট দেহটা লুকোতে না পেরে শুধু মুখটুকু বালিতে গুঁজে দিয়েই ভাবে সে রক্ষা পেল! দেশের মন্দা কবলিত অর্থনীতি নিয়ে বিজেপির বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কথাটি মনে পড়ছে৷ ১৩০ কোটি মানুষের দেশে কেন্দ্রীয় সরকার যদি শুধু নিজেদের চোখটুকু বুজে রেখেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটকে মায়া বলে উড়িয়ে দিতে চায়, তা হলে তাকে কী বলবেন? তাকে কি কোনও দায়িত্বশীল সরকার বলবেন? এটা কি দেশের মানুষের স্বার্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা নয়?

দেশ–বিদেশের অর্থনীতিবিদ থেকে সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মোদি রাজত্বে অর্থনীতির হাল ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে৷ আর্থিক বৃদ্ধির হার চলতি অর্থবর্ষে প্রথম ত্রৈমাসিকে ৫ শতাংশ থেকে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে নেমে এসেছে ৪.৫ শতাংশে৷ মন্দা গ্রাস করেছে গোটা অর্থনীতিকে৷ চরম দুর্ভোগে পড়েছে দেশের মানুষ৷ জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে৷ মানুষের হাতে কাজে নেই৷ বেকার সমস্যা গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে৷ ক্রমাগত কমছে আয়৷ খাদ্য–শিক্ষা–চিকিৎসা মতো অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রগুলিতেও ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ৷ মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই৷ মুনাফা অটুট রাখতে, কখনও এমনকি তা আরও বাড়িয়ে নিতে ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিপতিরা৷ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে ঠেকায় শিল্পপণ্য থেকে খাদ্য সব কিছুর বিক্রি কমছে৷ ফলে উৎপাদন কমছে৷ এমনকি মোটরগাড়ির মতো শিল্প, যার ক্রেতা উচ্চ মধ্যবিত্তরা, সেখানেও মন্দা মারাত্মক ছোবল বসিয়েছে৷ শিল্পমালিকরা একের পর এক শিফট বন্ধ করে দিচ্ছে, ছেঁটে ফেলছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক–কর্মচারীকে৷ 

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে পণ্য বিক্রি না হওয়াই এই মন্দার মূল কারণ৷ অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষের কেনার ক্ষমতা নেই৷ কিন্তু কেন মানুষের কেনার ক্ষমতা নেই? কেন তা কমে গেল? এর জন্য দায়ী কে? দায়ী কি সাধারণ মানুষ? বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিজেপি সরকারের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী নীতিই এর জন্য পুরোপুরি দায়ী৷ না হলে তো সরকার জনগণের কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চেষ্টা চালাতো, তা চালাচ্ছে কি? বাস্তবে যে পদক্ষেপগুলি সরকার নিচ্ছে তার কোনওটির সাথেই দেশের সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়ার কোনও সম্পর্ক নেই৷

প্রথমত, অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নেমে যাওয়া, প্রধান পরিকাঠামো ক্ষেত্রগুলিতে উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যাওয়া, গত ৪৫ বছরে কর্মসংস্থানের হার একেবারে তলানিতে চলে যাওয়া, খাদ্য–শিক্ষা–চিকিৎসা সাধারণ মানুষের ব্যয় অভূতপূর্ব হারে কমে যাওয়া সত্ত্বেও সরকার ও তার মন্ত্রীরা মন্দার কথা অস্বীকার করে চলেছেন৷ সরকারি সমীক্ষাতেই মন্দার ভয়াবহ চিত্র উঠে আসছে৷ অথচ তাকে ক্রমাগত গোপন করা হচ্ছে৷ সরকারের মন্ত্রী–আমলারা বাস্তবটা না দেখার ভান করে বলে চলেছেন, ‘সব ঠিক হ্যায়’৷ দ্বিতীয়ত, মন্দা মোকাবিলার নামে তাঁরা যা করছেন তা হল, শিল্পপতি–পুঁজিপতিদের– যাদের সমর্থন ও টাকার জোরে তারা ক্ষমতায় বসেছে, তাদের মুনাফার ভাণ্ডার ভরিয়ে দিতে সরকারি কোষাগার ফাঁকা করে ‘কর ছাড়’ ‘ত্রাণ প্রকল্প’ প্রভৃতি নানা নামে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিতরণ করে চলেছে৷ পুঁজিপতিদের আবদার মেনে নিয়ে কর্পোরেট করে সরকার ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ছাড় ঘোষণা করেছে৷ গাড়ি শিল্পকে ১ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজ দিয়েছে৷ আবাসন প্রকল্পগুলির আবদার মেনে ২৫ হাজার কোটি টাকার ফান্ড গড়ে দিয়েছে৷ টেলিশিল্পগুলির আবদার মেনে তাদের কাছে সরকারের ন্যায্য পাওনা ১.৩৩ লক্ষ কোটি টাকা, যা সুপ্রিম কোর্ট তিন মাসের মধ্যে মিটিয়ে দিতে বলেছিল, সরকার তা দু’বছরের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে৷ অন্য দিকে সাধারণ মানুষের উপর মূল্যবৃদ্ধি, করবৃদ্ধির বোঝা চাপিয়ে ফাঁকা কোষাগারকে ভরে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ একের পর এক বেচে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প এবং সম্পত্তিগুলি৷

অথচ মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন ছিল দেশের বাজারের যারা প্রধান ক্রেতা সেই কৃষক–শ্রমিক–সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান নিশ্চিত করে, সার–বীজ–কীটনাশকে দাম কমিয়ে তাদের কেনার ক্ষমতা বাড়ানো৷ প্রয়োজন ছিল, দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ যে কৃষির সঙ্গে যুক্ত সেখানে কালোবাজারি মজুতদারি, আড়তদারি, কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ বন্ধ করে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার ব্যবস্থা করা৷ শ্রমিকদের সব চেয়ে বড় যে অসংগঠিত অংশ তাদের ন্যায্য মজুরি পাওয়ার গ্যারান্টির ব্যবস্থা করা৷ অথচ সরকার এ সব কোনও কিছুই করছে না৷ কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছে৷ কালোবাজারি, মজুতদাররা জলের দামে কৃষিদ্রব্য কিনে নিয়ে লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা করছে৷ আলু, পেঁয়াজের অগ্ণিমূল্য তার জ্বলন্ত উদাহরণ৷ সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে৷ সরকার একের পর শ্রমিক স্বার্থবিরোধী আইন নিয়ে আসছে৷ কাজের স্থায়িত্ব, মজুরি কোনও কিছুর গ্যারান্টি থাকছে না৷ স্বাভাবিক ভাবেই শ্রমিক–কৃষকের কেনার ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে৷ এই অবস্থায় মালিকদের সিন্দুকে যতই টাকা ভরে দিক তাতে উৎপাদন বাড়তে পারে না৷ কারণ বাজারে ক্রেতা না থাকলে কোনও মালিক উৎপাদন করবে না, তা তার হাতে যত পুঁজিই থাকুক৷ অর্থাৎ সরকারের জনবিরোধী নীতিই বর্তমান ভয়াবহ মন্দার জন্য দায়ী৷ অথচ এর দায় বহন করতে হচ্ছে দেশের শ্রমিক–কৃষক সহ সাধারণ মানুষকে৷ তাদেরই আজ অর্ধাহারে, অনাহারে বিনা চিকিৎসায় দিন কাটাতে হচ্ছে৷

সরকারের এই জনবিরোধী নীতির কুফল যা দেশের মানুষের উপর বর্তেছে তা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘোরাতে বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা প্রথমে ৩৭০ ধারাকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু করে তুলে দেশ তোলপাড় করলেন৷ তার ঢেউ কমতেই রামমন্দির নির্মাণকে মানুষের জীবন–মরণ সমস্যায় পরিণত করে দিলেন৷ যখন দেখলেন তাতেও কাজ হচ্ছে না, তখন দেশজুড়ে এনআরসি করার কথা ঘোষণা করে চলেছেন৷ দেশে অনুপ্রবেশকারী খুঁজতে গোটা জাতিকে নাগরিকত্ব প্রমাণের পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছেন৷ কিন্তু অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না৷ কেন্দ্রীয় সরকার না দেখতে চাইলেও এটাই যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিণাম দেশের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এবং এটা নিশ্চিত যে তারা তা চুপচাপ মেনে নেবেন না৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৭ সংখ্যা)