অবাধ বাণিজ্যের আওয়াজ ভুলে বিশ্বে ফিরছে শুল্কের প্রাচীর

এ কী কথা শুনি আজ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে!

আমেরিকা তুলছে শুল্ক প্রাচীর অবিশ্বাস্য ব্যাপার৷ অবাধ বাণিজ্যের জয়গানই তো এত দিন শুনে এসেছে বিশ্ববাসী মার্কিন কর্তাদের মুখে৷ বিশ্বায়নের মাধ্যমে অবাধ বাণিজ্য আর উদার অর্থনীতির যে সর্বরোগহর ভূমিকার কথা তাঁরা বলেছিলেন, সে–সব কি তবে বিলকুল ভুল? নাকি জেনেশুনেই তাঁরা সেদিন মিথ্যা বলেছিলেন?

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সে দেশে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের আমদানির উপর যথাক্রমে ২৫ ও ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর কথা ঘোষণা করেছেন৷ তাঁর দাবি, এই ঘোষণা মার্কিন উৎপাদনকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতেই৷ যদিও যথারীতি তার সাথে গুঁজে দেওয়া হয়েছে এই সব শিল্পে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার কথা৷ মালিক শ্রেণি চিরকাল যা করে থাকে৷ চিন সহ বিভিন্ন দেশ নাকি অবাধে অনেক সস্তায় এই দুটি পণ্য আমেরিকায় রপ্তানি করছে৷ তাতে মার্কিন উৎপাদনকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে৷ ভাল কথা৷ কিন্তু একদিন তো এই আমেরিকাই বিশ্বের এমনকী দুর্বল দেশগুলিকেও গ্যাট চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে, ডব্লুটিওতে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল৷ বলেছিল, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মধ্য দিয়ে বিশ্বে একটি কমন ফ্রি মার্কেট বা সাধারণ মুক্ত বাজার গড়ে তোলা হচ্ছে, যা ছোট–বড় উন্নত–নুন্নত সকল রাষ্ট্রের স্বার্থেই কাজ করবে৷ বিপরীতে দুর্বল দেশগুলির পক্ষ থেকে এ কথা বারবার উঠেছিল যে এর দ্বারা শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলি থেকে নানা পণ্য অবাধে কম শক্তির দেশগুলিতে ঢুকবে এবং সেই দেশের অপেক্ষাকৃত দুর্বল উৎপাদনকারীরা প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে না পেরে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে৷ একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজিপতিরা বিশ্বজুড়ে বাজারের দখল নিয়ে অবাধে শোষণ–লুণ্ঠন চালাবে এবং এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে আর তার বোঝা চাপবে সাধারণ মানুষের উপর৷ সেদিন কিন্তু মার্কিন কর্তারা সেই আর্তিতে কান দেননি৷ কারণ সেদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নটিই ছিল তাঁদের কাছে মুখ্য৷

কিন্তু চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়৷ সেদিন এই তথাকথিত অবাধ বাণিজ্য নীতির দ্বারা আমেরিকা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল৷ আমেরিকা তার পুঁজির শক্তির জোরে পুঁজি এবং পণ্য নিয়ে বন্যার জলের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিতে ঢুকে পড়েছিল৷ অবশ্য দুর্বল দেশগুলিরও একদল একচেটিয়া পুঁজিপতি, যারা সে দেশের সাধারণ মানুষকে শোষণ করে পুঁজির পাহাড় জমিয়েছে, তাদেরও লক্ষ্য ছিল এই চুক্তি থেকে অতিরিক্ত ছিটেফোঁটা গুছিয়ে নেওয়া৷ ইতিমধ্যে বিশ্ববাণিজ্যে উল্কাগতিতে উঠে এসেছে চীন৷ রফতানি বাণিজ্যে আমেরিকাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে সে৷ চীনের সাথে তার বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে জানিয়েছে আমেরিকা৷ আর এতেই আমেরিকা অবাধ বাণিজ্যের ভালমানুষী ভোল ঝেড়ে ফেলে স্বমূর্তি ধারণ করেছে৷ বলছে, আমেরিকা ফর আমেরিকানস৷ কিন্তু আমেরিকা বলেই তো আর বিশ্ব চিরকাল তার কথায় ওঠবোস করবে না৷ ইউরোপ–এশিয়ার উঠতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের বাণিজ্যিক ক্ষতি মানবে কেন? ফলে বিশ্বের আকাশে বাণিজ্য–যুদ্ধের কালো মেঘ৷ অন্য দেশগুলিও শুল্কের প্রাচীর তুলে নিজেদের দেশে বিদেশি পণ্যের আমদানি আটকানোর প্রতিযোগিতায় নামতে চলেছে৷

সারা বিশ্ব আমেরিকার এই শুল্ক–নীতির তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে৷ তাদের বক্তব্য, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত ডব্লিউটিও–র ঘোষিত অবাধ তথা মুক্ত বাণিজ্য–নীতির বিরোধী৷ আরও অন্য বহু ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও আমেরিকা আন্তর্জাতিক নীতিকে গায়ের জোরে লঙঘন করতে চাইছে৷ চীন অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছে আমেরিকাকে৷ বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তিতে ট্রাম্প শুল্ক্ বসালে বিপন্ন হতে পারে ডব্লিউটিও–র অস্তিত্ব৷ ক্ষিপ্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইরকি কাতাইনেন বলেছেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন, তবে আমরাও যোগ্য জবাব দিতে প্রস্তুত৷’ তারা মার্কিন ব্র্যান্ডের মোটর বাইক, জিনস সমেত আমেরিকা থেকে আসা ৩৫০ কোটি ডলারের পণ্যের উপরে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর ভাবনার কথা ঘোষণা করেছে৷ জার্মানি, জাপানও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে৷ আইএমএফ সতর্কবার্তা ঘোষণা করেছে, এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে বিঁধতে পারে মার্কিন অর্থনীতিকেই৷ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে দ্বিধাবিভক্ত মার্কিন শিল্পমহল৷ আমদানি করা ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়ামের উপর নির্ভরশীল মার্কিন গাড়ি শিল্প, বিমান শিল্প ছাড়াও আরও অসংখ্য শিল্প এই সিদ্ধান্তে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছে৷ এমনকী ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে যে কর্মসংকোচনের আশঙ্কার কথা বলে ট্রাম্প এই শুল্ক চাপাচ্ছেন, এই সব শিল্পে এর ফলে তার থেকেও বেশি কর্মসংকোচনের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলির কর্তারা৷ সমালোচনা উঠেছে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের মধ্য থেকেই৷ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মার্কিন সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গ্যারি কোহন পদত্যাগ করেছেন৷ ফলে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে মার্কিন দুই কর্পোরেট গোষ্ঠীর মধ্যেও বেধেছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব৷ কী করলে যে কর্পোরেট পুঁজির সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা পাবে, ভেবেই কুল পাচ্ছে না তাদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার ট্রাম্প সাহেবরা৷ সব মিলিয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ঘনীভূত হচ্ছে বাজার দখলের লড়াই৷ এই লড়াইকে কেন্দ্র করেই অতীতে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ বেধেছিল৷

মার্কিন এই সিদ্ধান্তে প্রমাণ হল, একচেটিয়া পুঁজির বা সাম্রাজ্যবাদের যুগে ‘মুক্ত বাজার’ সব ক্ষেত্রেই শক্তিমান একচেটিয়া পুঁজি ও ধনকুবের গোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই কাজ করে৷ আবার যে কোনও আন্তর্জাতিক নীতি যতদিন পর্যন্ত শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশ তথা গোষ্ঠীগুলির স্বার্থ রক্ষা করে ততদিন তারা তাকে উদার এবং মুক্ত বলে তার জয়গান গায়৷ যখনই সেই নীতি তাদের স্বার্থে আঘাত করে তখনই তারা কোনও রীতি–নীতির তোয়াক্কা না করেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷ তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই একতরফা শুল্ক ঘোষণা৷ যে আমেরিকা একদিন জোর গলায় ঘোষণা করেছিল, মার্কেট উইল ডিসাইড এভরিথিং, সেই আমেরিকাই আজ শুল্ক প্রাচীর তুলে বাজারকে আটকাচ্ছে৷ এই সিদ্ধান্ত একই সাথে মার্কিন অর্থনীতির সংকটকেও তুলে ধরেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাজারের উপর তার আধিপত্য আর ধরে রাখতে পারছে না৷

সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর উল্লাসে ফেটে পড়ে পুঁজিবাদী দুনিয়া ঘোষণা করেছিল, বিশ্ব এবার একমেরু হল৷ পুঁজিবাদ এবার তার সমস্ত সংকট কাটিয়ে উঠবে– আর তার কোনও সংকট থাকবে না৷ বিশ্বের এক–তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি পুঁজিবাদী বাজারে মিশে যাওয়ায় কেউ কেউ মনে করেছিল পুঁজিবাদ বোধহয় সত্যিই তার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে৷ এমন পরিস্থিতিতেই তারা অনেক ঢক্কানিনাদ সহকারে নিয়ে এসেছিল গ্যাট তথা ডব্লিউটিও৷ বাস্তব প্রমাণ করেছে, ডব্লিউটিও পুঁজিবাদকে তার সংকট থেকে রেহাইয়ের কোনও রাস্তা দেখাতে পারেনি৷  তাই ডব্লিউটিওর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিও শুধু ডব্লিউটিওর উপর নির্ভর না করে যে যার সুবিধা মতো আলাদা আলাদা জোট গড়ে তুলেছে৷ আমেরিকা নিজে ‘নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ (নাফটা) গড়ে তুলেছে৷ এছাড়াও গড়ে উঠেছে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’, ‘জি–২০’, ‘ব্রিকস’, ‘সার্ক’ প্রভৃতি অসংখ্য জোট এবং গোষ্ঠী৷ আবার প্রতিটি দেশই অভ্যন্তরীণ বাজার সংকট কাটাতে অর্থনীতির সামরিকীকরণ ঘটাচ্ছে৷ কিন্তু কোনও কিছুতেই, কোনও টোটকা দিয়েই পুঁজিবাদ তার রোগ সারাতে পারছে না৷ আসলে এ তার মরণরোগ৷ এ যুগের অন্যতম মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই সংকটকে ‘এ–বেলা ও–বেলার’ সংকট বলে চিহ্ণিত করেছেন৷ অর্থাৎ সংকট এত গভীর যে, এ বেলা যদি অর্থনীতি এতটুকু সংকট কাটিয়ে মাথা তোলে তো ওবেলায় আবার শুয়ে পড়ে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই সংকট আরও গভীর হয়েছে৷ বাস্তবে এই রোগের কারণ রয়েছে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরেই৷ তা হল তার উৎপাদন কাঠামো, যা গড়ে উঠেছে শোষণকে ভিত্তি করে, মুনাফাকে ভিত্তি করে৷ এই শোষণ এবং মুনাফার মধ্য দিয়েই প্রতি মুহূর্তে জনগণকে নিঃস্ব করার মধ্য দিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে এবং বাজার সংকটের জন্ম দিচ্ছে৷ অর্থাৎ পুঁজিবাদের সংকট তথা এই মরণরোগ তার নিজেরই সৃষ্টি৷

পুঁজিবাদের এই স্থায়ী সংকট স্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করছে, পুঁজিবাদ নয়, সমাজতন্ত্রই সমাজব্যবস্থা হিসেবে শ্রেষ্ঠ৷ সমাজতন্ত্রে যেহেতু শোষণ থাকে না, মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন হয় না, হয় মানুষের প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে, তাই সেখানে কোনও বাজার সংকট থাকে না, থাকে না বাজার দখলের জন্য এমন প্রতিযোগিতা৷ সমাজতন্ত্র যতদিন ছিল, ততদিন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে বেকারি ছিল না, মূল্যবৃদ্ধি ছিল না৷ সমাজতন্ত্র ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে এক সুনিশ্চিত গ্যারান্টি৷ পুঁজিবাদের তৈরি এই স্থায়ী সংকট থেকে চিরকালের জন্য সমাজকে সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে আজ আবার নতুন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামিল হতে হবে৷