অযোধ্যা রায় — ন্যায়বিচারের চরম প্রহসন : প্রভাস ঘোষ

বাবরি মসজিদ–রাম জন্মভূমি বিতর্কে সুপ্রিম কোর্টের ৯ নভেম্বরের রায় প্রসঙ্গে এস ইউ সি আই (সি)–র সাধারণ সম্পাদক শ্রী প্রভাস ঘোষ ১০ নভেম্বর নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়েছেন৷

মন্দির–মসজিদ বিরোধে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় সহ যে কোনও কাজ বা ঘটনাকে সঠিক ভাবে বিচার করতে হলে আবেগমুক্ত মন এবং ইতিহাসনির্ভর, বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য প্রয়োজনীয়৷  সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসার আগে কিছু প্রশ্ন গভীরভাবে বিবেচনা করা দরকার৷

১) অতীতকালে মহর্ষি বাল্মিকী তাঁর কাব্যগ্রন্থে রামকে ঈশ্বরের অবতার বলে দেখান৷ এ–ও বলা হয়ে থাকে যে, রামের জন্মের বহু আগেই বাল্মিকী তাঁর মহাকাব্যে রামের জন্মের কথা বলেছেন এবং রাজা দশরথের রাজপ্রাসাদকে জন্মস্থান হিসাবে দেখিয়েছেন, পরবর্তী কালে যেখানে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয় সেই স্থানকে দেখাননি৷

২) বাবরি মসজিদ নির্মিত হয় ১৫২৮ সালে৷ সেই সময় কেউই এই স্থানটিকে রামের জন্মস্থান বলে দাবি করে কোনও আপত্তি তোলেননি৷ এমনকী কবি তুলসীদাস, যিনি ১৫৭৪–৭৫ সালে রামচরিতমানস লিখে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রামকে জনপ্রিয় করেছেন, তিনিও রামচরিতমানসে কোথাও বলেননি যে, রামের জন্মস্থানেই ওই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে৷

৩) চৈতন্য, রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দের মতো হিন্দু ধর্মের শ্রদ্ধেয় প্রবক্তারা কখনওই কোথাও এ কথা বলেননি যে, রামের জন্মস্থানেই বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে৷ বিবেকানন্দ এমনকি রামের ঐতিহাসিক বাস্তবতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন৷

৪) তিনশো বছর ধরে কোনও বিসংবাদ ছাড়াই বাবরি মসজিদের অস্তিত্ব থাকার পর ব্রিটিশ শাসনে ১৮৮৫ সালে কিছু হিন্দু পুরোহিত এ নিয়ে বিতর্ক তোলেন৷ কিন্তু তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের পক্ষে কোনও সুনির্দিষ্ট বা গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দিতে পারেননি৷ সিপাহি বিদ্রোহের পর হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে বিরোধ বাধানোর জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা ওই বিতর্ক বা বিরোধ উত্থাপন করতে মদত দেয়৷

৫) ওই স্থানে নমাজ পাঠ বন্ধ করার জন্য ১৯৪৯ সালে রাতের অন্ধকারে মসজিদ প্রাঙ্গণে গোপনে রামের মূর্তি বসিয়ে দেওয়া হয়৷ কংগ্রেস নেতা ও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৬ সালে মসজিদের পিছন দিকের বন্ধ দরজা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন৷ কংগ্রেসের ভোট রাজনীতির পাল্টা হিসাবে এবং হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক পুরো দখলের উদ্দেশ্যে বিজেপি–সংঘ পরিবার ১৯৯০ সালে রামরথযাত্রা সংগঠিত করে, যা সারা দেশে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বালায় এবং তারাই ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করে দেয়৷

৬) বর্তমান অযোধ্যার পুরাতাত্ত্বিক অতীত সম্পর্কে পাওয়া তথ্যাদি নিয়ে পুরাতত্ত্ববিদদের মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে৷ এমনকি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের যে বিশেষ রিপোর্টটির উপর নির্ভর করে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রায় দান করেছেন বলে বিচারপতিরা জানিয়েছেন, সেই বিশেষ রিপোর্টের দ্বারাও এ কথা প্রমাণ হয় না যে, ওটা রামের জন্মস্থান ছিল এবং তার উপরই অভিযোগ অনুযায়ী মসজিদ নির্মিত হয়েছে৷ তা ছাড়া অতীতে বহু এ ধরনের কাঠামো যত্রতত্র ছিল যার সবগুলিই কালক্রমে মাটির নিচে চলে গিয়েছে৷ কখনও খননের সময় এইসব কাঠামোর কিছু কিছু পাওয়া যায় এবং তখন তাদের সম্পর্কে বহু রকমের পুরাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়৷ এমনকি এরকম প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে, বহু বৌদ্ধ মন্দির ও স্তূপকে ধ্বংস করে সেখানে হিন্দু মন্দির বানানো হয়েছিল৷ এর ভিত্তিতে যদি কেউ এখন দাবি করে ওই সব হিন্দু মন্দির ভেঙে ফেলে সেখানে বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করতে হবে, তবে সেটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে?

৭) ১৯৪৯ সালে গোপনে রামমূর্তি বসিয়ে দেওয়া এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, দুটিকেই সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে এবং এ কথাও বলেছে যে, কোনও মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়নি৷ রায়ে এ কথাও বলা হয়েছে যে, ‘শাস্ত্রের ব্যাখ্যাগুলো থেকে অসংখ্য সিদ্ধান্ত টানা যায়৷’ অথচ বিস্ময়কর ভাবে সিদ্ধান্ত করা হল যে, ‘কোর্ট যদি একবার এমন কোনও প্রকৃত উপাদান পায় যার দ্বারা বোঝা যায় ওই বিশ্বাস বা আস্থা মেকি নয়, বরং যথার্থ, তবে ওই বিশ্বাসে পূজারীদের সম্মান জানাতে কোর্ট বাধ্য’৷ এ কথার উপরই নির্ভর করে তাঁরা রায় দিলেন যে, সমগ্র বিতর্কিত ভূখণ্ডই একটি ট্রাস্টের হাতে তুলে দেওয়া হবে, যাঁরা সেখানে রামমন্দির নির্মাণ করবেন এবং মুসলিমদের দেওয়া হবে মসজিদ তৈরির জন্য আলাদা পাঁচ একর জমি৷ এই রায় দেখে মনে হয় এ যেন সংঘ পরিবারের হাতে একটি পুরস্কার  প্রদান এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি করুণা প্রদর্শন৷

এই রায় স্বভাবতই বিজেপি এবং সংঘ পরিবারকে উৎফুল্ল করেছে এবং তারা ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো একটি জঘন্য কাজের আইনি ন্যায্যতা লাভ করল এই রায়ের দ্বারা৷ কিন্তু দেশের গণতন্ত্রপ্রিয়, ধর্মনিরপেক্ষ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে এই রায় অত্যন্ত উদ্বেগ ও আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে এবং ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতা সম্পর্কে গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছে৷

আমরা মনে করি, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় আইনের সকল বিধি–বিধান এবং বিচার ব্যবস্থার সকল নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে কার্যত ন্যায়বিচারের চরম প্রহসন ঘটিয়েছে৷ আজ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক আইনশাস্ত্রের ইতিহাসে কোথাও কখনও ধর্মীয় বিশ্বাসকে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়নি৷ ফলে এই রায় ধর্মীয় উন্মাদনাকে উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ও বিপজ্জনক নজির হয়ে থাকবে৷

আমাদের এই বক্তব্যগুলিকে গভীর ভাবে বিবেচনা করে, গণতান্ত্রিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ ও বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতার উপর আক্রমণ প্রতিহত করা এবং জনগণের ঐক্য রক্ষা করার জন্য আমরা জনসাধারণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৪ সংখ্যা)